আলো আসতেই হবে!
শুধু একটি কক্ষে ১৯৭০ সালের আবহ সৃষ্টি করে কয়েকজন অভিনয়শিল্পীকে নিয়ে ‘লাইট, ক্যামেরা… অবজেকশন’ নামের ৩০ মিনিটের ব্যতিক্রমী যে কনটেন্ট উপহার দিলো সালেহ সোবহান অনীম। এককথায় অনবদ্য।
ফিকশনটির গল্প বা কনটেন্ট আমাদের অনেকেরই জানা। জহির রায়হান পরিচালিত কালজয়ী সিনেমা ‘জীবন থেকে নেয়া’ নো অবজেকশন ছাড়পত্র পেয়ে রিলিজ দেওয়ার পর আবারও মেটাফরিক একটি অর্থ দাঁড় করিয়ে সেটির প্রদর্শনী বন্ধ করা হয়েছিল পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের কারণে। সেই সময় সেন্সর বোর্ডে আবারও ডেকে পাঠানো হয় জহির রায়হান এবং সিনেমার সংলাপ রচয়িতা আমজাদ হোসেনকে। বেশকটি বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে সিনেমা রি-শুট বা সেই সিনগুলো কর্তন এর জন্য একপ্রকার চাপ দেওয়া হয় জহির রায়হানকে।
তবে রাও ফরমান আলীর উপস্থিতিতে সিনেমার বিরুদ্ধে আনা প্রতিটি যুক্তি খণ্ডন করে সমুচিত জবাব দিতে একটু ঘাবড়াননি জহির রায়হান। এমনকি সকল হুমকি, গ্রেপ্তারের ভয় দেখানো হলেও তিনি ছিলেন অনড়। তাই পরবর্তীতে সিনেমাটি আবারও মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সামরিক সরকার।
এখন এই বিষয়টাই সাসপেন্স ধরে রেখে মাত্র তিরিশ মিনিটে সেলুলয়েডে তুলে ধরা হয়েছে অসাধারণ নান্দনিকতায়। চিত্রনাট্য এবং সংলাপ এর জোরে পুরোপুরি উতরে গেছে ‘লাইট, ক্যামেরা অবজেকশন’। সেট ডিজাইন, আলোকসজ্জা, এবং পোশাক এই তিন ডিপার্টমেন্ট আলাদাভাবে প্রশংসার দাবিদার। গাজী রাকায়েত, অর্পণা ঘোষ, অপূর্ব মজুমদার তাদের ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন সাবলীল।
রাও ফরমান আলীর চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করা ইন্তেখাব দিনার আবারও প্রমাণ করলেন তিনি ছোট বা বড় যেকোনো চরিত্রে নিজের দক্ষতা আর প্রতিভার সাক্ষর রাখতে পারেন অনায়াসেই। আমজাদ হোসেনের চরিত্রে মীর জিসান ব্যক্তিগতভাবে আমাকে মুগ্ধ করেছেন। অল্প কিছু সংলাপ আর অসাধারণ এক্সপ্রেশন দিয়েই নিজের দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন তিনি।
শেষে বলতে হয় মোস্তফা মনোয়ারের কথা। কখনো ‘মিস্টার জনির’ দয়াল, ‘লাইভ ফ্রম ঢাকার’ সাজ্জাদ আবার ‘একাত্তরের’ সেলিম হিসেবে পর্দায় হাজির হওয়া মানুষটি দিন দিন নিজেকেই ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন’ হোক বা ঊনলৌকিক এর ‘মরিবার হলো তার স্বাদ’ প্রতিটি ফিকশনে অসাধারণ অভিনয় নৈপুণ্য দিয়ে তিনি বারবার দর্শকের মন জয় করেছেন অবলীলায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিংবদন্তি জহির রায়হানের ভূমিকায় এই স্বল্পদৈর্ঘ্য ফিকশনে তিনি ছিলেন অসাধারণ। তার বডি ল্যাংগুয়েজ, চোখের অভিব্যক্তি, কথা বলার ভঙ্গি সবকিছুই ছিল আপ টু দ্য মার্ক। সামনের দিনে তাকে নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা বাড়লো আরও কয়েক গুন।
সালেহ সোবহান অনীম পরিচালক হিসেবে দশে দশ পাবেন দেশীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘চরকি’তে রিলিজ পাওয়া এই ‘লাইট, ক্যামেরা অবজেকশন’-এর জন্য। সুহান রিজওয়ানের চিত্রনাট্য প্রশংসনীয়। চিত্রগ্রাহকের দায়িত্ব পালন করেছেন বরকত হোসেন পলাশ। প্রোডাকশন ডিজাইনে আছেন তাকদির-খ্যাত সৈয়দ আহমেদ শাওকী। এতগুলো গুণী মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ‘জাগো বাহে’ নামক অ্যান্থোলজি সিরিজের দ্বিতীয় কিস্তি ‘লাইট, ক্যামেরা অবজেকশন’ সময়ের অন্যতম নান্দনিক একটি উপস্থাপনা।
আমাদের দেশে এমন ‘কোর্ট রুম ড্রামা’ ঘরানার কাজ খুব কম হয়। তবে ‘লাইট, ক্যামেরা অবজেকশন’ এই ঘরানার সাম্প্রতিক সময়ে সেরা উপস্থাপন বললে ভুল হবে না। সামনের দিনে এমন কাজ আরও দেখতে পারবো আমরা এটাই কামনা। সব মিলিয়ে ফিকশনের শেষে জহির রায়হানের ভূমিকায় মুস্তফা মনোয়ারের দেওয়া একটি সংলাপের মতো করেই বলতে হয় যে, আলো আসতেই হবে! লেট দেয়ার বি লাইট!