এখন যে কাহিনি পত্রিকায় দেখি ১৭ বছর আগে বলেছিলেন কাজী হায়াৎ
২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল। সেই সময়কার বহু সমালোচিত ও আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্য থেকে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের তথাকথিত বস্তাপচা সিনেমার পরিচালক কাজী হায়াত একটি সাহসী চলচ্চিত্র নির্মান করে ফেলবেন তা কেউই ভাবেনি। শুধু তাই নয় সিনেমার শুরুতেই কাজী স্পস্ট করে গল্পের প্রেক্ষাপট বলে দিয়েছিলেন অর্থাৎ সিনেমার গল্পে যা কিছু দেখানো হয়েছে তা হলো আওামীলীগের সেই সময়কার শাসনকালের চিত্র। এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয় তা হলো কাজী হায়াত এর আগে ‘ত্রাস’ চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করেছেন ‘১৯৮৭-১৯৯০’ পর্যন্ত। অর্থাৎ সেখানেও তিনি স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনকালের শেষ সময়কাল তিনি সাহসিকতার সাথে সিনেমার পর্দায় তুলে ধরেছিলেন।
নায়ক মান্না ও পরিচালক কাজী হায়াত জুটি ছিলেন আমার মতো সেই সময়কার সিনেমা দর্শকদের প্রিয় এক জুটি। এই জুটির কাছ থেকে পেয়েছিলাম ‘যন্ত্রণা’, ‘দাঙ্গা’, ‘ত্রাস’,’ দেশদ্রোহী’, ‘লুটতরাজ’, ‘তেজী’, ‘ধর’ , ‘আম্মাজান’ এর মতো অসাধারন সব চলচ্চিত্র। সেই মান্নাকে ছাড়া কাজী হায়াত রাজনৈতিক বক্তব্যধর্মী সিনেমা নির্মাণ করবেন সেটা জেনে খুব দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম । কারণ মান্নাকে ছাড়া কাজী হায়াতের সিনেমাগুলো লাগে নিষ্প্রাণ। রাজনৈতিক বক্তব্যনির্ভর সিনেমায় কাজী হায়াত -মান্না জুটির ধারেকাছে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের আর কোন পরিচালক ও শিল্পী জুটি নেই এবং ভবিষ্যতে আসবেও না। ‘ইতিহাস‘ সিনেমা মুক্তির আগেই জেনেছিলাম এবার কাজী হায়াত মান্নার বদলে তার পুত্রকে মুল চরিত্রে রেখে সিনেমাটি নির্মান করেছেন। সত্যি কথা বলতে সিনেমাটি দেখার আগ্রহ আমার মতো অনেকেই হারিয়ে ফেলেছিলো ।
যাই হোক সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পরপরেই সিলেটের মনিকা সিনেমা হলে প্রথম দিন থেকেই প্রদর্শিত হয়। আমাদের কলেজের অর্থনীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অনার্সের শেষ বর্ষের বন্ধুদের কজন ১ম দিন সিনেমাটি দেখে এসেছিলো । আমরা সেদিন দেখেছিলাম রুবেলের একটি সিনেমা। ইতিহাস যারা দেখে এসেছিলো তাদের মুখে শুধুই ইতিহাস সিনেমার প্রশংসা ও গল্প সেখানে আমরা রুবেলের সিনেমার গল্প শোনানোর সুযোগই পেলাম না। পরেরদিন কলেজে গিয়েই আগের ইতিহাস দেখা বন্ধুরা সহ অদেখা আমরাও দেখার আগ্রহ নিয়ে মনিকায় মর্নিং শো দেখতে গেলাম । সিনেমা হলের সামনে উপস্থিত হবার পর চোখ ছানাবড়া!!!!! চারিদিকে অশ্লীল সিনেমার দাপটে যেখানে দর্শক কমছে সেখানে ইতিহাস সিনেমা দেখার জন্য দর্শকদের ঢল ঠিক যেন কয়েক বছর আগের পুরোনো চিত্র। এমন দর্শক সর্বশেষ দেখেছিলাম কাজী হায়াত মান্নার ‘আম্মাজান’ সিনেমায়।
