আয়নাবাজি : রূপ পরিবর্তনের হাওয়া
প্রথমত বলি, আপনাকে বাংলা সিনেমার পরিবর্তন দেখতে হলে, নতুন রূপ দেখতে হলে আয়নাবাজি অবশ্যই দেখতে হবে,অবশ্যই। না সিনেমার গল্পটি আমি বলছি না ওটা আপনাকে সিনেমা হলে গিয়েই দেখতে হবে, বরং ছবিটি আমার কেমন লেগেছে সেটি বলি। ভিস্যুয়াল মিডিয়ায় বহু আগে নাম লেখালেও অমিতাভ রেজা সিনেমাটা হুট করে করেননি, সময় নিয়েছেন, হাত পাকিয়েছেন এবং সোনা ফলিয়েছেন যার নাম আয়নাবাজি ।
আয়না কিরকম? আপনি আয়নার সামনে দাড়াবেন ,আয়না “আপনি” হয়ে যাবে। আমি আয়নার সামনে দাড়ালে, আয়না “আমি” হয়ে যাবে। নানান জন আয়নার সামনে দাড়ালে, আয়না নানান জনের প্রতিচ্ছবি হয়ে যায়,আয়নায় দেখা যায় সমাজ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। এই আয়নাই সিনেমাটির প্রাণ, তবে কাঁচের তৈরী আয়না নয়, রক্ত মাংসের আয়না চঞ্চল চৌধুরী। এরকম অভিনয় যেখানে এতো বেশী ডাইভার্সিটি আছে, বাংলাদেশের সিনেমায় আমি এর আগে দেখিনি। চঞ্চল চৌধুরী যেটা করেছেন সেটা বাংলা ছবিতে সচরাচর দেখা যায় না, এক কথায় অনবদ্য, তার নেতৃত্বে ছবিটি এগিয়ে গিয়েছে বলিষ্ঠভাবে। একটা চরিত্র থেকে আরেকটা চরিত্রে, আরেকটা চরিত্র থেকে অন্যটায় এভাবে একজন চঞ্চলই বিভিন্ন অবয়বে যেভাবে এসেছেন সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। আপনি যদি একই চলচ্চিত্রে বহুমাত্রিক অভিনয় দেখতে চান, তবে আপনাকে অবশ্যই আয়নাবাজিতে চঞ্চল চৌধুরীকে দেখতে হবে। নাবিলা প্রসঙ্গে আসি, নির্মাতা সম্ভবত নাবিলার চোখ দেখে তাকে কাস্ট করেছেন। ভীষন এক্সপ্রেসিভ চোখ, গভীর চোখ,ডুব দেয়া যায় এরকম চোখ। নাবিলা সাবলীল অভিনয় করেছেন, চিরন্তন প্রেমিকাসুলভ আচরণ আর সংলাপ উচ্চারণ, নাবিলার চরিত্রের প্রতি দর্শককে আকর্ষন করে। পার্শ্ব চরিত্রের সকলেই ভালো করেছেন এমন কি বৃন্দাবন দাশের ছোট একটি চরিত্র মনে রাখার মত, তবে পার্থ বড়ুয়ার অভিনয়ের আরো সুযোগ ছিল, তার কিছু দৃশ্য অতি অভিনয় দোষে দুষ্ট ।
আয়নাবাজির একটি শক্তিশালী দিক এর চিত্রগ্ৰহণ, “রানওয়ে” সিনেমায় মিশুক মুনীরের সিনেম্যাটোগ্ৰাফির মুন্সিয়ানা দেখার অনেক দিন পর আয়নাবাজিতে দেখলাম রাশেদ জামানের ক্যামেরার যাদু। মিশুক মুনীর চলে গেছেন কিন্তু রেখে গেছেন রাশেদ জামানের মত উত্তরসূরীদের। আয়নাবাজির প্রতিটি ফ্রেম, প্রতিটি শট যেন সময় ধরে রাখে,স্থান ধরে রাখে। পুরান