Select Page

ইমতিয়াজ আসলে পুঁজিবাদী, একটা পিউর পুরুষতন্ত্র, সে প্লেয়ার এবং রয়া তার ফাঁদে

ইমতিয়াজ আসলে পুঁজিবাদী, একটা পিউর পুরুষতন্ত্র, সে প্লেয়ার এবং রয়া তার ফাঁদে

10314750_1120658794645158_7292627879107535726_n

রয়া একজন পুরুষতান্ত্রিক নারী
‘আন্ডার কন্সট্রাকশন’ নিয়ে প্রথমেই যা শুনলাম সেটা হলো ‘নারীবাদী সিনেমা’। প্রচলিত নারীবাদের মূল লক্ষ্য মানুষ হওয়া এমন আমার মনে হয় না। মনে হয় এ নারীবাদ অন্য কিছু বলতে চায়। সে নারীকে ‘নারী’ (কিন্তু এ ‘নারী’ কোন নারী?) হিসাবেই আলাদা এক সত্ত্বা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তবে সেটা সে করে পুরুষের সাথে প্রতিযোগিতা করেই। তাই নারীর পুরুষ হয়ে ওঠার ইচ্ছাই নারীবাদ হিসাবে দেখতে পাই। নারীবাদের যে প্রচলন সেটা শেষমেশ পুরুষতন্ত্রেরই একটা আচরণ। তাই রয়াও পিতৃতন্ত্র থেকে বের হওয়া একজন পরাধীন পুরুষতান্ত্রিক নারী। যে নারী ১২ বছর ধরে থিয়েটার করছে, আধুনিক পোশাক পড়ছে, স্বামী বিদেশে থাকা অবস্থায় পরকীয়া করছে সে কীভাবে পরাধীন পুরুষতান্ত্রিক হয়? কীভাবে, সেটা ব্যখা করছি। এটা জানতে গিয়েই ইমতিয়াজের পরিচয়টাও জানা যাবে। রয়া পিতৃতন্ত্র থেকে বের হওয়া নারী, ‘মা’ হওয়াকে সে নিজের জন্য গুরুত্বপুর্ন মনে করে না, তার পিতা অন্য একজন নারীর জন্য তাদের ছেড়ে গেছে; সেজন্য তাকে আলাদা শোক প্রকাশ করতে দেখা যায় না। বরং তার মা কবে বুঝবে যে তার বাবা ফিরবে না– এমন ধরনের তিরস্কার সে করে তার মা’কে। মায়ের বয়স হয়েছে, একা থাকেন। তিনি পিতৃতান্ত্রিক ধ্যান ধারণার মানুষ। রয়াকে তিনি শরীর দেখানো পোশাক পড়তে নিষেধ করেন।

বাংলাদেশে রয়ার শিল্পীসত্ত্বা
কিন্তু রয়া বড়লোকের বউ। স্বামী সামিরের টাকার পুর্ন সদ্ব্যবহার করছে সে। থিয়েটার করছে। ১২ বছর ধরে নন্দিনী চরিত্রটা করছে রক্তকরবীতে। সামির এখানে একজন ‘বড়লোক’। অন্তত রয়ার মায়ের কাছে তার পরিচয় তাই। কারন তিনিই রয়াকে বড়লোকের বউ মনে করেন। বড়লোকের বউ মানে- যে অন্যেরটা খেয়ে ফুটানি করে। রয়ার মায়ের কাছে স্বাধীন হওয়া মানে নিজে কামাই করতে পারা। অন্যদিকে ইমতিয়াজেরও কিন্তু তাই। সে রয়াকে জিজ্ঞেস করে যে সে নিশ্চয়ই হাউজ ওয়াইফ না? ইমতিয়াজের মুখ থেকে হাউজ ওয়াইফ কীনা এমন সন্দেহ প্রকাশ আর রয়ার তাতে বিব্রত হওয়া থেকে বোঝা যায়, কামাই করতে না পারাটা একটা সমস্যা, নারীর জন্যও। কিন্তু রয়া তো শুধু নারী না সে শিল্পীও। আর এখানে তার জীবীকার সাথে শিল্পীসত্তার যে সংকট বিদ্যমান সেটাও প্রকাশ পেয়েছে। নিজের খেয়েই এখানে শিল্পের মোষ তাড়ায় বাংলাদেশের শিল্পীরা, মানে সত্যিকারের শিল্পীরা। যারা শিল্পটাকেই জানতে বুঝতে চায় জীবন দিয়ে। রয়া এদিক থেকে সে ধরণের একটি ক্রিয়েচারও বটে।

