কমপ্লিকেটেড ‘রেহানা মরিয়ম নূর’
এ মুহূর্তে দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির গুরুত্বপূর্ণ ছবি ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ (২০২১)। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের মূল পর্ব ‘আ সার্তে রিগা’তে অফিসিয়াল সিলেকশনে প্রদর্শনের পর এবার নিজ দেশে মুক্তি পেল। ইতোমধ্যে ‘এশিয়া প্যাসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ড’-এ পুরস্কৃত হয়েছে এবং অস্কারের জন্য বাংলাদেশ থেকে মনোনীত হয়েছে। ছবির পরিচালনায় আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ, তাঁর এর আগের ছবি ছিল ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’।
ছবির নাম ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ একটা আকর্ষণীয় নামে পরিণত হয়েছে। শুনতে অন্যরকম লাগে। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রকে ঘিরে নামকরণ হয়েছে।
অনবরত কড়া নাড়া হচ্ছে দরজায়, বাঁধন সামনে পেছনে কাউকে খুঁজছে, তাকে থামানোর চেষ্টা করছে ক্ষমতাবান কেউ কিন্তু সে থামছে না। প্রতিবাদী হয়ে অগ্নিরূপ ধারণ করছে। মেডিকেল কলেজের সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের গল্পের একটা আভাস দিয়েই ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ছবির গল্প এগিয়েছে। গল্পের সাথে কেন্দ্রীয় চরিত্রের যে যোগসাজশ তাতে পুরো ছবিটি হয়ে উঠেছে কমপ্লিকেটেড। দর্শক প্রথম থেকে শেষ অব্দি দেখার পর প্রশ্ন রেখে যাবে কেন চরিত্রটি এমন, কেন শেষটা এমন, কেন মাঝখানটায় এমন। আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ দ্বান্দ্বিক একটা ট্রিটমেন্ট তাঁর পরিচালনায় রেখে যান পুরো ছবিতে।
কেন্দ্রীয় চরিত্র রেহানা মরিয়ম নূরের ভূমিকায় আজমেরী হক বাঁধন আগাগোড়াই কমপ্লিকেটেড। একজন মেডিকেল টিচার কীভাবে এতটা জেদী হয়ে উঠেছে তার কারণগুলো যদি খোঁজা হয় তবে এ ছবির বাকি সবগুলো চরিত্রই তার জন্য দায়ী। কেন ও কীভাবে দায়ী দর্শককে ছবি দেখে জেনে নিতে হবে। বাঁধনের বডি ল্যাংগুয়েজে যে ধরনের অ্যাগ্রেসিভ বিষয় আছে তার জন্য ছবির সব চরিত্রই প্রভাব রেখেছে এমনকি সেটাতে তার মেয়ে বা ভাইয়ের চরিত্রটিও বাদ যায়নি। সেক্সুয়্যাল হ্যারাসমেন্টের ভিকটিম ও দায়ী দুজনকেই বাঁধন নিজেদের বিবেকের কাছে দাঁড় করাতে চেয়েছে। শেষ পর্যন্ত সে পেরেছে কি পারেনি সেটা বিষয় না কিন্তু তার ফাইট করার জেদটা ছিল প্রচণ্ড। ছবির শেষের পনেরো মিনিটে বাঁধনকে যেভাবে দেখা যাবে তার সাথে আগের বাঁধনের সম্পর্ক কম বা অনেকটাই নেই। এখানে দর্শকের কাছে বাঁধনকে ‘selfcontradictory character’ মনে হবে এবং সেখানেই বাঁধনের চরিত্রটি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। স্রোতের বিপরীত এবং স্রোতের সামনে দুটোই যেন তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। পরিচালক কেন্দ্রীয় চরিত্রকে দর্শকের কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন করে নিজের পরিচালনার মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন এটা স্বীকার করতেই হবে। কেন্দ্রীয় চরিত্রের কিছু তৎপরতার বিশ্লেষণ দেয়া যাক:
১.
– তুমি মিমিকে এক্সপেল করলা কেন?
– মিমি পরীক্ষায় নকল করতেছিলো
– স্কেলের মধ্যে দু’একটা পয়েন্ট লিখে রাখাকে নকল বলে না, রেহানা। লাইফে এরকম ভুল সবাই করে।
– দুদিন পর এই ছেলেমেয়েগুলোর হাতে মানুষের লাইফ অ্যান্ড ডেথ নির্ভর করবে। আপনি চান ওরা এভাবে পাশ করুক?
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে বাঁধনের তর্ক।
২.
‘আমি কয়েকদিন ধরে খেয়াল করতেছি আপনি আমাকে তুমি তুমি করে বলতেছেন কিন্তু তুমি বলার আগে আমার পারমিশন নেন নাই।’
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বাঁধনের সতর্কতা।
৩.
‘ছেলেদের খেলা মেয়েদের খেলা বলে কিছু নাই তোমার যেটা খেলতে ইচ্ছা করবে তুমি খেলবা।’
নিজের মেয়েকে সমতা সম্পর্কে বলা।
৪.
‘মেয়েদের এত ইগো থাকা ভালো না’
বাঁধনকে অন্য একটা মেয়ে বলেছে। বাঁধন তা মানেনি কারণ সে কনফিডেন্ট তার সচেতনতা নিয়ে।
৫.
– মেয়েটা যা জেদী হইতেছে না!
