কাজলরেখা: লোকসাহিত্যের প্রামাণ্য দলিল
‘কাজলরেখা’ লোকসাহিত্য থেকে গল্প নিয়ে নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। লোকসাহিত্যের প্রামাণ্য দলিলে পরিণত হয়েছে এ ছবি। নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম ‘মনপুরা, স্বপ্নজাল, গুণীন’-এ যে শেকড়সমৃদ্ধ গল্পের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন তারই নতুন সংযোজন ‘কাজলরেখা’।
লোকসাহিত্যের অন্যতম উপাদান ‘গীতিকা’ যাকে ইংরেজিতে বলে ‘Ballad’ তা থেকেই নির্মিত এ ছবি। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’-র সমৃদ্ধ গল্প ‘কাজলরেখা’। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চন্দ্রকুমার দে-র সংগ্রহে এবং ড. দীনেশচন্দ্র সেনের সম্পাদনায় এগুলো প্রকাশিত হয়েছিল। আমাদের লোকজীবনের রূপকথা এটি যার মধ্যে চিরায়ত জনজীবনের নানা গল্প উপস্থিত।
লোকসাহিত্যের উপাদানে ছবি নির্মাণ বর্তমান সময়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। এখন আধুনিকতা গ্রাম পর্যন্ত চলে গেছে। আপনি গ্রামে গিয়ে ক্যামেরা ধরলেও কোথাও না কোথাও পাকা রাস্তা বা দালানের ছবি ওঠাটা স্বাভাবিক। এ বাস্তবতায় শতভাগ গ্রামীণ আবহে ছবি বানানো অনেক চ্যালেঞ্জের কাজ। গিয়াস উদ্দিন সেলিম ‘কাজলরেখা’ ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ বিষয়টি অত্যন্ত সচেতনভাবে মাথায় নিয়েই সম্পূর্ণ গ্রামীণ আবহে ‘কাজলরেখা’-কে বানিয়েছেন। তাঁর সচেতনতা প্রশংসনীয়।
ছবির গল্প প্রথমত সামাজিক দ্বিতীয়ত ট্রাজিক। এক ধর্মমতি শুকপাখি গল্পের পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে। রূপকথাতেও মানুষের জীবনের স্বাভাবিক বাস্তবতা উপস্থিত। যেকালে আমরা ছোটবেলায় মায়ের কাছে সুয়োরাণী দুয়োরাণীর গল্প শুনতাম ঠিক সেভাবেই এ গল্পে সমাজের ট্যাবু, প্রেম, বেঈমানি, ভাগ্য, কর্মফল সবকিছু ঘটে।
গীতিকায় যেভাবে ভণিতার স্টাইলে কথোপকথন ঘটে ঠিক সেভাবেই সঙ্গীতের আবহে ‘কাজলরেখা’-র গল্প চলে। যার নমুনা এরকম :
কাজলরেখার বাবা :
কও কও শুকপাখি আমার বিবরণ
আমারও দুঃখের দিন শেষ হইব কখন
শুকপাখি :
কাইন্দ না কাইন্দ না সাধু কাইন্দ নাকো আর
দুঃখেরও দিন এবার শেষ হইব তোমার
কাজলরেখা :
কও কও শুকপাখি আমার বিবরণ
আমারও দুঃখের দিন শেষ হইব কখন
শুকপাখি :
কাইন্দ না কাইন্দ না কন্যা কাইন্দ না কো আর
দুইদিন পরে বলব কইন্যা তোমার সমাচার
