এফডিসির দৈন্যদশা কাটছে না
চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা এফডিসির আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল গত বছরের জুনে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে সিকিভাগ কাজও শেষ হয়নি। এখন আবার ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত সময় বৃদ্ধির আবেদন জানিয়েছে এফডিসি কর্তৃপক্ষ। কয়েকজন সাবেক এমডি বলছেন অদূরদর্শিতা ও দুর্নীতির কারণেই দৈন্যদশা কাটছে না এফডিসির। এসব নিয়েই আলাউদ্দিন মাজিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনে একটি প্রতিবেদন লিখেছেন। বাংলা মুভি ডেটাবেজ (বিএমডিবি)-র পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটি হুবহু তুলে ধরা হল।
এফডিসির বয়স এখন প্রায় ৫৭ বছর। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বদল হয়েছে ৩৩ বার। কিন্তু সংস্থাটির ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। কাটেনি দৈন্যদশা। ফ্লোর, মেকআপ রুম, কালার ল্যাব, প্রশাসনিক ভবনসহ পুরো সংস্থাটিই এখন শ্রীহীন ও সংস্কারবিহীন অবস্থায় পড়ে আছে। লাগামহীন দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে প্রশাসনের বিরুদ্ধে। এফডিসির আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পটি নানা অনিয়মের কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। তাই চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রতিনিয়ত বেগ পেতে হচ্ছে চলচ্চিত্রকারদের। সাবেক একজন এমডি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এফডিসির উন্নয়নে নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও ঘন ঘন এমডি বদল, অযোগ্য-দুর্নীতিবাজ ও জ্ঞানগরিমাহীন ব্যক্তিদের বার বার এই পদে নিয়োগ দেওয়ায় সংস্থাটি দিনে দিনে অচল হয়ে পড়ছে। প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগে এমডির পছন্দের অযোগ্য লোকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এতে লুটপাট ও স্বেচ্চাচারিতা চলে অবাধে। নিজেদের অপকীর্তি ঢাকতে যোগ্য ও নীতিবান লোকদের ডিমোশন দিয়ে কর্মহীন করে রাখারও নজির রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক আরেক এমডি বলেন, ম. হামিদ ও পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় এমডি থাকাকালে অপূরণীয় ক্ষতির মুখে পড়েছে সংস্থাটি। কারণ ম. হামিদ দায়িত্বকালে ২০১১ সালে একনেকের বৈঠকে ‘এফডিসির আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প’ বিলটি পাস হয়। এই প্রকল্প পরিকল্পনাটি মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছিল নব্বই দশকের প্রথম ভাগে। তখন এনালগ প্রযুক্তির যুগ ছিল। তাই প্রায় ৫৯ কোটি টাকার যে ব্যয়ের উল্লেখ ছিল তা দিয়ে ডিজিটাল এফডিসি গড়া সম্ভব নয়। তা জানা সত্ত্বেও ম. হামিদ নতুন ব্যয় নির্ধারণ করে বাজেট জমা দেননি। স্বীয় স্বার্থে তাড়াহুড়া করে টাকা আদায় করতে গিয়ে প্রকল্পটিকে মূল্যহীন এবং টাকা নিয়ে দুর্নীতি করার সুযোগ করে দিয়েছেন। ম. হামিদের পরে এমডি হয়ে আসেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। তার আমলে টেন্ডার জটিলতায় ও বিভিন্ন অনিয়মের কারণে বার বার প্রকল্পের টাকা সরকারের কাছে ফেরত গেছে। প্রকৌশলী না হয়েও বিদেশে যন্ত্রপাতি ক্রয় করতে গিয়েছেন তিনি। এতে অর্থের অপব্যয় এবং আত্দসাৎ ছাড়া আর কিছুই হয়নি। যে কারণে নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয়নি প্রকল্পের কাজ।
