Select Page

ওয়াসিম কি শুধুই পোশাকি ছবির নায়ক?

ওয়াসিম কি শুধুই পোশাকি ছবির নায়ক?

সদ্য প্রয়াত ওয়াসিম সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, ঢালিউডের নায়কদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুপারহিট সিনেমা উপহার দিয়েছেন তিনি। সে হিসেবে তার মূল্যায়ন হয়নি। এমনকি সহকর্মীদের অনেকে অভিযোগ, ওয়াসিমকে ‘পোশাকি ছবি’র নায়কের অভিধায় সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। এতে তার অবমূল্যায়ন হয়েছে।

সোহেল রানার চোখে, ঢাকাই সিনেমার একমাত্র সুপারস্টার ওয়াসিম। তাকে বিশেষ তকমা লাগিয়ে ‘সাইডলাইনে’ রাখা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘ওয়াসিমকে অকারণেই কস্টিউম ছবির হিরোর একটা ট্যাগ দিয়ে অভিনয়ের লাইন থেকে কিছুটা দূরে রাখার প্রচেষ্টা করা হয়। মজার কথা হচ্ছে, আমাদের দেশে লুঙ্গি, গামছা পরে রিকশাওয়ালার চরিত্রে অভিনয় করলে মনে করি চরিত্রের সাথে মিশে গেছে। বলি ভালো অভিনয় করেছে। তো রাজার ভূমিকায় কেউ যদি অভিনয় করে সেটা যদি সত্যিকারের অর্থে রাজার মতোই মনে হয় তাহলে কি সে ভালো অভিনেতা নয়? এটা আমার প্রশ্ন সবার কাছে। এমনটা একমাত্র বাংলাদেশেই হয়। পৃথিবীর আর কোথাও হয় না।’

‘কিন্তু ওয়াসিম খুব দুর্দান্ত শিল্পী ছিল। ও বাংলাদেশে এমন একজন হিরো যার কোনো ছবি ফ্লপ করেনি। আমার চোখে ওই একমাত্র সুপারস্টার। কিন্তু ওকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় নি। যারা তাকে একটা তকমা লাগিয়ে বিশেষ সাইডের মধ্যে রেখে কখনও পুরস্কারের জন্য চিন্তা ভাবনা করেনি তারা অথর্ব, মূর্খ, তারা অভিনয় সম্পর্কে কিছু জানে না।’

একই ধরনের মন্তব্য বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ছবির নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনেরও। তার মতে, পোশাকি হিরো তকমা দিয়ে ওয়াসিমকে আন্ডাররেটেড করে রাখা হয়েছে। ইন্ডাস্ট্রি সব সময় চায় শিল্পীকে টাইপ করে ফেলতে।

ঢালিউডের প্রথম সুপারস্টার হিসেবে খ্যাত ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘আমি একজন নায়ক হয়ে বলছি, এ দেশে সবচেয়ে হিট ছবির নায়ক ওয়াসিম। কিন্তু সমস্যা হয়ে গিয়েছিল, তার সিংহভাগ ছবিই ছিল ফোক ফ্যান্টাসিভিত্তিক পোশাকি ছবি। তাই তার অবদান কিংবা অভিনয় দক্ষতা সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। এই অভিমান হয়তো তার ছিল। তাকে একবারও জাতীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু এটা তার প্রাপ্য ছিল।’

‘তাদের দেখে সত্যি আমি শিক্ষা নিয়েছি। আমি যখন সিনেমায় আসি তখন রাজ্জাক, আলমগীর, সোহেল রানা, ফারুক, ওয়াসিম, জসিম, উজ্জ্বলসহ ১২ জন প্রথম সারির নায়ককে পেয়েছি। তখন চিন্তা করলাম, আমি কোন পথে হাঁটব? ভেবে দেখলাম, আমি যদি পোশাকি ছবি করি তাহলে ওয়াসিম ভাইয়ের ধারেকাছেও ভিড়তে পারব না। যদি গ্রামীণ ছবি করি তাহলে আমার বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ফারুক ভাই। অ্যাকশন ছবিতে সোহেল রানা। কিন্তু সবার মধ্যে সেরা রাজ্জাক ভাই। তিনি সব ধরনের ছবিই করেন। তাই আমিও সব ধরনের ছবি করতে লাগলাম। সেই ফর্মুলাই আমাকে এক সময় ঢালিউডের শীর্ষ নায়কে পরিণত করল। এজন্য অনেক ছবি ফিরিয়ে দিয়েছি। মনে আছে, নসিব ছবিতে পুলিশ অফিসার চরিত্র করার পর যখন সুপারহিট হলো, আমার কাছে এক ডজন পুলিশ অফিসারের চরিত্র এলো। কিন্তু একটাও করিনি। কারণ পর পর একই ধাঁচের ছবি করতে চাইনি। আবার ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’র মতো সর্বাধিক ব্যবসাসফল ছবি করার পরও আর ফোক ফ্যান্টাসি ছবি করিনি। ওয়াসিম ভাই হয়তো সেটা বুঝতে পারেননি। তাই তাকে পোশাকি হিরো তকমা দিয়েই আন্ডাররেটেড করে রাখা হয়। ইন্ডাস্ট্রি সব সময় চায় শিল্পীকে টাইপ করে ফেলতে।’