ইতিহাস চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপটে কাজী স্পস্ট করে ” ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০১” সাল পর্যন্ত তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের শাসনকালকে বুঝিয়েছিলেন । মারুফকে দিয়ে প্রথমে ২০০০ সালের শেষ দিকে আওয়ামীলিগের আমলে ঘটে যাওয়া ছিনতাইকারিদের হাতে এক সচিবের নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে তৈরি করা গল্প ‘ইতিহাস’ । কাজী হায়াত দেশ সেরা একজন সাংবাদিক যিনি সাহসী সাংবাদিকতার জন্য সবার কাছে সুপরিচিত ও প্রশংসিত। কাজী হায়াতের দুই সন্তান মৌসুমী ও মারুফ। মৌসুমি বড় মারুফ ছোট। মারুফ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ও লেভেলের ছাত্র। একই স্কুলের সহপাঠি রত্নার সাথে মারুফের ভালো বন্ধুত্ব। দুজন দুজনকে ভালোবাসে। দুজনে ভবিষ্যতে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমানোর পরিকল্পনা করে। একদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে রাস্তা থেকে মারুফকে কজন পুলিশ গ্রেফতার করে। মারুফ জানে না কি তার অপরাধ। খবর পেয়ে থানায় ছুটে যায় কাজী হায়াৎ ও মৌসুমী। মারুফের পরিচয় জানার পর থানার অসৎ ওসি নাজমুল হোসাইন নিজেকে বাঁচানোর জন্য মারুফের স্কুল ব্যাগে ফেন্সিডিল রেখে কাজী হায়াতের সামনে মারুফকে মাদকাসক্ত ও মাদক ব্যবসায়ী বলে মিথ্যা অভিযোগ করে যেন অন্যায়ভাবে পুলিশ মারুফকে গ্রেফতার করেছে সেই ব্যাপারে কাজি হায়াত পত্রিকায় কিছু না লিখেন।
মারুফ মুক্তি পেয়ে বাড়ী এলে পিতা পুত্রের মান অভিমান হয়। মারুফ জানায় যে পুলিশ থানায় নেয়ার পর মারুফের পরিচয় জানার পর তাঁকে ফাঁসানোর জন্য ফেন্সিডিলখোর হিসেবে ফাঁসিয়ে দেয় । মারুফ মনে করে কাজী হায়াতের সাহসী সাংবাদিকতার কারনেই মারুফের উপর পুলিশের এই অত্যাচার। আসলে তা নয়, পুলিশ সেদিন মারুফকে গ্রেফতার করেছিলো ভোরবেলায় কমলাপুর স্টেশন থেকে বাড়ি ফেরার পথে একজন সচিবকে ছিনতাইকারীরা ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে । উপর মহলের চাপের মুখে আসামী ধরতে গিয়ে মারুফকে সেদিন পুলিশ গ্রেফতার করে নিজের পিঠ বাঁচানোর জন্য।
মৌসুমী কাজি হায়াতের সাথে পরামর্শ করে মারুফকে দেশের বাহিরে পড়াশুনার জন্য পাঠানোর সব ব্যবস্থা করে । মারুফ যখন সবাইকে ছেড়ে বিদেশের ফ্লাইট ধরতে এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হবে তখনই আবার সেই অসৎ পুলিশ অফিসার নাজমুল হোসাইনের হানা। আবারও আরেকটি ঘটনায় মারুফকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এরপর শুরু হয় অন্য একটি গল্প যা দেখার জন্য আপনাকে অবশ্যই ইতিহাস সিনেমাটা একবার হলেও দেখতে হবে । একবার দেখার পর আবারও দেখার জন্য মন চাইবে। কারণ ইতিহাসের গল্পটা যে এই দেশের এই সমাজের এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার বড় ভয়াবহ এক চিত্র আপনার সামনে তুলে ধরবে । ‘ইতিহাস’ সিনেমার গল্পটা আপনাকে ভাবাবে। আজ থেকে ১৭ বছর আগের প্রেক্ষাপট আর আজকের প্রেক্ষাপট কি বদলেছে নাকি আরও ভয়াবহভাবে বেড়েছে সেটা আপনার মনে প্রশ্ন জাগাবে।