গত বছরের এপ্রিলে এফডিসিতে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব হারুন-অর-রশিদ। তার যোগদানের পর তিনটি নতুন ক্যামেরা আনা হলেও ডিজিটাল এডিটিং মেশিন ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এখনো আসেনি। চলচ্চিত্রকাররা এফডিসিকে এখন গোডাউন বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সংস্থাটির উন্নয়নে সরকার কিংবা প্রশাসনের কোনো মাথাব্যথা নেই। এই অভিযোগ চলচ্চিত্রকারদের।
চলচ্চিত্রকারদের কথায় একসঙ্গে একাধিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এফডিসির উন্নয়নে পুরোপুরি মনোযোগ দেওয়া এই এমডির পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।ভারপ্রাপ্ত এমডি হারুন-অর-রশিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি এফডিসিকে আধুনিক রূপ দিতে। তাই দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনটি ক্যামেরা আমদানি করিয়েছি। অন্য কাজ সম্পন্ন করতে সময় দরকার। তাই ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত সময় বৃদ্ধির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছি। তিন মাসের মধ্যে এডিটিং বিভাগের যন্ত্রপাতি এসে পৌঁছবে। আরও ছয়টি ক্যামেরা ও লাইট আমদানির জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। শুটিং ফ্লোর মেরামতের কাজ শীঘ্রই শুরু হবে। দুটি ফ্লোর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা হবে। ফ্লোর, মেকআপ রুম থেকে শুরু করে সবকিছুই আধুনিক করে গড়ে তোলা হবে। এ জন্য কনসালটেন্ট নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। আশা করছি জুনের মধ্যে এই কাজ শেষ করতে পারব। দায়িত্ব গ্রহণ করে এফডিসিকে আবর্জনামুক্ত করতে পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করেছি। আমি চাই এফডিসিকে উন্নত সেবাদানের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তুলতে। যাতে চলচ্চিত্রকাররা ওয়ানস্টপ সেবা পায় তার জন্য শক্তিশালী টিম গঠন করব। এ জন্য চলচ্চিত্রকারদের সহযোগিতা আমার একান্ত প্রয়োজন। সবাইকে নিয়ে এফডিসিকে সমৃদ্ধ করাই আমার লক্ষ্য।
২০১১ সালের ১৮ অক্টোবর একনেকের বৈঠকে এফডিসির আধুনিকায়ন সম্প্রসারণ প্রকল্প প্রস্তাব পাস হয়। এতে ব্যয় ধরা হয় ৫৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা। তিন অর্থবছরে তিন কিস্তিতে অর্থাৎ ২০১৪ সালের জুন মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এদিকে প্রশাসনের সীমাহীন দুর্নীতি, কর্মচারীদের চার মাসের ওভার টাইমের টাকা না দেওয়া, বেতন দেরিতে দেওয়া, এফডিসির আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতি ও কাজের ধীরগতি, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের দৌরাত্দ্য এবং অনৈতিক কাজ বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদির প্রতিবাদে সম্প্রতি এফডিসিতে চলচ্চিত্র কলাকুশলী ও শ্রমিকলীগ প্রতিবাদ সমাবেশ এবং বিক্ষোভ মিছিল করে। লীগের সভাপতি মশিউল বলেন, প্রশাসনের লাগামহীন দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতায় এফডিসি এখন স্থবির হয়ে পড়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সংস্থাটির ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অচিরেই এসব অনিয়ম দূর করা না হলে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
