Select Page

একটি হতাশার গল্প

একটি হতাশার গল্প

একটি সিনেমার গল্প
পরিচালনা : আলমগীর
অভিনয়ে : আলমগীর, চম্পা, আরিফিন শুভ, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, সৈয়দ হাসান ইমাম, সাদেক বাচ্চু, সাবেরী আলম, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, শাহ আলম কিরণ, ড. সোহেল বাবু, ববি, জ্যাকি, চাঁদ, খোরশেদ আলম খসরু, তৌহিদ হোসেন চৌধুরী।
রেটিং : ১/ ৫

এম এ আলমগীর— তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। ৪৬ বছরের অভিনয় অভিজ্ঞতা, নয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, প্রায় ২৩০টি ছবিতে অভিনয়, সেই সঙ্গে প্রশংসিত ও ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র পরিচালনা-প্রযোজনা (বৌমা, নিষ্পাপ, নির্মম, মায়ের দোয়া, মায়ের আশির্বাদ)। আনন্দের খবর এমন কিংবদন্তি একজন নায়ক বড়পর্দায় ফিরে এসেছেন পরিচালক হিসেবে; প্রায় ১৯ বছর পর তিনি বলেছেন নতুন এক গল্প। যার নাম ‘একটি সিনেমার গল্প’। তিনি নিজেই এ ছবির কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা, পরিচালক, প্রযোজক ও মূল অভিনেতা; স্বাভাবিকভাবেই দর্শকদের প্রত্যাশার পারদ আকাশ ছুঁয়ে যাবার কথা ছিল।

কিন্তু বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সে এ ছবি মুক্তির প্রথম দিন প্রথম শো দেখতে গিয়ে আমি প্রত্যক্ষ করলাম ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা। সর্বসাকুল্যে আমরা ১০ জন দর্শক ছিলাম পুরো মিলনায়তন জুড়ে। বিরতির পর সে সংখ্যা কমে ৫, পর্দা নামার ঠিক আগে যা ৩ জনে গিয়ে দাঁড়ায়। অবিশ্বাস্য ঠেকলেও এটিই সত্যি। এত জনপ্রিয় একজন তারকার ছবি; যে ছবিতে আছেন গুণী অভিনেত্রী চম্পা, ওপার বাংলার মেধাবী ও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার জেতা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, আমাদের দেশের এ সময়ের ক্রেজ আরিফিন শুভ! তারপরও ‘একটি সিনেমার গল্প’ থেকে দর্শকের মুক্তির প্রথম দিনই মুখ ফিরিয়ে নেবার কারণটা কী?

প্রশ্নটি জটিল হলেও উত্তরটি খুব সহজ। ছবি মুক্তির আগে এ ছবির প্রচার-প্রচারণা এতটাই দুর্বল ছিল যে, এ সময়ের দর্শকদের প্রেক্ষাগৃহ পর্যন্ত টেনে নিয়ে আসবার ব্যাপারে কোনো ধরনের আগ্রহই জন্ম দিতে সক্ষম হয়নি। এর কারণ প্রথমত: এ যুগে দর্শক ছবি মুক্তির আগেই পূর্ণাঙ্গ গান দেখে, হৃদয়ঙ্গম করে প্রেক্ষাগৃহে যেতে চায়। ‘একটি সিনেমার গল্প’র প্রতিটি গানের টুকরো অংশ দর্শকের মন ভরাতে পারেনি। দ্বিতীয়ত: এ ছবির পোস্টার, টিজার, ট্রেলার, এমনকি যৎসামান্য যতটুকু গান মুক্তি পেয়েছিল, তা এ সময়ের দর্শকরা সাদরে গ্রহণ করতে পারেননি। অভিযোগ ছিল গুরুতর: সবকিছুতেই কেমন যেন ‘সেকেলে’ অভিনয় ও নির্মাণের ছাপ। তবে আমি হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নই। প্রিয় নায়ক আলমগীরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থেকেই আমি প্রেক্ষাগৃহে পাড়ি জমাই মুক্তির প্রথম দিন প্রথম শো। আশা ছিল আর যাই হোক প্রেক্ষাগৃহে থাকা পুরোটা সময় আমি বিনোদিত হবো।

