উনিশ-বিশের ঈদ এবং বন্ধের খেলায় সিনেমা হল
সবাইকে জানাই পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের শুভেচ্ছা। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে এবার আর কারো মনেই ঈদের খুশি নেই। সকলের চেহারায় আতংক এবং কপালে চিন্তার ভাঁজ, কী অপেক্ষা করছে এ যাত্রায়.. সবাই যে যার জায়গা থেকে খোদার নিকট প্রার্থনা করে যাচ্ছে, মানবজাতি এবার যে নিজেদের অস্তিত্ব সংকটের মুখে।
করোনা সংকটকালে সমস্ত পৃথিবীর দৈনিক কাজকর্ম ওলট-পালট হয়ে গেছে। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বিশেষ করে বড়পর্দা ও ছোটপর্দার কাজকর্ম একদম থেমে গেছে। অথচ মাস তিনেক আগেও এবারের ঈদ নিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকদের মধ্যে কী এক্সাইটমেন্ট টাই না ছিল! সংবাদমাধ্যমের হরেক রকম খবরের ভেতর একটি খবরে বারবার চোখ আটকে যায়, করোনা আমাদের এই অবস্থায় না আনলে এই ঈদে ব্যবসায়িক দিক থেকে সাম্প্রতিক সময়ের সবথেকে জমজমাট লড়াই হতো। সময়ের তিন জনপ্রিয় তারকার চলচ্চিত্র মুক্তির কথা ছিল এই ঈদে। আগ্রহের পাশাপাশি সিনেপ্রেমীদের মনে আশঙ্কাও দেখা দিচ্ছিল। তিন তারকা তো মুখোমুখি হলো, কিন্তু লড়াইটা হবে কই? হলই তো নেই! যা আছে তাতে তো ভাত নিয়ে কাড়াকাড়ি লাগার মতো অবস্থা হবে।
বস্তুত, গত এক বছর আমি একরকম নিজ ইচ্ছাতেই ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের সিনেমাহলগুলোর অবস্থা সরাসরি গিয়ে দেখছিলাম। অনেকে আমাকে ইনবক্সে জিজ্ঞেসও করতো, কোন দরকারে আমি ঘরের কাছে এশিয়া/শ্যামলী থাকতে টঙ্গীর চম্পাকলিতে গিয়ে ‘ডনগিরি’ দেখি? আসলে সে প্রশ্নের যুক্তিসংগত উত্তর আমার কাছেও নেই। এই সময়টায় আমার সৌভাগ্য হয়েছে ঢাকায় টিকে থাকা ১৮-২০ টি হল দেখার; গাজীপুরে টিকে থাকা ৪-৫ টি, সাভার-ধামরাই-কেরানীগঞ্জে টিকে থাকা ৫-৬ টি এবং নারায়ণগঞ্জে টিকে থাকা ৬-৮ টি সিনেমাহল দেখার। এগুলো দেখতে দেখতে আমার কিছু বিষয় উপলব্ধি হয়েছে। এর মধ্যে কিছু যৌক্তিক মনে হতে পারে, কিছু মনে হতে পারে অযৌক্তিক।
একটু যদি একবছর পেছনে ফিরে তাকান, তবে দেখতে পাবেন গত রোজার ঈদে প্রায় ২০০ সিনেমাহলে ঈদের ছবি চলেছিল। এরপর কোরবানির ঈদেও প্রায় ২০০ সিনেমাহলে ঈদের ছবি চলেছে। অথচ এবার এমন অবস্থা, মিডিয়ায় খবর চাউর হয়েছিল এবার ১০০ হল খুঁজে পেতেই মাথার ঘাম পায়ে এসে যাবে! আগে দেখা যেতো যেসব ভাঙ্গারির গোডাউনে সারাবছর উলঙ্গ ছবি প্রদর্শন হতো, সেগুলো একত্র করে প্রায় ৪০-৫০ টা ঈদের ছবি প্রদর্শনের লিস্টে যোগ করা যেতো। এবার যেন ওভাবেও রক্ষা ছিল না।