প্রকল্পের পরিচালক লক্ষণ চন্দ্র দেবনাথ বলেন, আসলে আমাদের এস্টিমেটের সঙ্গে টেন্ডার ড্রপকারীদের ভেল্যুর তারতম্য থাকায় সমস্যা হচ্ছে। তিনি জানান, শীঘ্রই কালার কারেকশন ও এডিটিং প্যানেল আমদানির জন্য এলসি খোলা হবে। প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
২০০৪ সালে ডিজিটাল কমপ্লেক্স স্থাপনের জন্য সরকার ২১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু সেই অর্থ লুটপাটের কারণে ডিজিটাল কমপ্লেক্সটি আর আলোর মুখ দেখেনি। একটি সাব টাইটেল মেশিন থাকলেও সেটি অকেজো। ছয় বছর আগে কোটি টাকা ব্যয়ে ডিটিএস মেশিন কেনা হলেও ত্রুটিপূর্ণ থাকায় তা সচল হয়নি। একই সময়ে কেনা ডিজিটাল এডিটিং মেশিনগুলোও অচল। কালার ল্যাবের মেশিনগুলো পুরনো হওয়ায় প্রায় সময় বিকল হয়ে যায়। যন্ত্রাংশ স্থানীয় বাজারে না থাকায় টেন্ডার আহ্বান করে বিদেশ থেকে আমদানি করতে গিয়ে অতিরিক্ত সময় লাগে। এফডিসির স্টোর ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ায় সেখানে নষ্ট হয়ে গেছে কালজয়ী চলচ্চিত্রের সব নেগেটিভ ও প্রিন্ট। ঝরনা স্পটের ঝরনা অকেজো। সুইমিংপুল ময়লা আবর্জনায় ভর্তি। এফডিসির পুরো আঙ্গিনাজুড়ে শুধুই আবর্জনার স্তূপ। যত্রতত্র পোস্টার লাগানো এবং চুনকাম না করায় শ্রীহীন অবস্থায় রয়েছে সংস্থার ভবন ও বাউন্ডারি দেয়ালগুলো। নয়টির মধ্যে চালু সাতটি শুটিং ফ্লোরের অবস্থাও জরাজীর্ণ। প্রায় সময় ফ্লোরের ফলস সিলিং ও আস্তরণ খসে পড়ে আহত হন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। মেকআপ রুমগুলোও অপরিচ্ছন্ন এবং এ সংলগ্ন টয়লেটগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করায় দুর্গন্ধে শিল্পীদের এখানে বসতে কষ্ট হয়। এ ছাড়া ৫৭ বছর বয়সী এ সংস্থাটির ভবনগুলো পুরনো হওয়ায় এগুলো ধসে পড়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এফডিসির প্রবেশদ্বারেই রয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাস্কর্য। এটি চরম অবহেলায় নোংরা আবর্জনার মধ্যে পড়ে আছে। জহির রায়হান কালার ল্যাবটি কেমিক্যালের বিরূপ প্রভাবে এর দেয়াল ও ছাদের আস্তরণ খসে পড়ছে এবং ভবনটি ধসের মুখে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কজন চলচ্চিত্রকার বলেন, অত্যাবশ্যকীয় লোকের পরিবর্তে বহিরাগতদের দখলে রয়েছে এফডিসি। ঝরনা স্পট, কড়ইতলা, আমতলাসহ আনাচে-কানাচে অবাধে চলে অসামাজিক কর্মকাণ্ড। এক্সট্রা নারী শিল্পীর নামে অহরহ এখানে আনা হয় পতিতা। তা ছাড়া মাদকসেবনেরও আসর বসে প্রতিনিয়ত। অথচ সংস্থার প্রবেশদ্বারেই রয়েছে পুলিশ চৌকি এবং প্রায় ৩০ জন প্রহরী। চলচ্চিত্রকারদের অভিযোগ, পাস নিয়ে প্রবেশের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এখন তার বালাই নেই। মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে মানুষ এবং গাড়ি চেকের ব্যবস্থাও নেই। তাই ইচ্ছা করলেই বাইরের লোকজন সহজেই এখানে প্রবেশ করতে পারে।
চলচ্চিত্রকারদের কথায়, এখানে কোনো প্রশাসন আছে বলে মনে হয় না। প্রশাসনের নামে চলে দলবাজি আর গ্রুপিং। তাই প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড সবসময়ই স্থবির। মানে কেপিআইভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও এফডিসির উন্নয়ন নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে সংস্থাটি।