ওয়াসিমও চাননি পোশাকি ছবির নায়কের তকমাটা। এ প্রসঙ্গে রোজিনা বলেন, ‘তিনি মি. ইস্ট পাকিস্তানের খেতাব জয় করেছিলেন বডি বিল্ডিংয়ে। আজকে যারা ইন্ডিয়ান হিরো সালমান খান বা অন্যদের বডি নিয়ে এত উৎসাহী তারা ওয়াসিমের ফিগার দেখেছে? যেমন ফিগার, তেমনি গায়ের রং, লম্বা-চওড়া, আর মেধাবী অভিনয়। কিন্তু সেগুলো কোনোদিন আলোচনাতেই আসল না। যারা নিজেদের সিনেমাবোদ্ধা মনে করে, তারা ওয়াসিম ভাইকে পোশাকি ছবির থাপ্পা লাগিয়ে দিল। এই দুঃখবোধ তার আজীবন ছিল।’

এ দিকে সফলতার পরও একবুক কষ্ট নিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন এই নন্দিত নায়ক।

ওয়াসিমের একমাত্র ছেলে ফারদিন বলেন, ‘আমার বাবা এতগুলো ব্যবসাসফল সিনেমা উপহার দিয়েছেন। কিন্তু তাকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার নাম থেকে বাদ দেওয়া হয়। ১৯৭৯ সালে এই ক্যাটাগরিতে কাউকেই পুরস্কার দেওয়া হয়নি। বাবা এই পুরস্কারটা পেলে মনে শান্তি পেতেন। এই কষ্টটা নিয়ে বাবা চলে গেছেন।’

মোহসিন পরিচালিত ‘রাতের পর দিন’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্রথম নায়ক হিসেবে রূপালি পর্দায় আসেন নায়ক ওয়াসিম। সিনেমাটি ব্যবসাসফল হলে সুপারস্টার হয়ে উঠেন তিনি। এরপর ১৯৭৬ সালে মুক্তি পাওয়া এস এম শফী পরিচালিত ‘দি রেইন’ সিনেমা তাকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়।

১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্রে শীর্ষ নায়কদের একজন ছিলেন তিনি। অভিনয় জীবনে ১৫২টির মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন।

তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলো হলো- দ্য রেইন, ডাকু মনসুর, জিঘাংসা, কে আসল কে নকল, বাহাদুর, দোস্ত দুশমন, মানসী, দুই রাজকুমার, সওদাগর, নরম গরম, ইমান, রাতের পর দিন, আসামি হাজির, মিস লোলিতা, রাজ দুলারী, চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা, লুটেরা, লাল মেম সাহেব, বেদ্বীন, জীবন সাথী, রাজনন্দিনী, রাজমহল, বিনি সুতার মালা, বানজারান।

তিনি অলিভিয়া, অঞ্জু ঘোষ ও শাবানার সঙ্গে বেশি সংখ্যক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। ‘দি রেইন’ সিনেমায় নায়িকা ছিলেন অলিভিয়া। এরপর ‘বাহাদুর’, ‘লুটেরা’, ‘লাল মেম সাহেব’, ‘বেদ্বীন’ সিনেমায় অলিভিয়ার সঙ্গে অভিনয় করেন। ‘রাজ দুলালী’ ছবিতে শাবানার সঙ্গে অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছিলে। অঞ্জু ঘোষের সঙ্গে অভিনয় করেছেন- ‘সওদাগর’, ‘নরম গরম’, ‘আবেহায়াত’, ‘চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা’, ‘পদ্মাবতী’সহ বেশকিছু সিনেমায়।


Leave a reply