‘কাইজার’ ও ওয়েব সিরিজ নিয়ে কিছু কথা
তানিম নূর নির্মিত ওয়েব সিরিজ ‘কাইজার’ সম্প্রতি রিলিজ হয়েছে ভারতীয় প্ল্যাটফর্ম হইচই-এ। ইতোমধ্যে ইতিবাচক রিভিউ জিতে নিয়েছে। বলা হচ্ছে, ঢাকায় নির্মিত ওয়েব সিরিজগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি, যাকে গল্প বিন্যাস ও সংলাপের জন্য মনে রাখা হবে।
বাংলাদেশ কেন উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে স্পর্শকাতর একটি বিষয় এতে স্থান পেয়েছে; সমকামিতা। তবে সিরিজে থাকা বিষয়টি (সমকামিতা) নিয়ে খুব একটা কথাও হয়নি। এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে। আমি নিজেও সোশ্যাল মিডিয়ায় সিরিজটি প্রসঙ্গে বললেও প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেছি। এক মন্তব্যের প্রেক্ষিতে এই নিয়ে কিছু কথা বলেছি। এই লেখা মূলত সেই পোস্ট, মন্তব্য ও মন্তব্যের জবাব।
আমি যখন দেখি ‘সমকামিতা’র বিষয়টি ততটা আগ্রহের উপাদান ছিল না। যেহেতু বিষয়টি জানতাম না এবং সিরিজের একদম শেষ দিকে ডিসক্লোজ হয়।
“অফিসের ফাঁকে ঈদের দ্বিতীয়দিন দুপুরে ‘কাইজার’-এর প্রথম পর্ব দেখলাম। এরপর বাসায় ফিরে টানা বাকি আট পর্ব দেখলাম। বোঝাই যাচ্ছে, সিরিজটা কতটা আগ্রহোদ্দীপক।
শেষ পর্বে যথেষ্ট থ্রিল থাকলেও নির্মাণে খানিকটা ফ্লাট হয়ে গেছে। এই একটা ধাক্কা ছাড়া গোগ্রাসে গিলছি বলা যায়। আমাদের নাটক-সিনেমার ক্যারেক্টার ও ঘটনাগুলো হঠাৎ করে আসমান থেকে ধপ করে পড়ার একটা ব্যাপার আছে (হ্যাঁ, সব সময় না)। এখানে মেন্টালি ডিস্টার্ব পুলিশ বা গোয়েন্দা, একটা ক্রাইম সিন্ডিকেট আর টুইস্টের একটা কমন প্যাটার্ন আছে। বাট, এ সিরিজের কাহিনিতে এত এত ছোট ছোট এলিমেন্ট আছে, যা আশপাশের দুনিয়ার সঙ্গে যুতসই একটা যোগাযোগ করিয়ে দেবে। এ জন্য সংলাপগুলো মন লাগায়া শুনতে হবে। কিছু জায়গায় হো হো করে হাসার মতো বিষয় আছে। ডায়ালগে আয়মান আসিব স্বাধীনের ক্রেডিট স্বীকার করতেই হয়।
আমি কখনো ভিডিও গেম খেলি নাই সে অর্থে। কিন্তু ছোটবেলায় ভিডিও গেম পাগল পোলাপাইন দেখছিলাম, ভাবতাম হায় এরা কত কী জানে! আসলেই। সিরিজের শুরুর দৃশ্যে নব্বইয়ের সেই নস্টালজিয়া আছে। যদিও গেমিংয়ের জগতটা তত গভীরভাবে আসে নাই।
আর আমাদের তিন গোয়েন্দা! রকিব হাসানকে এত বড় ট্রিবিউট কেউ দেয় নাই। তিনি কত কিছু ডিজার্ভ করেন। সেইদিন এক সাক্ষাৎকারে দেখলাম, তিনি আর লিখতে পারেন না, শারীরিক কারণে। এরপর এই সিরিজ দেখে নস্টালজিক হচ্ছিলাম। যদিও এটা মূল বিষয় না। বরং সিরিজটা সুনির্মাণ ও অভিনয়ে চমৎকার। একঘেয়ে চোর-পুলিশ না হয়ে ক্যারেক্টারগুলার জটিলতা আসছে।
‘কাইজার’ তানিমের ‘কন্ট্র্যাক’-এর মতো অবোধ্য হয়ে থাকে নাই। সেটা স্বস্তির। তবে মার্ডার মিস্ট্রির ভেতর দিয়ে একটা সেনসেটিভ বিষয় নিয়ে গল্পে কথা বলা হইছে। সেটা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা চোখে পড়ে নাই। আমি না হয় না-ই বা বলি।
সেই যে শেষ পর্বটা নিয়ে খানিকটা আফসোস রয়ে গেছে। আশা করি, পরের সিজন আরও জমজমাট হবে।”
এই অংশটুকু ফেসবুকে পোস্ট করার পর আবদুল্লাহ আল-মানী ‘সমকামিতা’ প্রসঙ্গে মন্তব্যটি করে। যেটা আসলে ইন্টারেস্টিং। কলকাতার ওয়েব সিরিজের ভোক্তা না হওয়ার কারণে সেটা চোখে পড়েনি।