ইতিহাস সিনেমায় মারুফকে প্রথম গ্রেফতার করার ঘটনাটি সম্পর্কে পুলিশ যা বলেছিলো সেটা ছিলো ২০০১ সালের জানুয়ারী মাসে ঢাকায় ভোরবেলা নিজ বাসায় ফেরার পথে সচিব নিকুঞ্জ বিহারীকে হত্যার ঘটনা যা সেসময় পত্রপত্রিকায় খুব আলোচিত একটা ইস্যু ছিলো । ইতিহাস সিনেমার মুল চরিত্র মারুফ টিএনএজ হয়েও ভালো অভিনয় করেছে । মারুফের অভিনয় দেখে দর্শকরা কেঁদেছিলো সত্যি কিন্তু মারুফের দুর্বলতা ছিলো পুরো সিনেমায় অভিনয়ে মান্নাকে অনুকরনের প্রবণতা। সংলাপ বলার ধরন , অঙ্গভঙ্গি সবকিছুতেই ছিলো মান্নাকে অনুকরণের ছাপ । সবকিছু উৎড়ে গেছে শুধুমাত্র সিনেমার গল্প, চিত্রনাট্য ও নির্মানের কারনে। অন্য কোন গল্প হলে মারুফ প্রথম সিনেমাতেই ফ্লপ হতেন নিশ্চিত। সিনেমায় বড় বোনের চরিত্রে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মৌসুমী দারুন অভিনয় করেছিলেন ।
মৌসুমি যখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে তখন মারুফের বড় বোনের চরিত্রে পার্শে চরিত্রে চ্যালাঞ্জিং অভিনয় করে সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছেন। কারণ সিনেমায় এই প্রথম দর্শক পুরোটা সময় মৌসুমীকে নায়কবিহীন দেখেছিলো। ডিপজল, কাবিলা ও মিজু আহমেদ এই তিনজন সিনেমার গল্পে নতুন এক মাত্রা এনেছিলেন তাদের নিজ নিজ চরিত্রের কারনে এবং তিনজনেই যার যার চরিত্রে দারুন অভিনয় করেছিলেন । ইতিহাস সিনেমায় গল্পটিই এতো শক্তিশালী যে সিনেমায় কোন গান না থাকলেও কিছু হতো না। তবুও সিনেমার প্রয়োজনে যে কয়টি গান ছিলো সেগুলোর অধিকাংশ দারুন ও শ্রুতিমধুর হলেও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে ও কুমার বিশ্বজিতের কণ্ঠে ‘ আমি জীবন্ত একটা লাশ / এটা নতুন ইতিহাস” গানটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো।
সম্প্রতি পত্রিকায় পুলিশের আসামি বাণিজ্য ও দুর্নীতির যে খবর দেখতে পান , চারিদিকে পুলিশ বাহিনীকে নিয়ে এতো এতো সমালোচনা দেখতে শুনতে পান তার সব আমরা দেখে এসেছি আজ থেকে ১৭ বছর আগের ‘ইতিহাস’ সিনেমায় । ”ইতিহাস” হচ্ছে সেই চলচ্চিত্র যেখানে সর্বপ্রথম দেখানো হয়েছিলো কিভাবে দুর্নীতিবাজ পুলিশ নিরপরাধ স্কুল ছাত্রকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে স্কুল ব্যাগের ভেতর ফেন্সিডিল রেখে ছাত্রটিকে মাদকসেবি সাজিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে একটি পরিবারের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দেয় । ইতিহাস চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছিলো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতা , এমপি , মন্ত্রী, সন্ত্রাসিদের গডফাদার, পুলিশ সবার খুটির জোর এক ভন্ডপীর বা ”দরবেশ বাবা” র হাতে । ১৭ বছর আগেও ক্ষমতাসীন শক্তিধর ‘দরবেশ বাবা’ ছিলো আজও আছে এটাই নির্মম সত্য। এই দরবেশ বাবাদের হাত থেকে আমাদের রেহাই নেই ।।