
‘উড়াল’ একটি আড়াল সময়ের গল্প
উড়াল’ টিম তাদের প্রচারণায় এটিকে ‘বন্ধুত্বের গল্প’ বলেও, ‘উড়াল’ আসলে এক অন্তর্লুকানো সময়ের ভাষ্য—যেখানে শুধু রাষ্ট্রে নয়, পরিবারেও স্বৈরতন্ত্রের সূক্ষ্ম অনুরণন থাকে…

উড়াল; পরিচালক জোবায়দুর রহমান;কাহিনি ও চিত্রনাট্য সম্রাট প্রামানিক;প্রযোজক শরীফ সিরাজ;চিত্রগ্রহণ ইবাদ আলীম;সম্পাদক আশিকুর রহমান সুজন;সংগীত খৈয়াম সানু সন্ধি;অভিনয় মাহাফুজ মুন্না, সোহেল তৌফিক, শান্ত চন্দ্র সূত্রধর, কাব্যকথা, কে এম আব্দুর রাজ্জাক, করবী দাশ ও রোশেন শরিফ;ধরন নাট্যধর্মী; রিলিজ ১ আগস্ট ২০২৫; ভাষা বাংলা
নব্বইয়ের দশক বাংলাদেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ নয় বছরের স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতন হয়েছিল। এ সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যেমন ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে সক্রিয় ছিল, তেমনি দেশের শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, নাট্যকর্মী ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একটি অংশও সেই স্বৈরতন্ত্রবিরোধী সংগ্রামে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছিলেন। যারা ছিল রাষ্ট্রীয় দমননীতি, সেনাশাসন, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অগণতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের গুরুত্বপূর্ণ ধারক।
কিন্তু বিস্ময়করভাবে, এরশাদ পতনের পর যেন হঠাৎ করেই সব থেমে গেল। কবির কলমে আর প্রতিবাদী কবিতা নেই, পাড়ায়-মহল্লায় নাট্যকর্মীদের হাতে প্রতিবাদী নাটকের চিত্রনাট্যও অনুপস্থিত। দীর্ঘ নয় বছরের আন্দোলন ও স্বপ্নভঙ্গের ব্যথা চলচ্চিত্র বা প্রামাণ্যচিত্রে খুব একটা উঠে এল না। বরং, যেন সচেতনভাবেই সেই সময়কে আড়াল করে অন্যদিকে তাকানোর চেষ্টা শুরু হলো। এই নিরবতা—এই বিস্মরণ কি ক্লান্তি থেকে, নাকি নিশ্চিন্ত সুখের আত্মসমর্পণ?—এই প্রশ্নটি আমাদের ভাবায়।
নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ছিল দ্বিধা-বিভক্ত। একদিকে ছিল ফর্মুলাভিত্তিক জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের জোয়ার, যেখানে অতিরঞ্জিত অ্যাকশন, সংলাপনির্ভর নাটকীয়তা, এবং নাচ-গান-ভিলেন-নায়িকার পুনরাবৃত্তিতে দর্শকদের হাততালি চাওয়া হতো। অন্যদিকে ছিল একটি ক্ষীণ, প্রান্তিক জীবনঘনিষ্ঠ ধারা— যা প্রায় শোনা যেত না।
তৎকালীন ফর্মুলাভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলোর কেন্দ্রীয় ভাবনা ছিল প্রায়শই বিরাজনীতিকরণ। নায়ক মধ্যবিত্ত পরিবারের এক মেধাবী ছাত্র, যিনি ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে সমস্যায় পড়েন। তার দুঃখী মা কান্নারত মুখে কসম করিয়ে নেন—সে যেন আর কখনো রাজনীতিতে না জড়ায়। এবং ছেলেও তার কথা রাখে। বড়লোকের সুন্দরী মেয়ে ও অর্থবিত্তই হয় জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।
