উপভোগ্য ‘দামাল’
এই প্রজন্মের তরুণরা শুধু বই বা চেনা ছকে নির্মিত সিনেমায় মুক্তিযুদ্ধকে জেনেছে। ‘দামাল’ এমন মাস্ট ওয়াচ সিনেমা যেখানে তারা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার দেশপ্রেমিকদের অনুভব করতে পারবে। নির্মাতা রায়হান রাফী সম্পর্কে প্রচলিত আছে, এই প্রজন্মের দর্শকদের পালস বোঝা ডিরেক্টর তিনি। ‘দামাল’ সেই ধারণাকে জোরালোভাবে প্রমাণ করেছে।
দুই ঘণ্টা ব্যাপ্তির এই সিনেমায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের গল্প তো এসেছে। পাশাপাশি ছিল এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমাদের মেয়েদের ফুটবলার হিসেবে নিজেকে গড়তে কতটা কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তারই ঝলক। সিনেমার এই সময়ের নানা প্রতিবন্ধকতা যেমন ছিল তেমনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শান্তি কমিটি রাজাকার, ক্যাম্পে ঘটা অত্যাচার বা সমাজের সব শ্রেনীর মানুষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নীরবে সাহায্য করার গল্পগুলোও উঠে এসেছে। পর্দায় সেই সময়ের প্রেম বিশ্বাসযোগ্য করে দেখানো হয়েছে। দুটি সময় বোঝাতে একটু ধূসর ও উজ্জ্বল দুই ধরনের কালার গ্রেডিং প্রশংসনীয়।
পর্দায় দুর্জয় রূপে সিয়াম আহমেদ তার ক্যারিয়ারের সেরা পারফরম্যান্স উপহার দিলেন কিনা; যারা সিনেমাটি দেখেছেন বা দেখবেন তারা ঠিকই বুঝতে পারবেন। অভিনেতা হিসেবে প্রতিনিয়ত নিজেকে ঝালাই করার কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন সিয়াম, তা আরো একবার দেখা গেল। অনেকেই তার সংলাপ ডেলিভারি নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন আগে, তবে ‘দামাল’এ সিয়াম আহমেদ সেই ক্ষেত্রে কোনো কমতি রাখেননি।
শরিফুল রাজ ভালো করেছেন মুন্না হিসেবে। সিনেমার নানা দৃশ্যে তাকে সত্তর দশকের একজন ফুটবল পাগল তরুণ হিসেবেই মনে হয়েছে। বিদ্যা সিনহা মিম অভিনেত্রী হিসেবে কেন এই সময়ের সেরা তার জবাব ‘দামাল’-এর হাসনা চরিত্রটি। অভিনয় প্রতিভার পাশাপাশি তার অসাধারণ সৌন্দর্য এই সিনেমার বাড়তি পাওয়া।
ইন্তেখাব দিনার দুই সময়ে দুই বয়সের চরিত্রে মানিয়ে গেছেন চমৎকারভাবে। শক্তিশালী এই অভিনেতার অভিনয় দর্শকদের তৃপ্তি দিয়েছে। বরাবরের মতো রাশেদ মামুন অপু অনবদ্য। তার বডি ল্যাংগুয়েজ এবং কিছু সংলাপ ডেলিভারিতে হাততালি দিয়েছে দর্শকে। এ কে আজাদ সেতু এবং সাঈদ বাবু যতোটুকু সময় স্ক্রিনে ছিলেন নিজেদের প্রতিভার ঝলকানি দেখিয়েছেন। শাহনাজ সুমী ভালো করেছেন তবে তার চরিত্রটির ব্যপ্তি কিছুটা বাড়ানো যেতো হয়তো। সমু চৌধুরী, নাসির উদ্দিন খান বা মিলি বাসার সুযোগ পেয়েছেন যতোটুকু মন্দ করেননি।
এই সিনেমার অন্যতম সারপ্রাইজ প্যাকেজ নিঃসন্দেহে মনির চরিত্রে সুমিত সেনগুপ্ত। বিরতির কিছু আগে স্ক্রিনে হাজির হলেও তিনি যে একজন জাত অভিনেতা তার প্রমাণ রেখেছেন দমদারভাবেই।
সিনেমায় মুক্তিযুদ্ধের সময় অভিনেতা সিয়াম আহমেদের কন্ঠে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার কয়েকটি লাইন যেমন ‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না, মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হবো শান্ত’ যেমন আমাদের রক্তে আগুন ধরিয়েছে, তেমনি হৃদকম্পন বাড়িয়েছে ‘দামাল দামাল কীসের এতো সংশয়, দামাল দামাল বীর ডরায় না পরাজয়, দামাল দামাল সর্বত্র সর্বময়, দামাল দামাল ধরবেই ধরবেই হাল’ সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে কিছু করে দেখানোর জন্য সাহস ও উৎসাহ যুগিয়েছে।
রায়হান রাফীর পরিচালনা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নাই। বাণিজ্যিক সিনেমার পরিচালক হিসেবে তিনি যে এই সময়ের সেরা তা আরো একবার প্রমাণিত। নাজিম-উদ-দৌলার লেখনি অসাধারণ। সুযোগ পেলে ঢাকাই সিনেমার অন্যতম স্তম্ভ হবার ক্ষমতা রাখেন তিনি। রিপন নাথের ব্যাকগ্রাউন্ড পুরো সিনেমা জুড়েই তার প্রতিভার অস্তিত্বের জানান দিয়েছে। আরাফাত মহসিন নিধির সুর অন্যরকম এক ভালোলাগা নিয়ে এসেছে সিনেমা দেখার সময়ে। তবে এই সিনেমার অন্যতম ইউএসপি সিনেমাটোগ্রাফার সুমন সরকারের মনোমুগ্ধকর কাজ। রিয়েল লোকেশনে বা কিছু অসাধারণ সেটে শ্যুটিং হওয়া ‘দামাল’ চোখে এবং মনে পরিতৃপ্তি এনে দেয়। ভিএফএক্সের কাজও মন্দ লাগে নাই।
‘দামাল’-এর প্রতিটি গানই সেলুলয়েডে দেখতে চমৎকার লেগেছে। গানের কথা, সুর, গায়কীর সাথে চিত্রায়ণের আয়োজন সবকিছুই ছিলো শ্রুতিমধুর এবং নজরকাড়া। বেশকিছু দৃশ্য আমাদেরকে রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই দেশ, পতাকার মর্ম নতুনভাবে বোঝাবে। বেশকিছু সিন আছে যা রীতিমতো চমকে দিয়েছে। মূল চরিত্রে তিন অভিনেতার তিনটি এমন দৃশ্য আছে এই সিনেমায় যা Goosebumps এনে দেয়।
সবমিলিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে স্পোর্টস জনরা নিয়ে কাজ হওয়া চলচ্চিত্র বলতে হাতেগোনা দুই একটা নামের মধ্যে ‘দামাল’ একটি বিশাল ক্যানভাসের সিনেমা। পরাণ, হাওয়ার কারণে প্রেক্ষাগৃহে ফেরত আসা বিনোদনপ্রেমী দর্শকদের জন্য ‘দামাল’ নিঃসন্দেহে একটি উপভোগ্য সিনেমা। পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেখার মতো এই সিনেমাটি দেখে নিতে পারেন কাছের প্রেক্ষাগৃহে।