২০০০ সাল থেকেই আমাদের দেশের সিনেমাহল একটি নির্দিষ্ট গতিতে কমতে শুরু করে। এর আগে যখন পুরো দুনিয়ার গণমানুষের কাছে ভিসিআর সহজলভ্য হয়ে গিয়েছিল এবং ব্যাপকারারে ভিডিও পাইরেসি শুরু হয়, তখন সারাবিশ্বের সিনেমার ওপর একটা বিরূপ প্রভাব পড়ে। দর্শক সিনেমাহলে যাওয়া বাদ দিয়ে ঘরে বসে সিনেমা দেখায় বেশি আগ্রহী হয়ে উঠলো। আমাদের এই ছোট কুঁড়েঘরের কথা না হয় এক সাইডেই রাখলাম, পুরো বিশ্বের বাঘা বাঘা ইন্ডাস্ট্রিগুলো ব্যবসায়িক দিক থেকে খাদের কিনারায় চলে গেছিল! তখন সিনেমা সংশ্লিষ্ট ভিন্ন ভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির বড় বড় কর্তারা এক-একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে কম সময়ে লস কভার দিয়ে ফেলেছিল। উপরন্তু বড় ইন্ডাস্ট্রিগুলোর ক্ষেত্রে বড় সুবিধা ছিল, এরা দীর্ঘদিন কোনো কিছুতে খরায় ভুগলেও ওত সহজে চুপসে যায় না। ঘুরে দাড়ানোর মতো যথেষ্ট সময় পায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আমাদের নিকটস্থ বলিউডের কথা, যারা এখন মৌলিক গানের সংকটে ভুগছে।
তো আমাদের আশেপাশের অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রিগুলো ঘুরে দাড়াতে পারলেও, আমরা পারিনি। আমাদের সিনেমায় একদল অতিবুদ্ধিমান হর্তাকর্তারা কম বাজেটের চলচ্চিত্র দিয়ে লস কভার দেয়ার চেষ্টা করলো। এতোটুকু করলেও ঠিক ছিল, যদি না তারা নব্বই দশকের শুরুতে পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালানো কাটপিস কালচারকে পুরোদমে কাজে লাগাতো। এতে করে আমরা নিম্নবিত্ত শ্রেণির দর্শক ধরতে গিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও নারী দর্শক উভয়কেই ঠেলা মেরে হলের বাইরে বের করে দিলাম।
বাইরের ইন্ডাস্ট্রিগুলো এই সময়টায় নিত্যনতুন টেকনোলজি দিয়ে দর্শক আকর্ষণের চেষ্টা করলো এবং এ নীরিক্ষায় তারা সফলও হলো। আর আমরা কি করলাম, ছবির বাজেট না বাড়িয়ে উল্টো কমিয়ে দিলাম। বড় তারকা, মেধাবী পরিচালক, ভালো গল্প নিয়ে কাজ করা বাদ দিয়ে আনকোরা শিল্পী, মাথামোটা পরিচালক, নকল গল্প নিয়ে একটা নির্দিষ্ট ফর্মুলায় কাজ করতে লাগলাম। আবার এই গণ্ডির বাইরে থেকে উঠে আসা সম্ভাবনাময় চলচ্চিত্রগুলোকে কোনঠাসা করা শুরু করলাম। অতীত মনে করিয়ে দিয়ে হলমালিকদের মনে এই ধারণা জন্মে গেলো, যে এগুলো দেখতে সিনেমাহলে কেউ আসবে না। মৌলিক গল্পের কিংবা স্বাধীন নির্মাতাদের চলচ্চিত্রগুলো মসলা ছাড়া মাংসের মতো। আর টেকনোলজির কথা আর কি বলি, কেউ কি বলতে পারবে আমাদের এদিকে ডিজিটাল সিনেমা প্রদর্শন কেন এতো পরে শুরু হলো? যেখানে আমাদের ঘরের পাশে থাকা ভারতের প্রায় সব ইন্ডাস্ট্রিতে ২০০৫-০৬ থেকে পুরোদমে ডিজিটাল চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু হয়ে গিয়েছিল! কেন আমাদের এদিকে সিনেমাস্কোপ পদ্ধতিতে নিয়মিত চলচ্চিত্র শ্যুট করা হতো না, এই উত্তর কয়জন দর্শক জানেন?