ফর্মুলা চলচ্চিত্রগুলোর জনপ্রিয়তার ফলে এমন এক সামাজিক বার্তা প্রতিষ্ঠিত হয় যে, “ভালো ছাত্ররা রাজনীতি করে না”—রাজনীতি কেবল খারাপ ছেলেদের কাজ। এর ধারাবাহিকতায় ডাকসু এবং অন্যান্য ছাত্র সংসদ, শিক্ষক-সংসদ, এমনকি বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়।
শুধু তাই নয়, ব্যবসাকে উপজীব্য করে গড়ে ওঠে কিছু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যারা তাদের বিজ্ঞাপনে লেখে: “ধূমপান ও রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।” নব্বই দশক ছিল এমন এক সময়, যখন কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, নাট্যকর্মী ও চলচ্চিত্র নির্মাতারা যেন ইচ্ছাকৃতভাবে বিস্মৃতিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সুখী জীবন বেছে নেন। সেই সুখ কি আত্মপ্রবঞ্চনা?—এই প্রশ্ন হয়তো ইতিহাসের কাছে ঋণ হয়ে রয়ে গেছে।
এই নব্বইয়ের প্রেক্ষাপটেই শরীফ সিরাজের প্রযোজনায় জোবায়দুর রহমান নির্মাণ করেছেন ‘উড়াল’— একটি সিনেমা যা সেই আড়াল সময়কে মৃদু কণ্ঠে, কিন্তু গভীর অভিঘাতে হাজির করে। সম্প্রতি আমি ছবিটি দেখেছি। ‘উড়াল’ টিম তাদের প্রচারণায় এটিকে ‘বন্ধুত্বের গল্প’ বলেও, ‘উড়াল’ আসলে এক অন্তর্লুকানো সময়ের ভাষ্য—যেখানে শুধু রাষ্ট্রে নয়, পরিবারেও স্বৈরতন্ত্রের সূক্ষ্ম অনুরণন থাকে।
অভিনয় শিল্পী শরীফ সিরাজ তার পেশা জীবনে বেশ কিছু সফল কাজ দর্শকদের দিয়েছেন। তাঁর কর্মজীবনে একজন সফল প্রযোজক হিসেবে ‘উড়াল’ একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে তাকে টুপি খোলা অভিবাদন জানাই।

চলচ্চিত্র নির্মাতা জোবায়দুর রহমান অস্থির বয়সের একটি নির্মাণ দল নিয়ে স্থির ও সফলভাবে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন। নির্মাণের প্রতি তাঁর ধ্যান চলচ্চিত্রটিতে স্পষ্ট। জোবায়দুর ভবিষ্যতে আরো অনেক ভালো করবেন ‘উড়াল’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তার অভিষেক সেই বার্তাই দেয়।
চলচ্চিত্রটির গল্প গড়ে উঠেছে নব্বইয়ের দশকের তিন বন্ধু রঞ্জু, বাচ্চু, মতি আর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারকে কেন্দ্র করে। খালি চোখে ‘উড়াল’ কেবল তিন বন্ধুর গল্প। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এটি হয়ে ওঠে শাসনের গল্প—ভয়, আনুগত্য ও নীরবতার গল্প। যেখানে একটি ভুলের শাস্তি হয় ভালোবাসাহীনতা; যেখানে একজন বাবা সন্তানের চোখে ভয় দেখতে চায়, শ্রদ্ধা নয়; যেখানে প্রেম ও বিশ্বাসের জায়গায় আসে সন্দেহ ও নিয়ন্ত্রণ। ‘উড়াল’ আমাদের সেই সব ঘরের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে নিপীড়নের হাত রাষ্ট্র থেকে শুরু হয়ে খাবার টেবিলেও পৌঁছে যায়।
চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্যের প্রথমার্ধে গল্পের সেটাপ তৈরিতে বেশ দুর্বলতা দেখা যায়। গান গাইতে গেলে গায়ক শুরুতেই বৈতালিক গেয়ে যেমন গানের টিমের সেটাপসহ দর্শকদের সাথে তার একটি সংযোগ তৈরি করে। তেমনি একটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যে প্রথমার্ধে সবচাইতে কম সময়ের মধ্যে গল্পের সেটাপ তৈরি করা জরুরি। বিরতির আগ পর্যন্ত ‘উড়াল’ গল্পে ঠিক কী বলতে চায় তা দর্শকদের সাথে যথার্থভাবে সংযোগ ঘটাতে পারে না। এই সময়টি একটু ধৈর্য্য নিয়ে পার করতে পারলেই গল্পটা টানতে থাকে। চলচ্চিত্রটি সংলাপনির্ভর নয়, দৃশ্যবিন্যাসে কাব্যিক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে গল্পটি বর্ণিত হয়। যা একটি বিশুদ্ধ চলচ্চিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কাহিনি ও চিত্রনাট্যকার সম্রাট প্রামানিক খুব সচেতনভাবে কোনো চরিত্রকে সরাসরি “ভিলেন” রূপে উপস্থাপন করেননি, বরং শোষণ ও শাসনের গহীনে থাকা অমানবিক অভ্যাসগুলোকে তুলে ধরেছেন।
বিশেষভাবে প্রশংসনীয় এর সিনেমাটোগ্রাফি—যা সময় ও মনের স্তরগুলোর মধ্যে উড়াল দেয় অবলীলায়। এই দিক থেকে ‘উড়াল’ চলচ্চিত্রে চিত্রগ্রাহক ইবাদ আলীম বেশ ভালো করেছেন।
‘উড়াল’ চলচ্চিত্র হয়ে উঠার পেছনে পরিচালকের পরেই যার অবদান খুব ভালো করে চোখে পড়ে তা হচ্ছেন সম্পাদক আশিকুর রহমান সুজনের চমৎকার সব কাট। কাটগুলো এক দৃশ্য থেকে অন্যদৃশ্যে যাওয়ার ট্রানজিশনগুলোকে বুঝতেই দেয় না। তবে পুরো চলচ্চিত্র জুড়েই বেশ কিছু মেদ (অপ্রয়োজনীয় ফুটেজ) দেখা যায়। বাজারকে প্রতিষ্ঠিত করতে সবচাইতে বেশি ফুটেজ অপচয় দেখা যায়। রঞ্জুর বাড়িতে বাচ্চুর যাওয়া-আসায় ফুটেজের ব্যবহারে আরও মিতব্যয়ী হয়া সম্ভব ছিল সম্পাদকের।
উড়ালের অভিনয় প্রসঙ্গ দিয়েই আলাপটা শেষ করি। পেশাদার-অপেশাদার এমনকি শুটিং লোকেশনের স্থানীয় অভিনেতা-অভিনেত্রী দিয়ে অভিনয় করার পরও চলচ্চিত্রে বেমানান কোনো চরিত্রের উপস্থিতি দেখি নাই। অভিনয়শিল্পীদের যে নামের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে তা থেকে জানা যায় ‘উড়াল’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন মাহাফুজ মুন্না, সোহেল তৌফিক, শান্ত চন্দ্র সূত্রধর, কাব্যকথা, কে এম আব্দুর রাজ্জাক, করবী দাশ, রোশেন শরিফসহ আরও অনেকেই। প্রত্যেকের অভিনয় এতটাই ভালো হয়েছে যে কেবল মুখ্য চরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন তাদের একক কৃতিত্ব না দিয়ে বরং বলতে চাই একটি টিমের সবাই ভালো অভিনয় করেছে যা এই দেশের খুবই স্বল্পসংখ্যক চলচ্চিত্রে দেখা যায়।
ইন্টারনেট, মোবাইল নেটওয়ার্কহীন একটি সময়ে অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের নেটওয়ার্ক কেমন হয়? পারিবারিক পরিমণ্ডলে অনার কিলিং কিংবা বন্ধুত্ব আর ভালোবাসায় তারুণ্যের ধৃষ্টতা কেমন হয়? এই সব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলে ‘উড়াল’ চলচ্চিত্রটি।
একদল তরুণ ‘উড়াল’ দিয়ে আমাদের আড়ালের গল্প বলে যায়। বিস্মৃতিতে চলে যাওয়া নব্বইয়ের দশক জীবন্ত হয়ে সিনেমার পর্দা আলোকিত করে। ‘উড়াল’ টিমকে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই।