উর্দু সিনেমা ‘দর্শন’, পোস্টার ও অন্যান্য
কয়েক দিন আগে ফেসবুকে শেয়ার করা একটি পোস্টার দেখে খানিক মজা পাই। সাদা-কালো সিনেমার রঙিন পোস্টার— এটাই মূল কারণ নয়, তবে অন্যতম। পেছনে হালকা সবুজের আবহে হাতে আঁকা রহমান-শবনমের ছবি দিয়ে পোস্টারটি করা। এটি ঢাকায় নির্মিত উর্দু চলচ্চিত্র ‘দর্শন’ এর পোস্টার। এ ‘দর্শন’ হয়ত ফিলোসফি অর্থে নয়, ‘দেখা’ অর্থে! সাধারণ দৃষ্টিতে যা দেখা যাবে, তা-ই এ লেখার মূল উপজীব্য।
পরিসংখ্যান বলে, ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ঢাকায় ২২৪টি ছায়াছবি তৈরি হয়। এর মধ্যে ৫৯টি সিনেমা ছিল উর্দু ভাষায় নির্মিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮৩-১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ-পাকিস্তানের যৌথ প্রযোজনায় ১৮টি ছায়াছবি নির্মিত হয়। পাকিস্তান আমলের সে উর্দু চলচ্চিত্রের অনেকগুলোই সিলভার জুবিলি, গোল্ডেন জুবিলি ও প্লাটিনাম জুবিলির রেকর্ড করেছিল। পাকিস্তানের ইতিহাসে দুটি ছায়াছবি প্লাটিনাম জুবিলি হয়েছিল তন্মধ্যে একটি ঢাকা থেকে নির্মিত। জহির রায়হানের হাতেই পাকিস্তানের প্রথম সম্পূর্ণ রঙিন ছায়াছবি নির্মিত হয়। মজার বিষয় হল, পাকিস্তান হিসেবে ১৯৭১ সালের শেষ ছায়াছবিটিও ছিল তার।
সাদাকালো চলচ্চিত্র ‘দর্শন’ মুক্তি পায় ১৯৬৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। রোমান্টিক ও মিউজিক্যাল ঘরানার চলচ্চিত্রটির কাহিনী, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ছিলেন নায়ক রহমান। চলচ্চিত্রটি হিট হয়। কুমকুম প্রযোজিত এ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন শবনম, রহমান, মুস্তাফা, মেহফুজ, ফতেহ লোহানী, গরজ বাবু ও রেশমা। সম্ভবত রাঙামাটির পাহাড়ি এলাকার চমৎকার লোকেশনে ‘দর্শন’ চিত্রায়িত হয়েছে।
এবার পোস্টার প্রসঙ্গে সমসাময়িক কিছু বিষয় মিলিয়ে দেখা যাক। এ সময়ে এ ধরনের পোস্টার মানে অফট্রাকের মুভি। অথচ একসময় ‘দর্শন’ এর পোস্টারই ছিল মেইনস্ট্রিম। ২০১২ সালের মার্চে চারুকলার জয়নুল গ্যালারিতে বাংলা চলচ্চিত্রের পোস্টার নিয়ে প্রদর্শনী করেছিল ‘বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভস’। সে প্রদর্শনীতে এমন নান্দনিকতার প্রমাণ ছিল ঢের। অথচ এখন অনেকগুলো অনাহূত মাথা না থাকলে পোস্টার হয় না। অথবা অদ্ভুত অভিব্যক্তি থাকতে হয়। বিষয়টি আরও মজা হয় টেলিভিশন বা অন্য মাধ্যম থেকে আসা পরিচালকদের ক্ষেত্রে। তারা সবসময় অন্যরকম কিছু করার কথা বলেন। অনলাইনে দারুণ দারুণ পোস্টার প্রকাশ করলেও রাস্তায় লাগানো পোস্টারে চোখে পড়ে অনেক অনেক মাথা।
বশীর আহমেদের রোমান্টিক টিউনকে ‘দর্শন’ হিট করার অন্যতম কারণ ধরা হয়। এ চলচ্চিত্রের ৯টি গানের মধ্যে ৮টি বশীর আহমেদ গীত। এ গানগুলোর গীতিকার, সুরকার ও কম্পোজার ছিলেন বাংলা গানের এ কিংবদন্তি। তিনি অবশ্যই বি এ দীপ ছদ্মনাম ব্যবহার করেন গীতিকার হিসেবে। শুধু তাই নয়, কণ্ঠশৈলির জন্য তাকে পাকিস্তানের আরেক গায়ক আহমেদ রুশদীর সাথে তুলনা করা হতো। এ সিনেমায় আরও কণ্ঠ দেন সে সময়ের জনপ্রিয় গায়িকা নূরজাহান, মালা বেগম ও মিনা বশীর। গানগুলোর শিরোনাম হল— ‘চাল দিয়ে তুম জো দিল তোর কার’, ‘চুন লিয়া এক ফুল তো থা সাব সে’, ‘দিন রাত খাইয়ালন মে তুজে ইয়াদ’, ‘জিদার দেখতা হু মে উদার তো’, ‘হামচালে চোর কার, তেরি মেহফিল’, ‘তুম তো মিলে পেয়ার মিলে, দিল কো’, ‘তুমহারে লিয়ে ইস দিল মে ইতনি মোহাব্বাত’, ‘ইয়ে মওসম ইয়ে মাস্ত নাজারে, পেয়ার কারো তু ইন সে কারো’ ও ‘ইয়ে সাম্মা, পেয়ারা পেয়ারা সা।’