২০০০-০৬ এই সময়টায় একটা নির্দিষ্ট ধারায় সিনেমাহল বন্ধ হলেও, ২০০৭ এ এসে যখন কাটপিস চলচ্চিত্র ব্যান করা হলো তখন ভয়াবহ আকারে একগাদা সিনেমাহল বন্ধ হয়ে যায়। কিছু ভেঙে ফেলা হয় এবং কিছু ঝোপ বুঝে নতুন ছবি না নিয়ে কাটপিস কোপ মারতে শুরু করে। এরা চলচ্চিত্র নির্ভর না হয়ে কাটপিস নির্ভর হয়ে গিয়েছিল। ভালো চলচ্চিত্র এবং খারাপ চলচ্চিত্রের মধ্যে পার্থক্য সাধারণ দর্শকের তুলনায় অভিজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও তারা ধরতে পারেনি। অগত্যা, এরা আচমকা উধাও হলো।
এরপর আমাদের নতুন ছবি চালানো সিনেমাহলগুলো পুনরায় একটি নির্দিষ্ট গণ্ডি নির্ভর হয়ে উঠলো। আবার তারা কোনো রিস্কে না গিয়ে যেমন চলছে তেমনভাবে চালানো শুরু করলো। আর চলচ্চিত্রে পরিবর্তন বলতে কাটপিস ব্যান খেলো, বাজেট হালকার ওপর ঝাপসা বাড়লো। বাকি সবই প্রায় এক, সেই মাথামোটা পরিচালক, নকল গল্প। তারকাদের নেয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা ভাগ্য বিড়ম্বনা এবং ২০০০-০৬ এই সময়টায় যথেষ্ট প্রতিভা না উঠে আসায়, জেনারেশন গ্যাপের ধকলটা আমাদের চলচ্চিত্রে পড়লো। এর মধ্যে আবার সেই এককেন্দ্রিক করে ফেলা হলো চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে। ফলে ঐ যে দর্শক ঘরে গিয়ে টেলিভিশন, কম্পিউটার চালানো শুরু করেছে, তাদের আর সিনেমাহলে ফিরে আসা হয়নি।
সিনেমাহল বন্ধ হওয়া চলমান। এরপর কোনো এক প্রতিষ্ঠান হঠাৎ করে এসে এই অতিবুদ্ধিওয়ালা লোকজনদের প্লেটে ভাগ বসালো। কিছু হল ডিজিটাল হলো, তাও নিজেদের সক্ষমতায় না, ভাড়া করা প্রজেকশন সিস্টেম দিয়ে! বাকিরা আর কোনো আইডিয়া না পেয়ে কিছু ডিজিটাল হলো, আর কিছু বন্ধের খাতায়। তো এবার শুরু হলো ঝকঝকে, তকতকে কাজ, যেটা আরো ৬-৭ বছর আগে শুরু হওয়া উচিত ছিল। নতুন নতুন প্রতিভা উঠে আসা শুরু করলো। নতুন কিছু পরিচালক আসলো, কিছু নতুন প্রযোজক আসলো৷ কিন্তু বাকি সব আবার সেই একইরকম। আবার সেই মাথামোটা পরিচালক, নকল গল্প, এককেন্দ্রিকতা। 3G হাতে পাওয়া মধ্যবিত্ত এবার চলচ্চিত্র মুক্তির আগেই আসল সোর্স দেখা শুরু করলো।
২০১৬ কে বলা হয় কোয়ালিটির দিক থেকে বাংলা ছবির গেইমচেইঞ্জার। ডিজিটাল যুগে সবথেকে বেশি মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র পেয়েছি আমরা এই বছরে। এর মধ্যে একটা ছবি এমন রেকর্ডব্রেকিং সাফল্য পেলো, যা ছিল সবার কল্পনার বাইরে। কেউ চিন্তাও করেনি মাথামোটা পরিচালক, নকল গল্প, প্রযুক্তির দূর্বলতা, এককেন্দ্রিকতা… প্রভৃতির বাইরে দাড়িয়ে একটা চলচ্চিত্র এরকম তান্ডব চালাবে। ফলে হলো কি, এতোদিনে যে নিজেদের মধ্যেই একটা পলিটিক-পলিটিক খেলা শুরু হয়ে গেছে, সেটা স্পষ্ট হতে লাগলো। হলমালিকরা নিজেদের হক দাবী করে নবীন প্রযোজকদের সাথে মজা নেয়া শুরু করলো, আর চলচ্চিত্রাঙ্গনে দুই ধরনের মিডিয়ার মধ্যে একটা স্পষ্ট বিভক্তি এসে পড়লো। এরা কোনো চলচ্চিত্র বিন্দুমাত্র সাফল্য পেলেই দলবল নিয়ে তার পেছনে লাগা শুরু করলো। তবে যত যাই হোক, হল বন্ধের খেলা চলমান। ২০০৬-০৭ এ সেখানে ৫০০ হল ছিল, এখন আছে সেখানে ৩০০।
