Select Page

উত্তরাধিকার নিয়ে হুমায়ূন সন্তানদের স্পষ্ট দাবি

উত্তরাধিকার নিয়ে হুমায়ূন সন্তানদের স্পষ্ট দাবি

হুমায়ূন আহমেদের উত্তরাধিকার নিয়ে মুখ খুলেছেন তার দুই সন্তান। তার উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘দেবী’ সিনেমার প্রেক্ষিতে কথা বললেন শীলা আহমেদ ও নুহাশ হুমায়ূন।

কিছুদিন আগে ফেসবুকে শীলা লেখেন, “খবরের কাগজে দেখলাম ‘দেবী’ ইন্ডিয়াতে আগে মুক্তি পাচ্ছে! ইন্ডিয়া অথবা বাংলাদেশ, আগে অথবা পরে কোন কিছুতেই আমার অবশ্য কিছু যায় আসে না। আমার জানতে ইচ্ছা করছে, কে দেবী বানানোর অনুমতি দিয়েছে? আমরা চার ভাইবোন দেইনি। আমাদের চার ভাইবোনের অনুমতি ছাড়া কীভাবে এই সিনেমা সরকারি অনুদান পেল? কীভাবে এটা বানানো হয়ে গেল? কীভাবে এটা মুক্তি পাচ্ছে?

খুব দুঃখজনক হলেও এটা সত্যি যে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর তার সব কিছুর উত্তরাধিকার তার স্ত্রী আর ছেলেমেয়েরা। সমাজের বিশিষ্ট মানুষদের খুব খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই যে আমরা চার ভাইবোনও হুমায়ূন আহমেদের ছেলেমেয়ে! আমরা টিভিতে যেয়ে হুমায়ূন আহমেদ-হুমায়ূন আহমেদ করছি না, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেয়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছি না, হুমায়ূন আহমেদের জন্মবার্ষিকী/মৃত্যুবার্ষিকীতে ফুল দিচ্ছি না দেখে ভাবার কোন কারণ নেই যে আমাদের আইনগত কোন অধিকার নেই!

আমাদের ১০০% আইনগত অধিকার আছে বাবার কোন লেখা সিনেমা/নাটক/অনুবাদ হবে কিনা এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়ার। এবং ‘সমাজের বিশিষ্ট মানুষরা’- আপনারা যদি হুমায়ূন আহমেদের লেখা নিয়ে নাটক সিনেমা বানান, আপনাদেরও ১০০% দায়িত্ব আছে হুমায়ূন আহমেদের প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক উত্তরাধিকারের অনুমতি নেয়া।

যদি মনে হয় ‘বিশিষ্ট ব্যক্তি’ বলে এত ঝামেলা করতে পারবেন না, নাম না জানা প্রাপ্তবয়স্ক উত্তরাধিকারদের দ্বারে দ্বারে যাওয়া আপনাদের পক্ষে সম্ভব না, তাহলে এক বিয়ে করা কোন লেখকের গল্প উপন্যাস থেকে নাটক সিনেমা বানান! সেইরকম খুঁজে পাওয়া তো খুব কঠিন কিছু না ভাই!”

‘দেবী’ পরিচালনা করছেন আনম বিশ্বাস। অভিনয়ের পাশাপাশি সহ-প্রযোজক হিসেবে আছেন জয়া আহসান। আইকনিক চরিত্র মিসির আলী হয়েছেন চঞ্চল চৌধুরী। আরো অভিনয় করেছেন অনিমেষ আইচ, ইরেশ যাকের ও শবনম ফারিয়া।

এদিকে মঙ্গলবার ‘দেবী নিয়ে কিছু কথা’ শিরোনামের দীর্ঘ ফেসবুক পোস্টে নুহাশ লেখেন,

“আমি নিশ্চিত অনেকই ‘দেবী’ মুক্তির জন্য খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন। মানুষের আগ্রহের কারন, এই সিনেমাটি নির্মাণের জন্য ক্যামেরার সামনে আর পেছনে খুব মেধাবী কিছু মানুষ কাজ করেছেন। কিন্তু এটাও অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে ‘দেবী’ নিয়ে মানুষের আগ্রহের বড় এবং অন্যতম আরেকটা কারন, এর চরিত্রগুলো, গল্প আর এর সাথে জড়ানো কিংবদন্তী মানুষটির নাম।

অনেকেই হয়তো জানেন ‘দেবী’ নির্মাণ হয়েছে আমার বাবা হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাস থেকে আর এখানে ‘মিসির আলী’ চরিত্রটি আছে। ‘মিসির আলী’-হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি করা এমন একটা চরিত্র, যাকে আমরা সবাই ভালবাসি। কিন্তু যা অনেকেই জানেন না তা হল, এই সিনেমাটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে আমার এবং আমার তিন বোনের (নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ, বিপাশা আহমেদ) অনুমতি ছাড়াই।

হুমায়ূন আহমেদের সমস্ত সৃষ্টি এখন তার উত্তরাধিকারদের স্বত্বাধিকারে। আমাদের চার ভাইবোনের অনুমতি ছাড়া যে এই সিনেমাটি মুক্তি দেয়ার কাজ চলছিলো, সেটা সম্পূর্ণ আইন বহির্ভূত ছিল। যখন এই সিনেমার প্রযোজক জয়া আহসান এই বিষয়ে জানলেন, তিনি সাথে সাথেই আমার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করলেন এবং আমাদের চারজনের অনুমতি নেয়ার জন্য আইনগত সব ব্যাবস্থা নিলেন। তিনি এই সিনেমার মার্কেটিং সহ বাকি কাজ বন্ধ রাখলেন আমাদের চার ভাইবোনের চুক্তিপত্রে সাইন হওয়া পর্যন্ত।