কিন্তু হায়! ‘একটি সিনেমার গল্প’র প্রথম দৃশ্য থেকেই আমি বুঝে গেলাম, সব আশায় গুড়ে বালি। ‘হাই ভোল্টেজ মেলো ড্রামা’র চল নেই এখন। কিন্তু ‘একটি সিনেমার গল্প’তে মেলোড্রামা বিবর্জিত দৃশ্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পরিচালক আলমগীর একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি জানিনা আমার সময়ের দর্শকরা এখন ছবি দেখেন কিনা।’ উত্তরে আমি বলতে চাই, সে সময়ের দর্শক তো বটেই, এ সময়ের দর্শকরাও ভালো ছবি মুক্তি পেলে প্রেক্ষাগৃহে ভিড় জমায়। সব বয়সের, সব শ্রেণীর দর্শক আপনাদের মত কিংবদন্তি তারকাদের শ্রদ্ধা করে। বিশ্বাস করে, আপনাদের মত মেধাবী তারকারা পর্দায় ঠকাবেন না। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, ‘একটি সিনেমার গল্প’ সেই বিশ্বাসে অনেক বেশিই চিড় ধরিয়েছে। আলমগীর পরিচালিত বাংলাদেশে মুক্তি পাওয়া সর্বশেষ চলচ্চিত্র নিমর্ম (১৯৯৬) যে সময়ে মুক্তি পেয়েছিল, সে সময় আর এ সময়ের আকাশ-পাতাল ফারাক। সারা বিশ্বেই অভিনয়ের ধারা পরিবর্তন হবার সাথে সাথে দর্শকের স্বাদ-ও পরিবর্তন হয়ে গেছে। সংলাপের ধারা পরিবর্তন হয়েছে। বলিউডের অমিতাভ বচ্চন, ঋষি কাপুর, শ্রীদেবী, হেমা মালিনীরা থেকে ওপার বাংলার প্রসেনজিতও সে পরিবর্তনের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন। তবে ‘একটি সিনেমার গল্প’র দেখে মনে হয়েছে নির্মাতা সেই ’৮০ কিংবা ’৯০-এর দশকেই আটকে আছেন। ২০১৮ সালের দর্শকের মন বুঝে চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারে তিনি যত্নশীল ছিলেন না।

এটা ঠিক পর্দার পেছনের গল্প নিয়ে নির্মিত নাটক কিংবা চলচ্চিত্র ব্যক্তিগতভাবে আমাকে খুব টানে। রঙিন আলোর পর্দা সরিয়ে বিনোদন জগতের বাসিন্দাদের সুখ-দুঃখের গল্প সঠিকভাবে দর্শকের সামনে তুলে ধরলে দর্শকও ফিরিয়ে দেন না। তাছাড়া ‘একটি সিনেমার গল্প’ চলচ্চিত্রের নামটিও খুব সুন্দর। কাহিনীকার আলমগীরের উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। একজন শিল্পী যে ব্যক্তিসত্তাকে দূরে ঠেলে সবকিছুর ঊর্ধ্বে একজন শিল্পী হয়েই আমৃত্যু বেঁচে থাকতে চায়-এটিই ছিল ‘একটি সিনেমার গল্প’র মূল বিষয়বস্তু। একজন শিল্পীর সঠিক সময়ে সেটে আসা, চরিত্রের প্রতি সততা ধরে রাখা যে কতখানি জরুরি-তা দেখাতে চেয়েছেন কাহিনীকার। এ ক্ষেত্রে তাকে আমি সাধুবাদ জানাই। তবে চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা ও পরিচালক আলমগীর আমাকে ভীষণভাবে আশাহত করেছেন।

সবকিছুতেই কেমন যেন কৃত্রিমতার ছোঁয়া। পরিচালকের (আকাশ) সুখের সংসার তার স্ত্রী’র (চম্পা) সাথে। কিন্তু তারপরও চিত্রনায়িকা কবিতা’র (ঋতুপর্ণা) বারংবার প্রেমের আহবানে খুব বেশি বাধা দেয় না পরিচালক। এ ক্ষেত্রে পরিচালক কি নিজের কাজের প্রয়োজনে তাকে ব্যবহার করেন নাকি তিনি নিজেও নায়িকার প্রতি দুর্বল-বিষয়টি স্পষ্ট হয়নি। একজন রক্ত মাংসে গড়া মানুষ দুর্বল হতেই পারেন। তবে গল্পের এই অধ্যায়ের চিত্রায়ণ আফতাব-আমিশা প্যাটেল-এষা দেউল অভিনীত ‘আনকাহি’ ছবির মত হতে পারতো। কিন্তু দর্শক এখানে বুঝতেই পারলো না, পরিচালক যদি নায়িকাকে ভালোই না বাসেন সাত বছর ধরে কেন এত প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন? নিজের ছবিতে কাস্ট করার জন্য এই বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডে কি আর কোনো নায়িকা নেই?

ছবিতে গল্পের প্রয়োজনে মদ্যপানের দৃশ্য আসতেই পারে। কিন্তু তাই বলে এ ছবিতে মদ্যপানের অতিরিক্ত ব্যবহার চোখে লেগেছে। আমার পেছনের সারির দর্শক তো স্ত্রীকে সুযোগ পেয়ে বলেই বসেছে, ‘নায়ক নায়িকারা সারাক্ষণ মদ খায় দেখছো।’ সত্যিই কি তাই? এ বিষয়টিতে পরিমিতবোধের প্রয়োজন ছিল। এ ছবির শুরু থেকে শেষ চিত্রগ্রাহক, প্রোডাকশন ম্যানেজার, লাইট বয়, স্পট বয়-অর্থাৎ ইউনিটের সবার পড়নে একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের টি শার্ট। শুটিং ঢাকায় হোক কিংবা বান্দরবান সবার পড়নে বছর জুড়ে একই পোশাক। বিষয়টি দৃষ্টিকটু লেগেছে। বিজ্ঞাপনদাতাদের পণ্যের প্রচার হতেই পারে, কিন্তু এখানে প্রচারণার ধরণ ছিল হাস্যকর। এ ছবিতে পরিচালক আকাশ নায়িকা কবিতার বাসায় যাবার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী ফোন করেন। নায়িকার হুমকির মুখে পড়ে পরিচালক খুব হালকাভাবে স্ত্রীকে জানান, ‘বাড়ি ফিরতে দেরি হবে। রাখি।’ ব্যস, এতটুকু শুনেই স্ত্রীর চোখে রাজ্যের পানি। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য! কিন্তু কেন? পরিচালক তাকে এমন কী বলেছেন, যাতে করে এত বেশি অভিব্যক্তি দেখাতে হবে? পুরো দৃশ্যটিই ছিল বেশ কৃত্রিম। চিত্রনায়ক সজীবের (আরিফিন শুভ) বাড়িজুড়ে নায়িকা কবিতার ছবি। এ বাড়িতে কি সাংবাদিক, প্রযোজক, পরিচালক কিংবা অন্য কেউ আসেন না? যদি আসেন, এতদিনে তো সজীবের কবিতার প্রতি ভালো লাগার কথা সংবাদ মাধ্যমে বেরিয়ে যাবার কথা। বিষয়টি গল্পে আসেনি।

এ ছবিতে একজন বড় ডাক্তার আছেন। কিন্তু তিনিই সব রোগীর রক্ত নেন। এত বড় ডাক্তারের কোনো সহকারী নেই? ছবির শেষাংশে সিনেমার ভেতরের গল্পে ’৭০-’৮০ দশকের সেই প্রাচীনপন্থী ফর্মূলা ‘নাচবি তো বাঁচবি’ প্রয়োগ করা হয়। আরিফিন শুভকে বেঁধে রাখার পর নায়িকা ঋতুপর্ণা গান ধরেন ‘এ নয়ন কাঁদবে না তো আর’। সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র গল্প! ২০১৮ সালে সিনেমার ভেতর সিনেমাতেও কেন এসব দেখাতে হবে? দর্শক যেখানে হাতের মুঠোয় বিশ্বের তাবৎ জনপ্রিয় ছবি দেখে নিজেদের প্রতিনিয়ত আপডেট করছে, আমরা চিত্রনাট্যকার কিংবা নির্মাতারা কেন সেখানে ২০-৩০ বছর আগে দর্শকদের বার বার টেনে নিয়ে যেতে চাইছি?

ছবির সংলাপও কৃত্রিমতা দোষে দুষ্ট। আরিফিন শুভর কণ্ঠে ‘ঐ আকাশটা দেখেছো? শত জনম চেষ্টা করেও সেখান থেকে একটি তারাও তুমি তোমার জন্য আনতে পারবে না’-এ ধরনের সংলাপ মঞ্চ নাটকেই মানায়। ২০১৮ সালের চলচ্চিত্রে নয়। বিশেষ করে শুভ’র সংলাপ বলার ভঙ্গি যাত্রাপালাকেও হার মানায়। এ ছবি জুড়েই এরকম কেতাবী সংলাপের আধিক্য দর্শকদের রীতিমত বিরক্ত করেছে। বিশেষ করে ঋতুপর্ণার সংলাপ: এখানে ক্যামেরা আছে লাইট আছে অ্যাকশন আছে কাট আছে শুধু সুখ নেই গো…। এতটুকু ঠিক ছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ঋতুপর্ণাকে রুনা লায়লার গাওয়া ‘সুখ তুমি কি বলো জানতে ইচ্ছে করে?’ খালি গলায় গাইতে দেখে তব্দা খেয়েছি। অস্ফুটস্বরে নিজেই বিড়বিড় করেছি-সবকিছু এত কৃত্রিম কেন? ঋতুপর্ণার কণ্ঠেই: শো মাস্ট গো অন বলার ভঙ্গিও ছিল বেশ কেতাবী স্টাইলে। এই সংলাপটিই গল্পের প্রয়োজনে ভিন্নভাবে আসতে পারতো। যেমন: আমার অন্তর জুড়ে আছো তুমি, আমার নিশ্বাসে তুমি, বিশ্বাসে তুমি/ এ জীবনের অঙ্কগুলো খুবই জটিল। কত সুখগুলো বিয়োগ হয়ে যায়/ জীবনটা যদি কাঠপেন্সিল দিয়ে লেখা হতো, তাহলে রাবার দিয়ে মুছে আবার নতুন করে শুরু করতাম/ ঐ দেয়ালটা আমার অন্তর, আর ছবিগুলো আমার অন্তরের অন্তর। এই সংলাপগুলো ছবি জুড়ে এমনভাবে এসেছে, মনে হয়েছে আমাদের দর্শকদের বোধ জাগ্রত করার জোর প্রচেষ্টা চলছে। এই সংলাপগুলোই খুব বাস্তবিক ভঙ্গিতে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা যেত। সহজ স্বাভাবিক অভিনয় আর নির্মাণের অনুপস্থিতি থাকায় সংলাপগুলো আরো বেশি কানে লেগেছে। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় নির্মলেন্দু গুণের ‘তোমার চোখ এত লাল কেন?’ কবিতার কথা। এত অসাধারণ একটি কবিতার এতটা কৃত্রিম উপস্থাপন মনকে পীড়া দিয়েছে। অযাচিতভাবে কবিতার সংযুক্তির কোনো প্রয়োজন ছিল না।

এ ছবির শিশুশিল্পী ‘চাঁদ’কে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চড়া মেকআপে রাঙানো হয়েছে। বিষয়টি বিরক্তিকর। বাড়িতে, গাড়িতে, স্কুলে যাবার পথে-সর্বক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় চাঁদের মুখে এত রং কেন? তাছাড়া ছবির অন্যান্য প্রায় সবার মত চাঁদের অভিনয়েও ছিল কৃত্রিমতার আধিক্য। এত বাচ্চা একজন মেয়ে কেন মা’কে বলবে: ইয়েস মাই ডিয়ার মা জননী! এসব সংলাপ পর্দায় শিশুশিল্পীদের চরিত্রের নিষ্পাপতা খর্ব করে। বিষয়টি অপ্রত্যাশিত ও দুঃখজনক। এবার আসি ছবির অন্যান্য অভিনয়শিল্পীদের কথায়:

‘একটি সিনেমার গল্প’ ছবির মূল চরিত্র দুটি: পরিচালক আকাশ (আলমগীর) এবং চিত্রনায়িকা কবিতা (ঋতুপর্ণা)। বাকিরা তাদের সমর্থন যোগাতে পার্শ্ব চরিত্র হয়েই থেকেছেন। পরিচালক আকাশ চরিত্রে বলিষ্ঠ অভিনেতা আলমগীরের অভিনয় নিয়ে বলবার কিছু নেই। তিনি সবসময় যেমনটি অভিনয় করেন, এখানেও তাই। নতুন কিছু যোগ করতে পারেননি এখানে। নতুন ব্যাপার ছিল এতটুকুই, এ ছবিতে আরিফিন শুভও সাদেক বাচ্চু এবং সাবেরী আলমকে আঙ্কেল-আন্টি বলে সম্বোধন করেন, নায়ক আলমগীরও তাই। এতটা অবিশ্বাস্য দৃশ্য আমরা না দেখলেও পারতাম। তাছাড়া ঋতুপর্ণার সাথে আলমগীরের ঘনিষ্ঠ দৃশ্যগুলোতে তার ব্যক্তিত্ব কিছুটা হলেও খর্ব হয়েছে। নায়ক আলমগীরকে ব্যক্তিগতভাবে আমি অন্তত এরকম চরিত্রে কখনো দেখতে চাই না।

ওপার বাংলার রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ‘একটি সিনেমার গল্প’ ছবির মূল নায়িকা। তার সুখ-দুঃখ, আনন্দ-কান্না নিয়েই এ ছবির গল্প আবর্তিত হয়েছে। তবে ‘কবিতা’ চরিত্রে ঋতুপর্ণা এ ছবিতে শতভাগ ব্যর্থ হয়েছেন। যে অভিনেত্রীকে আমরা সাম্প্রতিক সময়েই মেলোড্রামা অভিনয়ের ধারা ভেঙে ওপার বাংলায় ‘রাজকাহিনী’, ‘প্রাক্তন’, ‘মুক্তধারা’, ‘বেলাশেষে’ ছবিগুলোতে পর্দা কাঁপাতে দেখেছি, সেই একই অভিনেত্রীর এপার বাংলায় এমন যাত্রাপালার ঢংয়ে করা উচ্চকিত অভিনয় মেনে নেয়ার মত ছিল না। ঋতুপর্ণা যখন বলেন ‘এখন তো খাঁচার পাখি খাঁচায় ফিরে যাবেই’ কিংবা ‘এক জোনাকী দুই জোনাকী তিন জোনাকী ওড়ে, তোমার জন্য বন্ধু আমার পরাণ কেমন করে’-এর চেয়ে ভয়াবহ বিরক্তির অভিনয় আর হতে পারেনা। অবশ্য শুধু অভিনয়ই নয়, চড়া মেকআপ ও পোশাকে ঋতুপর্ণাকে একজন জনপ্রিয় নায়িকা মনে হয়নি। কষ্টের কিংবা অসুস্থ হবার পরের দৃশ্যগুলোতেও ঋতুপর্ণার উচ্চকিত সাজ ও অভিনয় বাস্তবতা থেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে রেখেছে। যে কারণে ঋতুপর্ণার চরিত্রের করুণ পরিণতিতে দর্শক এতটুকু বেদনা অনুভব করেননি। এর দায় সম্পূর্ণ চিত্রনাট্যকার ও পরিচালকের। কারণ ওপার বাংলায় যিনি এত অসাধারণ চরিত্রে নিজেকে সাম্প্রতিক সময়ে বদলে ফেলছেন, তাকে কেন আমরা ২০১৮ সালে এসে প্রাচীনপন্থী অভিনয়ের ধারায় পুনরায় নিয়ে গেলাম? ঋতুপর্ণা নিজের ব্যক্তিত্ব অনেকখানিই খুইয়েছেন তিনি এ ছবিতে অভিনয় করে। বিশেষ করে আলমগীর কিংবা আরিফিন শুভ-কারো সঙ্গেই তার রসায়ন জমেনি।

আরিফিন শুভ এ ছবির নায়ক। দ্বিতীয় নায়ক বললও ভুল হবে না। কারণ তার চরিত্রের প্রতি কোনো প্রকার ধ্যানই দেয়া হয়নি। সবার পরিবারের গল্প আছে। অথচ চিত্রনায়ক সজীবের (আরিফিন শুভ) কোনো পরিবারই নেই। সকাল থেকে রাত, শুরু থেকে শেষ পুরোটা সময় জুড়ে এ ছবিতে শুভ’র কাজ একটিই-ঋতুপর্ণার প্রেম প্রার্থী হয়ে থাকা। এ সময়ের একজন জনপ্রিয় নায়কের এত দুর্বল উপস্থাপন পীড়া দিয়েছে আমাকে। বিশেষ করে প্রায় প্রতিটি দৃশ্যে যাত্রাপালার ঢংয়ে বলা শুভ’র প্রতিটি কেতাবী স্টাইলের সংলাপ ধৈর্যচ্যুত করেছে দর্শকদের। ‘আমি দুবাই যাবো’ গানের আগে শুভর সংলাপ-‘পাসপোর্ট? টিকেট? চিঠি’ ছিল অতি অভিনয়ে দুষ্ট অসম্ভব বিরক্তির একটি দৃশ্য।

তবে সব বিরক্তির মাঝে নন্দিত অভিনেত্রী চম্পাকে দেখা ছিল এ ছবির অন্যতম ভালো লাগা দিক। ঋতুপর্ণার সাজ-পোশাক যতটা কুরুচিপূর্ণ মনে হয়েছে, চম্পার সাজ-পোশাক ঠিক ততটাই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনে হয়েছে। যদিও এত শক্তিশালী অভিনেত্রী এ ছবিতে অভিনয় করার তেমন একটা সুযোগই পাননি। যেমনটি পাননি সাবেরী আলম ও সাদেক বাচ্চু। সাবেরী আলমকে কিছু দৃশ্যে ঋতুপর্ণার চাইতেও বয়সে কম মনে হয়েছে। অথচ এ ছবিতে তিনি ঋতুপর্ণার মা, আলমগীরের আন্টি। এমন অসহনীয়, অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখেও ধৈর্য ধরে রেখেছিলাম। কিন্তু সাবেরী আলমের মত শক্তিশালী অভিনেত্রীকে এ ছবিতে এক প্রকার অবহেলিত হতে দেখে হতাশ হয়েছি। আমাদের চলচ্চিত্রে এ ধরনের অভিনয়শিল্পীকে অপব্যবহার করা মানে চলচ্চিত্রের প্রতি এ ধরনের মেধাবী অভিনয়শিল্পীদের আগ্রহের জায়গাটাকে খর্ব করা। অথচ সাবেরী আলমের মত অভিনেত্রীদের সঠিকভাবে ব্যবহার করা গেলে বাংলা চলচ্চিত্রে বেশ ক’জন মেধাবী অভিনয়শিল্পীকে পাওয়া যেত। সাদেক বাচ্চু এ ছবিতেও গড়পড়তা অন্য ছবির মতই অভিনয় করেছেন। নতুনত্ব নেই।

ওয়াহিদা মল্লিক জলি অভিনয় করেছেন গুটিকয়েক কিছু দৃশ্যে। তবে ঠান্ডায় বসে যাওয়া কণ্ঠেই তাকে এ ছবিতে ডাবিং করতে হয়েছে। এ বিষয়টিও ছিল অপ্রত্যাশিত। জলির কণ্ঠ ঠিক হবার পর ডাবিংয়ের কাজটি সেরে ফেলা যেত। সৈয়দ হাসান ইমাম সহ এ ছবিতে অতিথি চরিত্রে পরিচালক শাহ আলম কিরণ, প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরু, সম্পাদক তৌহিদ হোসেন চৌধুরী সহ আরো অনেকে আছেন। কিন্তু কারো চরিত্রেই ধার নেই। উত্তাপ ছড়াতে পারেননি কেউই।

‘একটি সিনেমার গল্প’ ছবিতে গান রয়েছে পাঁচটি। এর মধ্যে অদিতি মহসীনের গাওয়া ‘আমার পরাণ যাহা চায়’ শুনতে ভালো লাগলেও চিত্রায়ণ ছিল বেশ কৃত্রিম। আরোপিত। ‘আমি দুবাই যাবো’ কিংবা ‘এ নয়ন কাঁদবে না তো আর’ না থাকলেও ছবির গল্পে কোনো হেরফের হতো না। ‘গল্প কথার ঐ কল্পলোকে’ গানটি ছবির যে পর্যায়ে এসেছে, ততক্ষণে দর্শকের ধৈর্য্যের সব বাধ ভেঙে গেছে। তবে সব গানের মধ্যে কবির বকুলের লেখা এস আই টুটুলের সুর ও সংগীতে এস আই টুটুল ও আঁখি আলমগীরের গাওয়া ‘তুমি আছো তাই’ গানটি সেরা। বান্দরবানের নৈসর্গিক লোকেশনে চিত্রায়িত এ গানে যদিও রঙের বিন্যাস ও আলোক সম্পাত আরো ভালো হতে পারতো। তাছাড়া ছবি মুক্তির আগে এ গানটি ব্যাপকভাবে প্রচার করাও যেতে পারতো। তবে কিছুই হয়নি। যে কারণে গানটি আবহ সংগীত হিসেবে ছবি জুড়ে ব্যবহার হবার পরও বড় ধরনের কোনো জনপ্রিয়তা কিংবা সাফল্য পায়নি।