এরপর এক লাফে সিনেমাহল বন্ধের চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে চলে আসি, সময়টা হলো গত রোজার ঈদ। গত রোজার ঈদের চলচ্চিত্রগুলো নিয়ে সিনেমাহলগুলোর প্রত্যাশা যেরকম আকাশচুম্বী ছিল, সে তুলনায় তাদের প্রত্যাশা পুরণ হয়নি। আমি যতটুকু বুঝেছি তাতে তারা খুব সামান্যই লাভের মুখ দেখেছে। তবে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে দর্শক রিপিট হচ্ছিল, যার কারণে বেশিরভাগ সিনেমাহল কোরবানীর ঈদ পর্যন্ত চলচ্চিত্রগুলো চালিয়েছিল। মাঝে আবার আমাদের এক স্ট্রাগল করা তারকার চলচ্চিত্র প্রথম কয়েকদিন ভালো সাড়া পেলেও ভালো হলগুলো চলচ্চিত্রটি ছেড়ে দিলো।
কোরবানীর ঈদকে বেশিরভাগ বন্ধের অবস্থায় থাকা সিনেমাহল পাখির চোখ করে রেখেছিল। এ যাত্রায় রোজার ঈদের পুনরাবৃত্তি হলে তারা অন্য রাস্তা মাপবে। এবার অবস্থা হলো আরো করুণ! প্রথম দুই-তিনদিন পর ঈদের আমেজ একদম গায়েব। আমি ঈদের ষষ্ঠদিনে ঢুঁ মেরে পাশাপাশি দুই হলে ৫-১০% দর্শক পেলাম! এক্ষেত্রে অবশ্য ডেঙ্গু আতংক একটি অন্যতম কারণ ছিল। সেই কারণ কি আর পেটের দায়ে ভাতের থালা টানা অভাবী বুঝবে, অতঃপর যে যার মতো করে সিনেমাহল ভাঙ্গা শুরু করলো।
কোরবানির পর থেকে সিনেমাহলগুলো জোরেশোরে কমতে শুরু করে। এরপরে মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলোর হললিস্টে নজর রাখলে দেখবেন, একমাত্র শাকিব খান অভিনীত চলচ্চিত্র ছাড়া কোনো চলচ্চিত্র ৪০ এর বেশি হল পায়নি। আর এখন যা অবস্থা তাতে হলমালিকদের শাকিব খানের ছবিকে প্রাধান্য দেয়া ছাড়া উপায়ও নেই। তাদের এবং আমাদের তথাকথিত অতি বুদ্ধিমানদের অতীতের স্বল্পমেয়াদী ব্যবসায়িক চিন্তা বর্তমানে এই অবস্থায় এনেছে। এখন আবার একদল নতুন করে ফন্দি আঁটছে, শুধু হিন্দি ছবি আনলেই নাকি নোংরা হলগুলোতে হইহই করে লোকসমাগম হবে। কে জানে, হতেও পারে… পাশের টালিগঞ্জে ২০১৬ সালে ৪৫০ টি সিঙ্গল স্ক্রিণ ছিল, এখন আছে ১৮০ টি।
তো এতোএতো সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? উপায় তো ভাই ও বোনেরা অনেক আছে, কাজে রূপান্তর করবে কে? এই দিক দিয়ে আবার আমরা সবাই একে-অন্যের কোটে বল ঠেলে দিতে ওস্তাদ, আমরা তখন তুমুল ব্যস্ত! বলে বেড়াই এটা আমার দায়িত্বে পড়ে না৷ এখন শুনেছি এফডিসিতে এতো বেশি সংগঠন, ওত চলচ্চিত্রের শ্যুটিংও ওখানে হয় না। দলাদলি পাকিয়ে একদম ছাড়াছাড়া অবস্থা।
২০১৭ সালে কোথায় যেনো বলেছিলাম, পাঁচ বছর পর আমাদের দেশে পাঁচটার মতো সিঙ্গলস্ক্রিন থাকবে। এরপর কিছু লোকের যদি সুবুদ্ধির উদয় হয় তবে বাংলা চলচ্চিত্রে একটা new wave বইবে। নয়তো আমাদের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না, এমনিতেও আমাদের দেশের মানুষেরা চলচ্চিত্রকে প্রতিবাদরূপে না দেখে পাপ হিসেবে বেশি দেখে!
এ যাত্রায় যদি বেঁচে যাই, এই সমুদ্রে নতুন ঢেউ দেখতে চাই।