পরে আবার রিপিট হলেও এখানে আমার অনুমান হলো, ভারতের অন্য সব ইন্ডাস্ট্রি বাদ দিয়ে কলকাতার দিকে নজর ফেরালে বোঝা যায়, সিনেমায় একটা প্রান্তিক অবস্থান থেকে ‘সমকামিতা’কে অনেকদিন ধরে দেখানো হচ্ছিল। যাকে অনেকে ‘প্রমোট’ করা হিসেবে উল্লেখ করেন। কিন্তু এই ধরনের প্রমোট ক্ষমতা সম্পর্কের দিক থেকে গৌণ। কিন্তু ওয়েব সিরিজে এসে প্রান্তিক অবস্থান থেকে মূলধারায় চলে এসেছে সমকামিতা।
মানী বলছিলেন, ‘হইচই কিংবা ইন্ডিয়ান বেইড প্ল্যাটফর্মগুলোতে সমকামিতা একটা কমন বিষয় হয়ে গেছে। সে মহাভারত মার্ডার হোক কিংবা এই খানের কিছু। এগুলো প্রচার ও প্রসারে সুক্ষ্মভাবে প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থা। সবাই এন্টারটেইনিং হিসাবে নিলেও এটা যে এক ধরনের সিস্টেমেটিক ওয়েতে মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া সেটা অনেকেই বোঝে না। ইদানিংকালে ওটিটি কিংবা চলচ্চিত্র এই ক্ষেত্রে গুড অফিসের কাজ করছে।’
এ বিষয়ে আমার মন্তব্য হলো, ‘সমকামিতা’র মতো অসুস্থতাকে তারা (কলকাতা) অনেকদিন ধরে তুলে ধরছে। যেগুলা আগে একটু অফট্রাকের মুভিতে দেখা যাইতো। ভারতের এ সব জিনিস ’ইচকে পাকামি’ই মনে হয়। অনেক বছর আগে একটা সুন্দর ছবি দেখতেছিলাম, ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’। এর মধ্যে দেখি এসব গা গুলিয়ে আসা দৃশ্য। পরে ফুটপাতে দেখছি বাজে ছবি হিসেবে সিডিতে বিক্রি হইতে। তবে এটা তো একদম ক্লাসে নিয়ে গেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। উনি নিজের জীবনাচরণের কারণে মেবি প্রচারকের পর্যায়ে চলে গেছেন। তার নির্মাণ বা অভিনয়ের যতটা না নিস্পৃত ভঙ্গি এর চেয়ে আবেগী সম্পর্কটা বেশি ওঠে এসেছে। একটা ছবি ভালো লেগেছিল, ‘মেমরিজ ইন মার্চ’। ইমোশনাল ট্রিটমেন্টটা। তবে এগুলা মেবি প্রান্তিক। … কলকাতায় নির্মিত ওয়েব সিরিজ আমার দেখা হয় নাই কখনো। এগুলা এমন ওয়েব মেইনস্ট্রিম। হইচই-এর শুরুর দিকের কিছু সিরিজের ট্রেলার দেখে বুঝছি, এরা পাতরামি-নোংরামি দিয়ে দর্শক টানতে চায়। বাংলাদেশে এ ধারায় গিয়ে শুরুতে হোঁচট খায় বিঞ্জ।
এখন বাংলাদেশি প্রডাকশনে আসলেও এগুলা আসলে হাস্যকর জিনিস। হাভাতে জিনিস। পশ্চাৎপদ। যেহেতু এ ধরনের কনটেন্ট আন্তর্জাতিক জায়গায় অনেক আগেই ঢাক গুড়গুড় অবস্থা থেকে ওঠে এসেছে।
… মানীর মন্তব্য পড়ার পর প্রথমে যেটা মাথায় আসলো, ওখানে মানে কলকাতায় সিনেমা-নাটক বানানোর আগে এখনো নারকেল ফাটায় ফ্লোরে। ফলে কতটা প্রচারক আর কতটা ব্যবসার জন্য সাতগুণ মাফ নিয়ে এটা করে সন্দেহ আছে! তবে সমকামিতার মতোই এই পণ্যায়নও ‘অসুস্থতা’। এ জিনিস দিয়ে আর কতদিন চলবে! এর মধ্যে ডুবলে আমাদের দেশি নির্মাতারাও ভুল করবে। তবে এ সিরিজে ‘পার্টনার’ শব্দটির পুনঃপুন ব্যবহারে এক ধরনের মানিয়ে নেওয়ার কসরত আছে।
এরই মধ্যে দেখা গেছে, দেশে নির্মিত ওয়েব সিরিজগুলো কমন প্যাটানে ঢুকে গেছে। যেকোনো কিছুকে থ্রিলার বানানোর একটা প্রবণতা। এখন এখানে ‘সমকামিতা’ যদি কমন ইলিমেন্ট হয়ে দাঁড়ায়, ইউটিউবে গিয়ে নাটকের যে দশা হয়েছে, সেটাই হবে। মানুষ আর কতদিন এই সব জিনিসের জন্য টাকা দিয়ে সাবস্ক্রাইব করবে। এ ছাড়া গলার কাঁটার মতো ওয়েব সিরিজের ওপর যদি কোনো নিয়ম-কানুন জারি হয়, সেখানে ‘মানহানি’তে জান জেরবার অবস্থা হয়ে যাবে। আর যাই হোক, সরকার এই সব ক্ষেত্রে রক্ষণশীলদের ঘাটাতে চাইবে না। এ কারণে কলকাতার ফাঁদে পড়ে (যদি এমন কিছু থাকে আরকি) আরও ক্রিয়েটিভ ওয়েতে এগোনো উচিত আমাদের নির্মাতাদের।
সত্যি বলতে কী, একটা সিরিজ দিয়ে এতকিছু বিবেচনা করতে চাই না। যেহেতু আশঙ্কাটা চোখের সামনে এলো, তাই মনে হলো এ কথাগুলো বলাই যায়।