Select Page

আসলেই ঈদে সবাইকে নিয়ে দেখার মতো ‘উৎসব’

আসলেই ঈদে সবাইকে নিয়ে দেখার মতো ‘উৎসব’

তানিম নূর স্টোরিটেলিং এ আধুনিকতা দেখাতে পেরেছেন। এজন্য চার্লস ডিকেন্সের লেখা ‘আ ক্রিসমাস ক্যারোল’ বেশ পুরনো গল্প হওয়া সত্ত্বেও, ২০২৫ এ দাঁড়িয়ে আমি ‘উৎসব’ নামক এই বাংলাদেশী এডাপটেশনের সাথে নিজেকে কানেক্ট করতে পেরেছি

[স্পয়লার নেই]

কোনো এক চাঁদ রাতে একটি আনন্দ অনুষ্ঠান আয়োজন করতে গিয়ে, রাজধানী মোহাম্মদপুরের শান্তিনীড় মহল্লায় ডেকোরেশন-ক্যাটারিং ব্যবসায়ী মোবারকের আকস্মিক মৃত্যু হয়। হঠাৎ বিয়োগান্তক পরিস্থিতিতে সেই ক্যাটারিং ব্যবসার দায়িত্ব কাঁধে নেন তার বিশ্বস্ত সহযোগী জাহাঙ্গীর (জাহিদ হাসান)। জাহাঙ্গীর এমনিতে মানুষ হিসেবে খারাপ নন, যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার সঙ্গে চালানো ক্যাটারিং ব্যবসা বেশ ভালোই চলছে। তবে এলাকার ছোট-বড়-যুবক-বৃদ্ধ সবাই তার ছোট মন-মানসিকতা ও কিপটেমি স্বভাবের জন্য বিরক্ত। সবাই তাকে আড়ালে-আবড়ালে ‘খাইস্টা জাহাঙ্গীর’ বলে ডাকে। এমন পরিস্থিতিতে এক চাঁদ রাতে জাহাঙ্গীরের জীবনে তিনজন অশরীরী আত্মার আগমন ঘটে। তারা জাহাঙ্গীরের অতীত ও বর্তমানের এমন কিছু ভুল তুলে ধরেন, যার খেসারত জাহাঙ্গীর সারাজীবন ধরে দিচ্ছেন। জাহাঙ্গীরের সেই ভুলগুলো কী কী, কীভাবে সেগুলো সংশোধন করা যেতো, সবমিলিয়ে জাহাঙ্গীরের ছোটলোকি মন-মানসিকতা শেষ পর্যন্ত পরিবর্তন হয় কিনা – এ নিয়েই উৎসবের গল্প।

পরিচালক তানিম নূর আমাদের কাছে ওয়েবসিরিজ নির্মাতা হিসেবে বেশি জনপ্রিয়। মানি হানি (২০১৯), কন্ট্র‍্যাক্ট (২০২১), কাইজার (২০২২) এসব সিরিজ ওটিটিতে বিপুল দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল। বড়পর্দায় অবশ্য তিনি ফেরত এসেছেন প্রায় ১৩ বছর পর। তার প্রথম সিনেমা ‘ফিরে এসো বেহুলা’ (২০১২)-তে একটি বড় কাস্টিং ছিল। ‘উৎসব’-এও সুবিশাল কাস্টিং দেখা যায়।

মূল চরিত্রে রয়েছেন জাহিদ হাসান। আর তার সহযোগী হিসেবে রয়েছেন একঝাঁক তারকা। চঞ্চল চৌধুরী, জয়া আহসান, অপি করিম, তারিক আনাম খান, আজাদ আবুল কালাম, আফসানা মিমি, ইন্তেখাব দিনার, আরেফিন জিলানী, সৌম্য জ্যোতি, সাদিয়া আয়মান, সুনেরাহ বিনতে কামালসহ অনেকে। জাহিদ হাসান ছাড়া বাকি সবার স্ক্রিনটাইম অবশ্য খুব বেশি ছিল না। তবে সিনেমায় এদের উপস্থিতি ‘জোর করে করানো হয়েছে’ সেটাও মনে হয়নি। এতোসব তারকাকে এক চলচ্চিত্রে দেখতে পাওয়াও মনে করি সৌভাগ্যের ব্যাপার! টিভি-চ্যানেলের ধারাবাহিক নাটকেও এতো তারকা একসাথে পাওয়া কষ্টকর।