নিয়ম অনুযায়ী আমাদের অনুমতি ছাড়া দেবী সিনেমার কোন কাজই শুরু হতে পারেনা। তারপরও হয়েছে। কিন্তু যখন জয়া আহসান আমাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং আমাদেরকে তার দিকের ব্যাখ্যা দিলেন, তখন আমাদের মনে হয়েছে -এটা তার দিক থেকে একটা অনিচ্ছাকৃত ভুল ছিল। আর তিনি যে এটা সংশোধন করতে চাচ্ছেন এটা একটা দায়িত্বশীল আচরণের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু বেশিরভাগ নির্মাতারা (যারা আমার বাবার সৃষ্টি নিয়ে কাজ করেছেন/করতে যাচ্ছেন) এতটা দায়িত্বশীল আচরণের পরিচয় দেননি অথবা দিচ্ছেননা, তাই আমি কিছু জিনিস স্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করতে চাই- যেন এই জাতীয় ভুল বারবার না হয়।

অনেক নির্মাতাই আমাদেরকে জানিয়েছেন তারা আমার বাবার স্ত্রী-মেহের আফরোজ শাওনকে এককালীন কিছু টাকা দিয়ে অনুমতি নিয়েছেন এবং নাটক নির্মাণ করেছেন। শাওন আমার বাবার ‘ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টির’ (গল্প, উপন্যাস, তার সৃষ্ট যেকোনো কিছু ) একমাত্র উত্তরাধিকার না। তাই আমাদের চার ভাইবোনের অনুমতি ছাড়া, শুধু মাত্র শাওনের অনুমতি নিয়ে, হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি নিয়ে কাজ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।

কিছু নির্মাতার অজুহাত হল, ‘আপনাদের কে পাওয়া কঠিন’– আসলেই কি তাই? সিনেমা নির্মাণ করা একটা কঠিন কাজ হতে পারে, কিন্তু ঢাকা শহরে কোন মানুষের সাথে যোগাযোগের উপায় বের করা বেশ সহজ। আমার ফেইসবুক পেইজটা পর্যন্ত ভ্যারিফাইড, তাহলে আর কত সহজ উপায়ে আমার বা আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে চান?

আরেকটা সাধারণ ভুল ধারণা হোল- আমাদের চাচা মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর অনুমতি নেয়া আর আমাদের চার ভাইবোনের অনুমতি নেয়া একই কথা। আমার মনে হয় এটা খুব স্পষ্ট করা দরকার- মুহাম্মদ জাফর ইকবাল আমাদের চাচা এবং আমাদের প্রিয়জন, কিন্তু তিনি আমাদের কোন মুখপাত্র অথবা অভিবাবক না এবং হুমায়ূন আহমেদের ‘ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টির রাইট’ নিয়ে আমাদের চার ভাইবোনের হয়ে তিনি কিছু বলার অধিকার রাখেন না।

আশা করি আমার এই লেখাটি কিছু সাধারণ ভুল ধারণা দূর করবে, আর যেই সব নির্মাতারা আমার বাবার সাহিত্য নিয়ে কাজ করতে চান, তারাও নির্মাণের আগে প্রয়োজনীয় আইনগত ধাপগুলো ভাল করে জেনে নিবেন। এটা হতে পারে মিসির আলী, হিমু অথবা আমার বাবার অন্য যেকোনো অনবদ্য সৃষ্টি – সেটা যাই হোক, এইসবই এখন অমূল্য সম্পদ আর তার উত্তরাধিকার(এবং তার সব ধরনের সৃষ্টির বিশাল ভক্ত) হিসেবে আমাদের দায়িত্ব খেয়াল রাখা এইসব যেন সঠিক আর মেধাবী নির্মাতার হাতে পরে।

আমার মনে হয়, মাঝে মাঝে ‘না’ বলতে পারাটাও এখন আমাদের জন্য খুব জরুরি। আমি নিশ্চিত হুমায়ূন আহমেদের ভক্তরা তার কাহিনী নিয়ে তৈরি হাতে গোনা কয়েকটা অসাধারণ কাজই পছন্দ করবে, একশোটা মাঝারি মানের কাজের চেয়ে। আর আসলেই কি প্রত্যেকটা সাহিত্যকর্ম কে সিনেমা অথবা নাটক বানানোর প্রয়োজন আছে? আমার বাবাতো এমনিই আমাদের বুকের মধ্যে বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টির জন্য- তার কাহিনী নিয়ে নাটক বা সিনেমা নির্মাণ তো তার অবস্থান পরিবর্তন করছে না আমাদের কাছে।

জয়া আহসানের জন্য শুভ কামনা থাকল। আর আশা করছি অন্য নির্মাতারাও এটাকে সঠিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখবেন, কিভাবে সবার জন্য সম্মানজনকভাবে আমার বাবার ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি নিয়ে কাজ করা যায়। এটা কিন্তু কোন আর্জি না বা অনুরোধ না- ভালভাবে ‘ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি’ আইন পড়ে দেখলেই বিষয়টি বোঝা যাবে।”


মন্তব্য করুন