12509525_1550121491968154_8261405307465196863_n

ময়না হলো নারীর প্রেমেরমেটাফর যে প্রেম রয়ার মধ্যে অনুপস্থিত
ময়না রয়ার বাসায় কাজ করে। সে প্রেম করে ফেলে লিফটম্যানের সাথে। পেটে বাচ্চা চলে আসে। ময়নার কী অভাব ছিল? থাকা-খাওয়ার বা আদরের? তাহলে সে কেন প্রেম করলো? অবশ্যই যৌনতার জন্য। এ বয়সে প্রেম আর যৌনতা স্বাভাবিক মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা। সে সেখানেই সুখ খুঁজতে চায়। আর তার অন্য কোথাও কিছু যে নেই সেটাও সে জানে। তার জন্য কাজ করে টাকা কামিয়ে বাচ্চা পেলে জামাইয়ের সাথে রাত ভর ঘুমানোই জীবন। এখানে একটা প্রেম আছে বলেই, সে পারে ভালো ঘরে থাকার মোহ ছেড়ে জামাইয়ের সাথে বস্তির জীবন শুরু করতে। সেটা ভুলও হতে পারত কিন্তু সে মুহুর্তের জন্য তার সে প্রেমটাই সত্যি ছিল। রয়ার মাঝে এমন সরল প্রেমের ধারণা নাই। আগে কখনও ছিল কীনা, সামিরকে সে কী ভেবে বিয়ে করেছিল এর কোনো ক্লু সিনেমায় নাই। জীবনে তার প্রেম প্রয়োজন আছে কীনা এটা কোথাও প্রকাশ পায় নি। ইমতিয়াজকে সে একবার বলে শুধু, ‘ডু ইয়ু ফিল লোনলি’? রয়ার একা লাগে, কিন্তু সে জানে না প্রেম চায় কীনা।