ঢাকা,নতুন ঢাকা,জ্যামের ঢাকা,ঢাকার আকাশে ভোর-গোধূলী, নদী, ঘাট,নৌযান, ভীড়,বাজার কোর্ট কাছারি ,অন্ধকার জেল এই প্রতিটি স্থান প্রতিটি সময় যেন সিনেমাটিতে একেকটি জীবন্ত চরিত্র হয়ে উঠেছে। ছবিটিতে বেশ কিছু অবজেকটিভ শট রয়েছে অর্থাৎ চরিত্রের চোখ যখন ক্যামেরার চোখ হয়ে উঠে এরকম শট ,অসাধারণ সেই দৃশ্য গুলো। ড্রোন থেকে টপ এঙ্গেল চোখ জুড়ানো ফ্রেমও রয়েছে ছবিটিতে। লোকেশান, পোশাক পরিকল্পনা, শিল্প নির্দেশনা, কালার গ্ৰেডিং, সাউন্ড ডিজাইন প্রভৃতি কারিগরী দিক বিশ্লেষন করলে বোঝা যায় সিনেমাটা করতে যথেষ্ট ঘাম ঝরিয়েছেন নির্মাতা দল। ব্যাকগ্ৰাউন্ড স্কোর ও শব্দ সংযোজন অসাধারণ । শব্দ সংযোজনে লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে, ক্যামেরা ও চরিত্রের দূরত্বের সাথে সাথে সংলাপের শব্দও কম বেশী হয় ,হয়তো বাস্তবতার নিরিখে এমনটি করা হয়েছে যা প্রশংসা যোগ্য। গল্পটি লিখেছেন গাওসুল আলম শাওন তিনি একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন। এরকম গল্প এর আগে বাংলা সিনেমায় হয়নি। গল্পটি বলা হয়েছে সরল রৈখিক ভাবেই অথচ সিনেমাটি থ্রিলার। সরলরৈখিক ফরম্যাটে থ্রিল দেওয়াটা আমার কাছে বেশ কঠিন মনে হয় কিন্তু অমিতাভ সেটা দক্ষতার সাথে করেছেন এমন ভাবে করেছেন যে ,আপনি সিনেমাটি ছেড়ে সিট থেকে উঠতে পারবেন না। সিনেমাটিতে খুত যদি ধরতেই হয় তবে বলা যেতে পারে কিছু দৃশ্যের কন্টিনিউটি আর কিছু ডিটেইলের অভাব ছিল, যেমন সাংবাদিক পার্থ বড়ুয়ার পারিবারিক জীবনের ডিটেইল কিংবা সাংবাদিকের চঞ্চল চৌধুরীকে হঠাৎ খুজে পাওয়ার ডিটেইল এরকম কিছু দুর্বলতা ছিল। চঞ্চল চৌধুরীর একটি সংলাপের কথা বলি যেটা আয়নাবাজি ছবিটিকেই রিপ্রেজেন্ট করে, সমাজ বাস্তবতার কথা বলে “চারপাশ বদলে যায়, থেমে যায় সময়। সবার জন্য সব সত্য অামার জন্য শুধুই অভিনয়”
আয়নাবাজি অমিতাভ রেজার প্রথম ছবি। সিনেমাটিকে নির্দিষ্ট ঘেরাটোপে আটকে রাখা যায় না, এটাকে একেবারে বিকল্প ধারা বা বাণিজ্যিক ধারা এভাবে আমি বিভক্ত করব না, বরং নির্মাণের একটু তুলনা করতে হলে আমি ভারতের সৃজিত মুখার্জির নির্মাণের সাথে তুলনা করতে চাই, অর্থাৎ এমন সিনেমা যেটা শৈল্পিক আবার ব্যবসা বান্ধবও। অমিতাভ রেজা ও তার দলকে সাধুবাদ একটি ভালো সিনেমা উপহার দেওয়ার জন্য। এরকম আয়নাবাজি আরও হতে থাকুক, বেশী নয় বছরে ৩-৪ টে হলেই চলবে। বাংলা চলচ্চিত্রের জয় হোক।