কারিগরি দিক দিয়ে ‘একটি সিনেমার গল্প’ ছিল বেশ দুর্বল। ছবির চিত্রগ্রহণ ও সম্পাদনায় ছিল না কোনো আধুনিকতার ছাপ। বিশেষ করে একটা পর্যায়ে মনে হয়েছে এ ছবির বুঝি কোনো সম্পাদক নেই। শিল্প নির্দেশনায়ও প্রাচীনপন্থী বিএফডিসি’র সেট দেখা ছিল কষ্টের অভিজ্ঞতা। ঋতুপর্ণাকে চা খাওয়াবার জন্য নায়ক শুভর বাড়িতে একটি ট্রে-ও নেই। শুভর মা ওয়াহিদা মল্লিক জলি চা বানিয়ে হাতে করেই নিয়ে আসেন। প্রোডাকশন ডিজাইন এ ছবিতে ভীষণভাবে ব্যর্থ। গ্রাফিক্স, রঙের বিন্যাস, শব্দগ্রহণ, আলোক সম্পাত, পোষাক, রূপসজ্জা, আবহ সংগীত-প্রতিটি বিভাগই ছিল ভীষণভাবে পানসে।

আমি সমালোচক নই। আমি আম জনতা। একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে নায়ক আলমগীরের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থেকে ‘একটি সিনেমার গল্প’ মুক্তির প্রথম দিন প্রথম শো সপরিবারে দেখতে গিয়েছিলাম। বাংলা ছবি প্রতি সপ্তাহেই দেখার অভ্যাস রয়েছে। কিন্তু সর্বশেষ কোন ছবি এতটা বিরক্তির উদ্রেক করেছে, মনে নেই। চাইলে মুক্তির প্রথম দিনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যমে ছবিটি নিয়ে নেতিবাচক আলোচনা লিখতে পারতাম। আমাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা দর্শকদের জানাতে পারতাম। কিন্তু জানাইনি। কারণ আমি বাংলা ছবিকে যেমন ভালোবাসি, বাংলা ছবির মানুষদেরও তেমনি অনেক বেশি ভালোবাসি।

আজ ‘একটি সিনেমার গল্প’ মুক্তির ৬ দিন পর রীতি মেনে, দর্শকের অনুরোধে একজন সাধারণ দর্শকের চোখ দিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা জানাতে বাধ্য হলাম। তবে এ ছবিকে কিংবা ছবি সংশ্লিষ্ট শিল্পী কলাকুশলীদের প্রতি বিরক্তি নয়, আমি ‘একটি সিনেমার গল্প’ ছবির দুর্বল নির্মাণ, চিত্রনাট্য ও অভিনয়ের বিপক্ষে। চিত্রনায়ক-পরিচালক আলমগীরই বলেছেন, ‘একজন চিত্র পরিচালককে সারা বিশ্বেই ‘ক্যাপ্টেন অফ দ্য শিপ’ বলা হয়। তাই একটি সিনেমার শিল্পী কলাকুশলীর হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ এবং ছবির ভালো-মন্দের সবকিছুর দায়ভার পরিচালকের হাতে’। এমন অভয় পেয়েই ভালো-মন্দের সবটুকু জানালাম।

আশা করছি নির্মাতা আলমগীর আমাদের মত দর্শকের মন্তব্যকে গুরুত্বের সাথে দেখে পরবর্তীতে সময় উপযোগী গল্প উপহার দেবেন। কারণ ‘একটি সিনেমার গল্প’ একটি হতাশার অন্য নাম হতে পারে। কিন্তু একটি স্বপ্ন কিন্তু এখনো বেঁচে আছে: ‘আমার জন্মভূমি’ দিয়ে যাত্রা করা নায়ক আলমগীর আমাদের জন্মভূমিতেই গর্ব করার মত কিছু চলচ্চিত্র সামনে উপহার দেবেন। দর্শক একবার ফিরিয়ে দিলে দশবার বুকে টেনে নেবেন। ভুলে গেলে চলবে না, সুনির্মিত চলচ্চিত্রের জন্য দর্শক বরাবরই ছিল, আছে এবং থাকবে।

*রিভিউটির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ সমকাল ১৯ এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত।

 


Leave a reply