আলেয়া থেকে চন্দ্রমুখী কিংবা শুভদা, কিংবদন্তি আনোয়ারার কথা
পথহারা পাখি কেঁদে ফিরে একা, আমার জীবনে শুধু আঁধারের লেখা…
কাজী নজরুল ইসলামের এই বিখ্যাত গানের প্রতিটি মুহূর্ত বিমূর্ত হয়ে উঠেছিল ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ সিনেমায় আলেয়ার অনুরাগে। খান আতার এ ঐতিহাসিক সিনেমায় সিরাজউদ্দৌলা নাম ভূমিকায় অভিনয় করে মুকুটহীন নবাবের খেতাব পেয়েছিলেন আনোয়ার হোসেন। পাশাপাশি বাঈজী আলেয়া চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক খ্যাতি লাভ করেছিলেন তৎকালীন বাংলা চলচ্চিত্রের একেবারেই অনালোচিত একটি মুখ।
আলেয়া চরিত্রটি করার আগে সেভাবে পরিচিত মুখ ছিলেন না, ক্যারিয়ারের শুরুতেই এমন ঐতিহাসিক চরিত্র পেয়ে সেটার সুবিচার করেছিলেন তিনি। সেই ‘আলেয়া’ দিয়ে যে জয়যাত্রা করেছিলেন সেটার পূর্ণতা ঘটেছে একে একে দেবদাসের ‘চন্দ্রমুখী’ থেকে শরৎ চন্দ্রের ‘শুভদা’য়। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে নিজ অভিনয়গুনে প্রতিষ্ঠিত কিংবদন্তি অভিনেত্রী আনোয়ারা।
আমজাদ হোসেনের বিখ্যাত সিনেমা ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’তে ‘ময়না বু’ চরিত্রে অতুলনীয় অভিনয় করে নায়িকা ববিতারই সমান আলোচিত হয়েছেন। গোলাপীর পাশাপাশি ‘ময়না বু’ চরিত্রটি হয়ে উঠেছিল নারী সংগ্রামের প্রতীক। দর্শকদের কাছ থেকে বিপুল প্রশংসা পাওয়ার পর জুরি বোর্ডের রায়ে প্রথমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন আনোয়ারা। পরবর্তীতে সেই জাতীয় পুরস্কার নিজের হাতে তুলেছেন একবার হ্যাটট্টিক সহ মোট আটবার। তখনকার সব দাপুটে নায়িকাদের হারিয়ে ‘শুভদা’ সিনেমার জন্য সেরা অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পেয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন।
বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি মমতাময়ী মায়ের চরিত্রে প্রতিষ্টিত, সবচেয়ে জনপ্রিয় মা তিনি। বেশিরভাগ ছবিতেই তিনি স্বামীকে হারিয়ে সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করতেন। মায়ের চরিত্রে তিনি নিজেকে এতটাই জীবন্ত করে তুলতেন যেন তিনি সত্যিকারের মা। সন্তানের ভুলে রাগ করে যে চোখ বড় বড় করে তাকাতেন এটাতে অনেকেই ভয় পেয়ে যেতেন। আমজাদ হোসেনের ‘নয়ন মণি’তে প্রথম চাচীর চরিত্রে অভিনয় করে মাতৃরূপে আলোচিত হন। মূলত আশি ও নব্বই দশকে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে তুমুল আলোচিত হন।
বয়সে প্রায় সমসাময়িক হলেও ভাত দে, গরিবের বউ, অবুঝ সন্তানসহ অসংখ্য ছবিতে শাবানার মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সবচেয়ে বেশি। এছাড়া তখনকার অনেক ছবিতে নায়ক-নায়িকা যেইই থাকুক মায়ের চরিত্রে তিনি ছিলেন নিয়মিত তারকা। আলমগীর, জসিম, ইলিয়াস কাঞ্চন থেকে মান্না, রিয়াজ, শাকিব খানের পর্যন্ত মা হয়েছেন বিভিন্ন ছবিতে।
কাজী হায়াতের ‘দাঙ্গা’ সিনেমা থেকে হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমায় মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
শুধু যে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তা নয়, দেবদাসের বিখ্যাত চন্দ্রমুখী চরিত্রে যে অসাধারণ অভিনয় করেছেন তা প্রতিট দর্শকদের চোখেই চির অম্লান। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিষবৃক্ষ অবলম্বনে নির্মিত ‘বিরহ ব্যথা’ সিনেমায় লোভী গৃহ পরিচারিকার চরিত্রে অভিনয় করে প্রধান দুই নায়িকাকেও যেন ছাপিয়ে গিয়েছিলেন।
অভিনেত্রী আনোয়ারাকে সবচেয়ে বেশি ভালো ব্যবহার করেছিলেন আমজাদ হোসেন। উনার নির্মিত নয়ন মণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী, জন্ম থেকে জ্বলছি, দুই পয়সার আলতা, সখিনার যুদ্ধে অনবদ্য অভিনয় সেটারই প্রমাণ।
অভিনয়ের পাশাপাশি নৃত্যে পারদর্শী ছিলেন আনোয়ারা। নৃত্যশিল্পী হিসেবেই চলচ্চিত্রে পা রাখেন। সেইখান থেকেই জহির রায়হানের ‘সঙ্গম’ সিনেমা দিয়ে প্রথম পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন। পরবর্তীতে উনি হয়ে উঠেন আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির ‘পার্শ্বচরিত্রের সম্রাজ্ঞী’।
‘ও দাদী ও দাদী আমি তোমার দিওয়ানা’, শিবলি সাদিকের ‘অন্তরে অন্তরে’ সিনেমায় মায়ের চরিত্র ছেড়ে প্রথম সালমান শাহর দাদীর চরিত্রে অভিনয় করেন। আর এই দাদীমা চরিত্রেও তিনি ছিলেন দারুণ সফল, এই সিনেমা দিয়েই তিনি সর্বশেষ জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। একই বছর ‘সুজন সখি’র রিমেকে দাদী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। দাম্ভিকতা পূর্ণ দাদীমা থেকে মায়াভরা দাদীমা চরিত্রে তিনি বৈচিত্র্যতা এনেছিলেন। এর অনেক বছর পর ডিপজল উনাকে দিয়েই ‘দাদীমা’ সিনেমাটি নির্মাণ করেন।সর্বশেষ ‘পোড়ামন ২’ তে দাদীমার চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
নব্বইয়ের শেষ দিক হতেই তিনি ধীরে ধীরে ম্লান হতে থাকেন। যিনি এক সময় ছিলেন শোষিত নারী শ্রেনীর প্রতীক, সেই আনোয়ারাকেই যেন আর ওসব চরিত্রে মানাচ্ছিল না। শেষের দিকে মান্নার মা হয়েছেন বেশি, তখনকার বাণিজ্যিক সিনেমার সাথে তাল মিলাতেই গিয়ে উচ্চকিত অভিনয় করতেন। চলচ্চিত্রে অবদান রাখার জন্য পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা। এখন অসুস্থ হয়ে বাসায় দিন কাটাচ্ছেন, উনার সুস্থতা কামনা করি।
১৯৪৮ সালের ১৭ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করা এই কিংবদন্তি অভিনেত্রী। তার জন্য অনেক শুভ কামনা ও প্রার্থনা।