12524046_1550121868634783_4904802900418131985_n

ইমতিয়াজ আসলে পুঁজিবাদী, একটা পিউর পুরুষতন্ত্র, সে প্লেয়ার এবং রয়া তার ফাঁদে
রয়াকে বাদ দিয়ে একজন নিউ কামার মেয়েকে নন্দিনী চরিত্রটা দিতে চায় রাসেল ভাই। ইমতিয়াজের তরফ থেকে দেখলে রাসেল ভাই একজন দালাল ছাড়া কিছুই না। যারা নারীর শরীরের সংজ্ঞা তৈরি করে তাদের একজন তিনি নন কারন তার সেই ক্ষমতা নেই। নারীর আদর্শ শরীরের সংজ্ঞা বরাবরই ক্ষমতাবানদের হাতে তৈরি। এখন এসে সেটা ‘জিরো ফিগারে’ থেমেছে। আগে যেটা ছিল কলসের মতো বা কোকের বোতলের মতোও। মূল কথা নারীর শরীরকে ঠিক কীরূপে ভোগ করতে বেশী আনন্দ। ঠিক কোন পোশাকটা কীভাবে পড়লে আরো যৌন আবেদন কাজ করে, যৌন আবেদনের মূল শর্ত শুধু নগ্নতা না। নানা ভাবে নারী শরীরকে একমাত্র যৌন আবেদনময়ি হিসাবে দেখতে চাওয়াটা আবার পুঁজিবাদের লক্ষন। নারীকে প্রেমহীন ও প্রেম বিমুখ করে দিয়ে পুঁজিবাদ তার ফায়দাটা সেখান থেকে লুটতে চায়। আর পুঁজিবাদী পুরুষ হিসাবে ইমতিয়াজের পয়লা ফায়দা রয়ার সাথে শোয়া। রয়া ‘নিশ্চয়ই হাউজ ওয়াইফ না’ এ প্রশ্ন করার ধরনই তার পুঁজিবাদী মনোভাবের পরিচয় দেয়। সিনেমায় যদিও ইমতিয়াজকে দেখানো হয়েছে একজন উদার শিল্পপ্রেমিক মানুষ হিসাবে। বাস্তবের পুরুষের সাথে ইমতিয়াজকে মিলিয়ে নিন, ঠিক এমন পুরুষদেরই আমরা দেখতে পাই, তারা প্রেম করেন, সেক্স করেন এবং সেটাকে নানা গাল গপ্পো দিয়ে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেন। এবং তারা মনে করেন নারী তার সাথে শু’লে সেটা ঠিক আর অন্যের সাথে শু’তে গেলে সে নারী খানকি হয়ে যায়। তারমানে রয়ার মায়ের ভাষ্যমতে মেয়েরা নাটক করলে লোকে বেশ্যা বলে। আমি কল্পনাটা বাড়ালাম, দেখলাম রয়া অন্য কারো সাথেও প্রেম করছে, মানে পরকীয়ার উপর পরকীয়া। রয়ার স্বামী রয়াকে স্বার্থপর বলে। অন্যদিকে রয়া ইমতিয়াজের আড়ালে প্রেম করলে সেটা হবে লোভ। হয়তো ইমতিয়াজ রয়াকে লোভি বলবে।

রয়ার মুখে ‘নিউ কামার বাচ্চা একটা মেয়ে’ উচ্চারণে বিরক্তি আর উষ্মা প্রকাশ পায়। কিছু ফুল বিক্রেতা তাকে ‘আন্টি’ ডাকে। সে বাসার কাজের মেয়ে ময়নাকেও জিজ্ঞেস করে সে বুড়ো হয়ে গেছে কী না। সে থাকে হতাশ। নাটক ছেড়ে সংসার করবে এমনও ভাবে। রাসেল ভাইয়ের সাথে‘নন্দিনী’ চরিত্রের আইডিয়া মেলে না রয়ার। রয়া নন্দিনীকে রানা প্লাজার গার্মেন্টসকর্মী ভাবতে পারে। সেভাবেই নাটকের নির্দেশনা দিতে চায়। ইমতিয়াজ তাকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে এই শো এর সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে। ইমতিয়াজের একটি আচরণ এই শিল্পের শুদ্ধতা নষ্ট করে দিয়েছে। ইমতিয়াজের কাছেও রয়ার শরীরই গুরুত্বপুর্ন। ইমতিয়াজের নাম রয়ার মুখে শুনে ইঙ্গিতপুর্নভাবে ‘I am lactating’ বলে ওঠে রয়ার বান্ধবী। আমি আচরণের কারণে শুনে ফেলেছি ‘I am lubricating’ পরিচালকের হয়তো সেটাই ইচ্ছা! অর্থাৎ ইমতিয়াজ একজন ললিপপ জাতীয় পুরুষ। রয়ার পারফর্মেন্স দেখে (সম্ভবত) টেক্সট করে ইমতিয়াজ, “a body that speaks’ রয়ার বান্ধবীর ভাষ্য অনুযায়ী এটা বিশাল এক এচিভমেন্ট। অর্থাৎ, ইমতিয়াজের সেই নেম ফেম আছে যিনি একটি সার্টিফিকেট দিতে পারেন। আর এখান থেকেই তৈরি হয় আদর্শ শরীরের সংজ্ঞা। এবং সে দেখাটা একটা পুরুষের চোখ দিয়েই, আর রয়ার সাথে ‘ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড’ করার কারণে ইমতিয়াজের পুরো পুরুষতান্ত্রিক চরিত্রটা বের হয়ে আসে। এখানে রয়ার শরীরের প্রতি ইমতিয়াজের আগ্রহ যে শিল্পের জায়গা থেকে নয় বরং যৌন আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকে সেটাও বোঝা যায়। তাদের ডেট করাকে এমনভাবেও ব্যাখা করা যায় যে রয়া ইমতিয়াজের সাথে শু’লো তাই সে কাজটা করার সুযোগ পেলো!

