কাঁটাতার হয়ে বিঁধে আছে গৌতম ঘোষের – শঙ্খচিল
আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায় ।
হয়তো মানুষ নয় ;
হয়তো শংখচিল শালিকের বেশে ;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে ,
কুয়াশার বেশে ভেসে একদিন আসিব এই কাঁঠাল ছায়ায় …
আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়।
নদী তুমি কার? হিন্দুর নাকি মুসলমানের? জন্ম জন্মান্তর থেকে এই প্রশ্ন বুকে নিয়ে ঘুরছি ? কিন্তু কোন দিন কারো কাছে এই প্রশ্ন করা হয়নি। মানুষ পাখী নয়যে উড়ে চলে যাবে তার সীমারেখার বাইরে। মানুষকে কাঁটাতার পেরোনোর হিসেব দিতে হয় একদম জীবন দিয়েই, ফেলানীরা ঝুলে থাকে লাশ হয়ে। গৌতম ঘোষ বেশ শক্ত ভাবেই তুলে ধরেছেন এই ভাগাভাগির খেলা্র ইতিবৃত্ত তাঁর শঙ্খচিল সিনেমায়।
যৌথ প্রযোজনা নিয়ে আমার নিজের মধ্যে যে একটা খুত খুঁতে ভাব ছিল না তা না। কিন্তু যে ছবি চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়-সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই, তাকে এড়িয়ে যাই কি করে। হুম, কেবল একটি বর্ডার দিয়ে ভাগ করে দেওয়া যায় না মানবীয় আবেগ, ধরে রাখা যায় না এক জনের প্রতি আর এক জনের কর্তব্য। দেশ যখন দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেল তখন একই বাড়ির রান্না ঘর গিয়ে পড়লো ভারতে, আর শোবার ঘর বাংলাদেশে।কারো ছাগল চলে গেল ইন্ডিয়ায়, কারো বা গরু হয়ে গেল বাংলাদেশী। আরো কষ্টের বিষয় -একটি গাছের শেকর ইন্ডিয়ান আর গাছে্র আগাটা বাংলাদেশে। তবে কার জন্য সেই গাছের ফল? ভারত নাকি বাংলাদেশের। এমন প্রশ্নের মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলে শঙ্খচিল।
তের বছরের রূপসা আতসি কাঁচ দিয়ে হয়তো খুঁজতে থাকে মানুষে মানুষে এই বিভেদের ইতিহাস। স্কুল মাস্টার বাদল মনে প্রাণে ভালোবাসে তার দেশ, সন্মান করে তার ধর্মকে। কিন্তু,সন্তান যখন জীবন মৃত্যূর মাঝে লড়ছে তখন দিশেহারা বাদল ইছামতি পাড় হয়ে স্ত্রীকে নিয়ে চলে যায় ভারতের ছোট্ট একটি শহরে। তারপর চিকিতসার প্রয়োজনে তাদের চলে যেতে হয় কোলকাতা, নিজেদের পরিচয় দিতে হয় হিন্দুস্থানী বলে। দর্শক দেখতে পেরেছে -কেবল সন্তানের শেষ ইচ্ছে পূরণের জন্য কিভাবে বাবা মা মেনে নেয় এক অন্ধকার পরিণতি।
গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘শঙ্খচিল’ ভারতের ৬৩তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা বাংলা ছবির পুরস্কার জিতেছে। এই জেতার পেছনে রয়েছে বলিষ্ট কাহিনী, অসাধারন ক্যামেরার কাজ আর দক্ষ অভিনয়। প্রসেনজিত যেভাবে বাদল চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছে এতে নির্দ্বিধায় বলা যায় -তিনি নিজে প্রযোজনা না করলেও এই চরিত্র এমন করে আর কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারতো কিনা আমার সন্দেহ ।
লালন চরিত্রের চাইতে শত গুণে মানিয়ে গেছে তের বছরের বালিকার বাবার এই আবেগ ঘন চরিত্র। ছবির একদম শেষে এসে তাকে মেয়ের লাশ নেবার জন্য যখন নাম লিখতে বলা হলো, বাদলের মুখ দিয়ে উচ্চারিত প্রত্যেকটি সংলাপ হতভম্ব করেছে দর্শকদের। আর রূপসা চরিত্র যেমন ভাবিয়েছে,তেমন কাঁদিয়েছে। একটি ভিন দেশি সৈন্যের সাথে তার কাটানো মুহূর্ত গুলো দূর দেশে ফেলে আসা কোন সন্তানের জন্য বাবার আকুতির কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে। আসলে বাবা মার সাথে সন্তানের যে নিবির সম্পর্ক তার জন্য আলাদা করে কোন দেশ নেই, পৃথিবীর যে কোন প্রান্তেই অনুভূতিটা একি রকম।
আমি সব চেয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখেছি কুসুম সিকদারের অভিনয়। এক সময়ের সুন্দরী খ্যাত কুসুম এতো অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের ভেতর এমন পরিবর্তন নিয়ে আসবে তা ভাবনাতীত ছিল। পরিচালক চাইলে আমাদের দেশের অভিনেতাদের কাছ থেকে তার কাজ ঠিকি আদায় করতে পারেন, তার সবচাইতে বড় প্রমাণ -এই কুসুম। প্রসেনজিতের পাশে তাকে বেমানান তো লাগেইনি, উপরুন্ত সাধারণ মধ্যবিত্ত মায়ের ভূমিকায় তার অনবদ্য অভিনয় দর্শকের মুগ্ধতা কেড়ে নিয়েছে। মুসলমান নারীর কপালে যখন বাধ্য হয়ে সিঁদুর ওঠে তখন তার দু চোখে যে যন্ত্রণা উপচে পড়তে পারে তা খুব ধারালো অস্ত্র হয়েই আমাদের বুক চিঁড়ে দিয়েছে।
মোট কথা, শঙ্খচিল এমন একটি ছবি যা একটি কঠিন সত্যকে কাঁধে করে উড়ে বেড়াচ্ছে এ দেশ থেকে ওই দেশে। কিন্তু,তাকে খাঁচায় পুরে রাখে এমন সাধ্য কারো নাই। এটা কেবল ভাবায়, আর কাঁদায়। দুই ঘন্টা বিশ বিনিট পর বুকের মাঝ বরাবর কাটাতার হয়েই বিঁধে থাকে।