– খুব স্বাভাবিক
ভাইয়ের সাথে কথোপকথন বাঁধনের।
৬.
‘তুমি এসব কার জন্য করছ, নিজের জন্য না ওর জন্য?’
এ সংলাপটি বাঁধনের চরিত্রের প্রকৃত দিকটিকে তুলে ধরেছে। কেন ও কীভাবে ছবি দেখে জেনে নেয়া ভালো।
এসব বাদেও প্রশাসনিক পলিটিক্সের সাথেও বাঁধনের লড়াই চলে। বাঁধন একা কিন্তু ভেতর থেকে একা না। অ্যানি, মিমি, আরেফিন স্যার, আয়েশা, প্রিন্সিপাল, মেয়ে, ভাই সবার সাথে তার কোনো না কোনো অ্যাঙ্গেল থেকে লড়াই চলে এবং সেটা জয়, পরাজয়ের হিসাবের ঊর্ধ্বে। এভাবেই কমপ্লিকেটেড সে। বাঁধন চরিত্রের ওপর দখল রেখে অসাধারণ অভিনয় করেছে।
ছবির দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় চরিত্র সাদা চোখে আরেফিন স্যার কিংবা অ্যানিকে মনে হতে পারে দর্শকভেদে কিন্তু খু্ব সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে বাঁধনের মেয়ের চরিত্রে ছোট্ট যাইমা দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়। বাঁধনের প্যারালাল একটা বৈশিষ্ট্য বা বাঁধনের ছায়া তার মধ্যে দেখা যায়। পরিচালক সচেতনভাবেই মা, মেয়েকে প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থার অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন। একজন বড় পরিসরে আরেকজন ছোট পরিসরে কিন্তু লড়াই দুজনই করে যায়। একদম ছবির শেষ পাঁচ মিনিটে ছোট্ট যাইমার চরিত্রের শক্তি দর্শক দেখতে পাবে বাঁধনের মতোই। আরেফিন স্যার ও অ্যানি চরিত্র দুটি সমভাবেই তৃতীয় কেন্দ্রীয় চরিত্র মনে করা সঙ্গত। আরেফিন চরিত্রে কাজী সামি হাসান ভালো অভিনয় করেছে, আফিয়া তাবাসসুম কিছু জায়গা বাদে বেশ ন্যাচারাল। সাবেরী আলমের জন্য পারফেক্ট চরিত্রই ছিল।
কারিগরি দিকের কথা বললে ট্রেলারে যেমনটি ছিল ফেস্টিভ্যাল ট্রেলার যেভাবে হয়ে থাকে সেটাই ছিল। ডার্ক শেডে করা কালার গ্রেডিং পুরো ট্রেলারে ছিল যা মূলত গভীরভাবে ভাবলে ‘dark color represnts dark society’ মনে হবে। ছবিতেও সেটাই ছিল। ‘ডার্ক কালার’ মূলত চলমান সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরেছে। তাছাড়া পরিচালক সাদের প্রথম চলচ্চিত্র ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’-র কালার গ্রেডিংও তাই ছিল ঐ স্টাইলটা দ্বিতীয় চলচ্চিত্রেও এসেছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের থেকে কণ্ঠকে বেশি হাইলাইট করা হয়েছে। ছবির গল্প মেডিকেল কলেজ কেন্দ্রিক হওয়াতে লোকেশন ইনডোর তাই ইনডোরে শব্দকে একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে রাখা হয়েছে। শব্দগুলো হচ্ছে – দরজায় নক, নিঃশ্বাসের ওঠানামা, পানির বুদবুদ, বাথরুমের ঝরনার পানির শব্দ, পানি খাওয়ার শব্দ, বমির শব্দ এগুলো টেনশন, রাগ, জেদ, বাধা ভেঙে চলার সাথে তুলনা করা যায়। পাশ্চাত্যের একটি উপন্যাসতত্ত্বে মিখাইল বাখতিন মানুষের শারীরিক লক্ষণের সাথে তার ভেতরের বক্তব্য প্রকাশের ব্যাখ্যা দিয়েছেন যাকে তিনি ‘grotesque body’ বলেছেন। এই ছবিতে বিষয়টা আছে। সচেতনভাবে এ তত্ত্ব মেনেই করা হয়েছে তা বলছি না তবে আছে। ছবির সিচুয়েশনে অস্থিরতা থাকায় কাঁপা কাঁপা ক্যামেরায় দেখানো হয়েছে স্থির রাখলে হয়তো মনোযোগটা সেভাবে থাকত না দর্শকের। এ ধরনের ক্যামেরার কাজকে ‘অবজেক্টিফাই ট্রিটমেন্ট’ বলে এবং ফেস্টিভ্যাল কেন্দ্রিক ছবিতে অহরহ দেখা যায়।
‘রেহানা মরিয়ম নূর’ শুধু বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের মধ্যে না বরং বাংলা ভাষার অন্যতম সেরা বক্তব্যধর্মী চলচ্চিত্র। যোগ্য ছবি হয়েই কান ফেস্টিভ্যালে গিয়েছে। ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ শুধু একজন নয় অনেক রেহানা মরিয়ম নূরের প্রতিনিধি যারা পুরুষতান্ত্রিক, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ করে যাচ্ছে। তারা সফল কি ব্যর্থ সেটা বিষয় না যুদ্ধ করে যাওয়াই তাদের প্রধান কাজ। ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ আরো তৈরি হোক।
রেটিং – ৯/১০