এক ঝলক বৃহন্নলা
‘বৃহন্নলা’ চলচ্চিত্রটির কাহিনী রাজবাড়ী জেলার কোনো একটি গ্রামের সরকারি খাসজমিকে কেন্দ্র করে। পতিত ওই জমিতে একটি বটগাছ আছে। রহস্যময় গাছটির সংস্পর্শে এসে একটি ছাগল ও তিন জন মানুষ মারা যান! সে জমিতে স্থানীয় মসজিদ কমিটি মসজিদ বা ঈদগাহ বানাতে চায় এবং মন্দির কমিটি মন্দির বানাতে চায়। এ নিয়ে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, প্রেম, দ্বন্দ্ব, মৃত্যুর সমাবেশ ঘটেছে ছবিতে।
মুরাদ পারভেজ পরিচালিত ছবিটির প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হলো ১৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সে। ছবিটি সারাদেশে হলে মুক্তি পেয়েছে ১৯ সেপ্টেম্বর।
কিছু ভালো দিক : আরতি ও পুঁথিগানের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় সংস্কৃতির কিছু দিক তুলে ধরা হয়েছে বৃহন্নলায়, যা প্রশংসনীয়। এ ছাড়া সান্ধ্য পূজা ও মসজিদের দৃশ্যগুলো সিম্বলিক অর্থে ভালো হয়েছে। গানের কথাগুলো চমৎকার। মা, ছেলে ও ছেলের বউয়ের (দিলারা জামান, ইন্তেখাব দিনার, সোহানা সাবা) দৃশ্যগুলো এ ছবির প্রাণবন্ত একটি দিক। এখানে চিরায়ত অম্লমধুর সম্পর্ক ফুটে উঠেছে। রাতের দৃশ্যগুলোও চমৎকার।
গল্প : ধর্মকে আশ্রয় করে চলচ্চিত্র নির্মাণ গত দশক থেকে বেশ জনপ্রিয়। বাস্তব কারণে এগুলো ধর্মের সমালোচনামুখর। এ ছবিতে তার ছাপ আছে, তবে খানিক ব্যতিক্রম। দুটি ধর্মকে একই দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরা হয়েছে, বাংলা ছবিতে যা আগে হয়নি। এর চমৎকারিত্ব প্রশংসার যোগান দিতে পারে।
ধর্মকে কুটিলতার ছদ্মবেশে দেখিয়ে বিজ্ঞানবাদিতা ও শিক্ষামূলক হওয়ার নজির উন্নয়নমুখী সাহিত্য-চলচ্চিত্রে একবারে কম নয়। কিন্তু সে সব ছবিতে সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ধর্মের ইতিবাচক ভাবমূর্তিও হাজির থাকে।
এ ছবি ধর্মের বাইরে দাঁড়িয়ে একটা নৈতিক অবস্থান খাড়া করে। এখানে আপনি বিদ্যালয়ের জয়গান শুনবেন। মানে শিক্ষা আপনাকে মুক্তি দিবে। এ ছবির অধিকাংশ চরিত্রেরই নৈতিক দৃঢ়তা নেই, এটা হয়ত আমাদের সমাজেরই একটা প্রতিফলন। তবে হোমিও ডাক্তার আরজ আলী ব্যতিক্রম। মন্দির কমিটির সদস্য এই গ্রাম্য ডাক্তার হিন্দু-মুসলিমের ধর্মীয় রাজনীতির বাইরে উজ্জ্বলভাবে তার শিক্ষানুরাগী মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। ধর্মীয় রাজনীতির দ্বন্দ্ব নিরসনে তিনি নিজে দু’পক্ষকে সম্মত করার অক্ষমতা থেকে প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছেন। এটাও ইতিবাচক একটি দিক। তার স্বপ্ন-প্রস্তাবনা যখন চলচ্চিত্রটির শেষ দৃশ্যে বটগাছের নিচে পাঠশালার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়, তখন অবশ্য তিনি নেই। তার আগেই সধর্মের গোড়া সমর্থকের হাতে ওই গাছতলাতে আরজ আলীর মৃত্যু হয়।
অন্যভাবে বললে মানব চরিত্রের নৈতিক দিকটি অনেকাংশে এখানে অনুপস্থিত। যেমন- প্রোটাগনিস্ট ফেরদৌস প্রশ্নহীনভাবে এক বিবাহিত নারীর প্রেমের ডাকে সাড়া দেন। কিন্ত কেন দেন ? সে প্রশ্নের উত্তর জানতেও দেখতে পারেন বৃহন্নলা।
অভিনয় : চরিত্র অনুযায়ী সবার অভিনয় মোটামুটি ভালো।
সংগীত : আবহ সংগীত চলনসই। ছবিতে বেশ কয়েকটি মিষ্টি গান রয়েছে।
ভালো লাগবে বৃহন্নলা : একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবই মুরাদ পারভেজ পেয়েছেন। কিন্তু সেই প্রাপ্তিটার বিলম্ব বৃহন্নলার ছন্দে কিছুটা শ্লথ গতি এনে দিয়েছে বলে মনে হতে পারে। প্রিমিয়ার অনুষ্ঠানে মুরাদ পারভেজের সূচনা বক্তব্যে এর আঁচ পাওয়া যায়। কিন্তু একটু মনোযোগী হলে বোঝা যাবে শ্লথ গতিতে প্রাণ সঞ্চারী কিছু চরিত্রাভিনেতা তাদের অভিনয় গুণে বৃহন্নলার (না পুরুষ; না নারী) আবহ আচ্ছন্ন করে রাখে সবাইকে। বিশেষত আজাদ আবুল কালাম, ইন্তেখাব দিনারের কথা বলতেই হয়।
কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনা: মুরাদ পারভেজ
অভিনয়: ফেরদৌস, ইন্তেখাব দিনার, সোহানা সাবা, আজাদ আবুল কালাম, মানস বন্দ্যোপাধ্যায়, দিলারা জামান, ঝুনা চৌধুরী, কে এস ফিরোজ, ইনামুল হক, এস এম মহসীন, শাহানা সুমী প্রমুখ।
ক্যামেরা : জেডএইচ মিন্টু
সংগীত : ইমন সাহা
প্রযোজনা : ফিল্ম হকার ও এটিএন বাংলা (২০১০-১১ অর্থবছরে সরকারি অনুদান প্রাপ্ত)
আমার দেখা এ বছরের সেরা সিনেমা।