কারো অভিনয় নিয়ে অভিযোগ করার খুব বেশি সুযোগ নেই। এরা সবাই একেকজন বাঘা অভিনেতা। বিশেষ করে জাহিদ হাসান তো অনবদ্য, এতো বছর হাজারটা ফিকশনে অভিনয়ের পরেও এখনো তিনি প্রতিটি চরিত্রকে আলাদাকরে নতুনত্ব দিতে পারেন। যদি ওনাকে কেউ একটি ঠিকঠাক চরিত্র দিতে পারে, তাহলে ওনার রূপদান করা পূর্বের কোনো চরিত্রের ছাপ আপনি নতুন চরিত্রে পাবেন না, এতোটাই নিখুঁত অভিনয় করে দেখান। যুবক বয়সে জাহিদ হাসান অন্তত একটা অ্যাকশন সিনেমা করলে আমি আজকে দাঁড়িয়ে ওনাকে বলতাম উনি বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ভার্সেটাইল অভিনেতা। ‘উৎসব’-এ তিনি একাই পুরো সিনেমা টেনেছেন।

চঞ্চল চৌধুরী ও জয়া আহসানকে দিয়ে সেল্ফ রেফারেন্সিং জোকস বেশি বলানো হয়েছে, সেটি দেখতে-শুনতে মন্দ লাগেনি। বেশ উপভোগ করেছি। এদের দিয়ে সেল্ফ রোস্টিংও করা হয়েছে যেটি সিনেমাহলের অডিয়েন্স খুব পছন্দ করেছে। চিত্রনাট্য যারা সাজিয়েছেন তারা এই রোস্টিং কালচার মনে হয় খুব পছন্দ করেন। কাউকে ছাড় দেননি, সবাইকে নিয়ে মজা করেছেন, এমনকি চলচ্চিত্রের একটা পর্যায়ে এসে নিজেদের সিনেমা নিয়েও নিজেরা রোস্ট করেছেন।

এছাড়া বহু নতুন-পুরাতন বাংলা-হিন্দি-ইংরেজী চলচ্চিত্র এবং বাংলা নাটকের নাম উল্লেখ করে রেফারেন্স টানা হয়েছে, যেগুলো আমি মনে করি তরুণ প্রজন্মের দর্শকেরা খুব কানেক্ট করবে। উল্লেখযোগ্য কিছু চলচ্চিত্র-নাটক হলো— হাওয়া, আয়নাবাজি, পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী ২, হাড়কিপ্টে, তারপরও আঙ্গুরলতা নন্দকে ভালোবাসে, দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে, বেসিক ইন্সটিঙ্কট ইত্যাদি। একটা সিকোয়েন্স জাহিদ হাসান বলেন, ‘আমি নিজেরে সালমান শাহ ভাবতাম কিন্তু আমি আসলে ছিলাম আহমেদ শরীফ’ – বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমী হিসেবে খুব মজা পেয়েছি।

এতো এতো তারকার মাঝে সাদিয়া আয়মান ও সৌম্য জ্যোতি নিজেদের আলাদা করে উপস্থিতি জানান দিতে পেরেছেন, তাই এদের নিয়ে কিছু প্রশংসা না করলেই নয়! এরা চলচ্চিত্রের খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গাজুড়ে ছিল। যদি এরা ভিনটেজ নাইনটিজ দেখাতে গিয়ে ওভারঅ্যাক্টিং করে ফেলতেন তাহলে পুরো সিনেমাই ঝুলে যেতো, বোরিং হয়ে যেতো। আদতে সেটা হয়নি। সাদিয়া আয়মানের বেশভুষা প্রচন্ড স্নিগ্ধ লেগেছে, অন্যদিকে সৌম্য জ্যোতি ছিল একদম পারফেক্ট চয়েজ, যুবক জাহাঙ্গীরের চরিত্রে তিনি একদম পিচ পারফেক্ট ছিলেন।