গানের আধিক্য অনেক দর্শকের হয়তো পছন্দনীয় হবে না কিন্তু গানই এ ধরনের ছবির মূল নিয়ামক। গান হচ্ছে এ ধরনের ছবির স্টোরি টেলিং-এর একটা উপাদান। যেভাবে ‘রূপবান, বেদের মেয়ে জোসনা, রাজার মেয়ে বেদেনী, নাগিন, বেদের মেয়ে’ প্রভৃতি ছবিতে গানে গানে স্টোরি টেলিং চলে। পল্লীকবি জসীম উদ্দিনের ‘নক্সী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যগ্রন্থেও এমন বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
ল্যাংগুয়েজ প্যাটার্নে লোকসাহিত্যের দিকটি যত্নের সাথে তুলে ধরেছেন গিয়াস উদ্দিন সেলিম। সাধু সাধু, সমত্ত মেয়ে, পক্ষী, পঙ্খী, গৌরীদান, অধর্ম, বাণিজ্য, কঙ্কন, কন্যা সম্প্রদান, বিবাহ এ শব্দগুলো কথোপকথনে ব্যবহৃত হয়েছে। তখনকার সমাজে এসব ভাষাতেই কথা হত। ‘করব’-র ক্ষেত্রে ‘করবাম’, ‘প্রথমে’-র ক্ষেত্রে ‘পরথম’ এমন ডায়ালেক্টও কমন ছিল তখন।
কাজলরেখা-য় সাদিয়া আয়মান ও মন্দিরা চক্রবর্তী মূল আকর্ষণ। তারা দুজন কিজন্য মূল আকর্ষণ সেটা ভেঙে না বলাই ভালো দর্শক জেনে নেবে ছবি দেখে। সাদিয়া আয়মানের অভিনয় তো চমৎকার ছিলই তবে এর থেকে গিয়াস উদ্দিন সেলিম তার মেকাপ যেভাবে দিয়েছেন তাতে তার মেকাপের মধ্যেই একটা ইনোসেন্স ভাব চলে এসেছে আর সেজন্যই সে না বললেও তার চোখমুখ যেন কথা বলে। সরল, সুন্দর একটি মেয়ের কথাবার্তা যেমন হয়ে থাকে সেটাই সাদিয়া করে দেখিয়েছে। তার সম্পর্কে তার মায়ের মন্তব্য মজার-‘মানুষের কথা শোনে না যে মেয়ে সে শুনব পঙ্খির কথা?’ মন্দিরা চক্রবর্তীর অংশটি পরিণত অভিনয়ের একটা সুস্পষ্ট ছাপ নিয়ে এসেছে পর্দায়। কুমার চরিত্রের শরিফুল রাজ তার ডেডিকেটেড অভিনয়ের ছাপ নিয়ে যথারীতি এ ছবিতেও হাজির। চরিত্রের সাথে তার মিশে যাওয়ার দক্ষতা আছে। নেগেটিভ চরিত্রে মিথিলা দারুণ, এ ধরনের চরিত্রে ক্যারিয়ারে কম অভিনয় করেছে মিথিলা তাই নতুনত্ব ছিল। এছাড়া নেগেটিভে খায়রুল বাশারও ভালো ছিল।
শুকপাখি ‘কাজলরেখা’ ছবির বিশেষ চরিত্র। তার মাধ্যমেই গল্পের সবটা ঘটেছে। তার কথা বলার মধ্যে দর্শকের বিনোদিত সুযোগ অনেক।
নেত্রকোণা, খুলনা, সুনামগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ‘কাজলরেখা’ ছবির প্রকৃতি ক্যামেরায় কথা বলেছে। বিজিএম অসাধারণ ছিল। রোমান্টিক, স্যাড, থ্রিল সবকিছুতে পারফেক্ট বিজিএম ছিল। শুধু কিছু ট্রলি শটে ভেঙে যাচ্ছিল বা ঘোলা হয়ে আসছিল এমন একটা সমস্যা বোঝা যাচ্ছিল তবে সেটা বড় কোনো সমস্যা না।
এ মুহূর্তে ‘কাজলরেখা’ ছবির শক্তি হলো লোকসাহিত্যের চলচ্চিত্রের প্রামাণ্য দলিলে পরিণত হওয়া। এরপর কেউ আরো এ ধরনের চলচ্চিত্র বানাতে চাইলে এ ছবিকে স্টাডি করার সুযোগ পাবে।
ছবির শেষে নেপথ্য কণ্ঠের মতো এ আলোচনারও ইতি টানা হলো সেই গানে গানে :
আমার কথা ফুরাইল
নটেগাছটি মুড়াইল
রেটিং – ৮/১০