সঙ্গীত আর দৃশ্যায়নে দারুণ জোড় ছিল এ চলচ্চিত্রে। ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে ‘দর্শন’ ও এর গানগুলো সহজে মিলবে। পিটিভি’র একটা লাইভ অনুষ্ঠানের ভিডিও মিলবে ইউটিউবে। সেখানে বশীর আহমেদ গাইছেন ‘হামচালে চোর কার, তেরি মেহফিল’। তার থেকে ‘দর্শন’ এর গানগুলোর জনপ্রিয়তার প্রমাণ মিলে।
গান ও দৃশ্যায়নের জন্য ‘তুমারে লিয়ে ইস দিল মে’ গানটি ভাল উদাহরণ। লেকে নৌকা চালাতে চালাতে গানটি শোনা যায় রহমানের কণ্ঠে। নৌকার অন্য সওয়ারী শবনম। গানটির অনেকটা তখনকার ট্রাডিশনাল সিনেমাটিক ফর্মে গাওয়া। চমৎকার কম্পোজিশনই গানটি প্রাণ। এমন নির্জনতায় বসে গান গাওয়াতে সাধারণত ধীরলয় আশা করা হয়। কিন্তু গানটি সকল নৈঃশব্দ্যকে ভেঙ্গে দেয়, লাউডলি মনের কথা বলে। অন্যদিকে স্লিভলেস ব্লাউজ আর শাড়িতে শবনম পুরো বিষয়টি উপভোগ করেন। ‘ইয়ে মওসম ইয়ে মাস্ত নাজারে’ গানটিও একইভাবে নৌকায় একাকী গাইছেন রহমান। শবনম একটি বাড়ির লনে আধুনিক আউটফিটে বসে আছেন। এ থেকে খানিক অনুমান করা যায় কোনো পাহাড়ী গ্রামে বেড়াতে এসে গরিব নৌকা চালক রহমানের প্রেমে পড়েন ধনীর মেয়ে শবনম। চলচ্চিত্রের কাহিনীও তা-ই। শহুরে মেয়ে বেবি ও গ্রামের ছেলে হিরার প্রেম কাহিনী। এক সময় হিরাকে বেবি শহরে নিয়ে যায়। হিরা দেখতে পায় শহর তার ভেতর থাকা সকল ভালত্বকে কেড়ে নিচ্ছে। বিনিময় পাচ্ছে শুধু ছলনা। এক সময় ফিরে আসে গ্রামে। পিছু পিছু আসে শবনম। এবার তার পরণে গ্রামীণ পোশাক। শহরকে ঘোররতভাবে সমালোচনা করে চলচ্চিত্রটি। মধুর মিলনে শেষ হয় চলচ্চিত্রটি।
‘দর্শন’ উর্দু চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ক্লাসিক হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাভাষীদের কাছে এ চলচ্চিত্রের তেমন আবেদন নেই। কিন্তু উর্দুভাষীদের কাছে এর কদর চোখে পড়ার মতো। এখনো অনেকে অনলাইনে চলচ্চিত্রটি তালাশ করেন। এমন নজির চলচ্চিত্রটি গান শেয়ারকারী বিভিন্ন সাইটে দেখা যায়।
১৯৬০ এর দশকের পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু চলচ্চিত্র নির্মাণের হিড়িক পড়ে। যদিও বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর তুলনায় উর্দুভাষীর সংখ্যা কম ছিল। তা সত্ত্বেও হিটের আশায় নানান ঘরানার উর্দু চলচ্চিত্র নির্মিত হয় বাঙালীদের হাতে। এর মধ্যে ফোক-ফ্যান্টাসি চলচ্চিত্রও ছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক। বলা হয়ে থাকে, উর্দুর জোয়ারকে বড়ো সড়ো ধাক্কা দেন সালাউদ্দিন। তার ‘রূপবান’ সে যাত্রায় বাংলা সিনেমার বাজারকে বদলে দেয়।
তথ্য সূত্র : ইন্টারনেট।
ওয়াহিদ সুজনের লেখাজোকার হদিস : ইচ্ছেশূন্য মানুষ।