1013342_1550121818634788_3311848803805069830_n

রয়া কি সচেতন পুরুষের এ খাই খাইমনোভাব নিয়ে?
না রয়া পুরুষকে শুধু স্বামীরূপেই সামিরকে দেখছে আর তাকে সে রাতে ঘুমের ঘোরে সাপ ভেবেছে। কারন সে এর কাছে বন্দী। সেখানে তার ভয় । সামির তার কাছে বাচ্চা চায়, আর বাচ্চা হলে রয়ার শরীর নষ্ট হয়ে যাবে, সে নন্দিনী হয়ে ইউরোপে দেশে দেশে ঘুরতে পারবে না। ইমতিয়াজ যে সাধারণ সাপ না কিন্তু ইচ্ছাধারী নাগ এটা রয়ার জানা নেই। ইমতিয়াজরা এমনি হয়। রয়ারা শিল্পের জন্য সব ছেড়ে তার নৌকার পাল তুলে দিলে ইমতিয়াজরা তাদের পদে পদে শুধু ভোগই করতে চায়। কারন তারা পুঁজিবাদী পুরুষ। আর রয়া না জেনেই সেই পুরুষতান্ত্রিক স্বাধীনতা ভোগ করছে। আসলে সে পরাধীন। কিন্তু রয়া কি শুধু শরীর সর্বস্ব একজন নারী? নাকি শিল্পী?

দর্শক আর নির্মাতা নিয়ে এক নোকতা
২০০৩ বা ২০০৪ এ মোস্তোফা সারোয়ার ফারুকির ‘ব্যাচেলর’ যেমন নারী পুরুষের সম্পর্কের ভিতর কমিটমেন্ট ভাঙা আর প্রেমের জন্য পরকীয়া এমন ধ্যান ধারণা প্রকাশ করেছিল, ‘আন্ডার কন্সট্রাকশন’ এসে সেটা ভেঙে দিচ্ছে। কেন পরকীয়া এখানে তার উত্তর নেই। মধ্যবিত্তের কাছে কমিটমেন্ট, প্রেম,সম্পর্ক ইত্যাদি এখন এই দশ বছরে গরীব মানুষের বিষয় হয়ে গেছে এটা এখানে স্পষ্ট। আমি সিনেমাটা দেখেছি নারীদের জন্য ফ্রি শোতে। জানতে পেরেছি প্রায় আড়াই শত নারীর জমায়েত হয়েছিল সেখানে। কাজের মেয়ে ময়না আর লিফটম্যানের চোখে চোখে কথা বলা- ইশারার দৃশ্যে আমি বাংলাদেশী মধ্যবিত্ত শিক্ষিত নারীদের চাপা হাসির শব্দ শুনতে পেয়েছি। যে হাসির অর্থ আমার কাছে ‘গরীবের আবার প্রেম!’ আবার অন্যদিকে রয়া আর ইমতিয়াজের ডেটের দৃশ্যে শুনশান নীরবতা। দর্শক বিবেচনা করেই এ সিনেমা নির্মিত হয়েছে। এ সিনেমার দর্শক বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত। পুরান নৈতিকতা ভেঙে নতুন নৈতিকতা তৈরিই এ সিনেমার লক্ষ্য। সিনেমাটাকে বড়লোকি সিনেমাও বলা যেতে পারে। মানে উচ্চ মধ্যবিত্ত বড়লোকি। আর এর দর্শক মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত।


Leave a reply