বরাবরই মতোই তানিম নূরের কনটেন্টে পুরনো ব্যান্ড গানের রিইউজ দেখতে পাওয়া যায়। এই স্টাইলটা আমার বেশ পছন্দের। তার এই সিনেমার মাধ্যমেই বহু দর্শক হয়তো লেভেল ফাইভ ব্যান্ডের ‘তুমি’ গানটির সাথে নতুন করে পরিচিত হলো। আর্টসেলের তুমুল জনপ্রিয় গান ‘ধুসর সময়’কে নতুন করে দেখতে পেলো। গানটির দৃশ্যায়ন অবশ্য আরেকটু এনার্জেটিক হলে ভালো হতো। ‘তুমি’ গানটি নিয়ে এই অভিযোগ নেই।

একটিমাত্র নেতিবাচক দিক মনে হয়েছে, সেটি বলি। আমার মনে হয়েছে এই চলচ্চিত্রের প্রযোজক ডোপ প্রডাকশন এবং প্রোডাকশন সাপোর্ট দেয়া প্রতিষ্ঠান চরকি, প্রজেক্টের শুরুতে গল্পটার পোটেনশিয়াল বুঝতে ভুল করেছেন। এটি সিনেমাহলের উপযুক্ত গল্পই ছিল। তো অবশ্যই ভালো প্রডাকশন ভ্যালু খরচ করে সিনেমাহলে চালানোর উপযোগী উন্নত ক্যামেরা দিয়ে সিনেমাটি শ্যুট করা উচিত ছিল। ১৬:৯ রেশিওতে সিনেমাটি শ্যুট করা হয়েছে, যা আমরা সাধারণত টেলিভিশনে বা ওটিটি কনটেন্টে দেখতে পাই। এই সীমাবদ্ধতার জন্য ‘উৎসব’ সিনেমাহলে প্রোপার সিনেম্যাটিক এক্সপেরিয়েন্স দিতে ব্যর্থ হয়। ‘আয়নাবাজি’ বানানো ডিওপি রাশেদ জামান এই সিনেমাতেও ভালো ক্যামেরাওয়ার্ক সামলিয়েছেন। কিন্তু সেটি আরো বেশি ক্লাসিকাল ভাইব নিতে পারতো যদি ‘উৎসব’কে অন্তত ১.৮৫:১ বা ২:১ রেশিওতে শ্যুট করা হতো। সাধারণ দর্শক একে ‘নাটক’ আখ্যান দিতে পারে, এই অভিযোগ করার সুযোগ মেকার্সরাই রেখে দিয়েছে।

নির্মাতা তানিম নূর স্টোরিটেলিং এ আধুনিকতা দেখাতে পেরেছেন। এজন্য চার্লস ডিকেন্সের লেখা ‘আ ক্রিসমাস ক্যারোল’ বেশ পুরনো গল্প হওয়া সত্ত্বেও, ২০২৫ এ দাঁড়িয়ে আমি ‘উৎসব’ নামক এই বাংলাদেশী এডাপটেশনের সাথে নিজেকে কানেক্ট করতে পেরেছি। আমি মনে করি ‘উৎসব’ আপনি ঘরে বসে একা দেখলে আপনার এক্সপেরিয়েন্স অন্যরকম হতে পারে, কিন্ত প্রায় সব ধরনের অডিয়েন্সের সাথে বসে দেখলে আপনার এক্সপেরিয়েন্স অবশ্যই পজেটিভ ধরনের হবে। এটি সবাইকে নিয়ে দেখার মতো চলচ্চিত্র।


About The Author

চলচ্চিত্র বিষয়ক ব্লগার ও ইউটিউবার

Leave a reply