খায়রুনের ট্র্যাজেডি
খায়রুন সুন্দরী;পরিচালক: এ কে সোহেল; শ্রেষ্ঠাংশে: মৌসুমী, ফেরদৌস, এটিএম শামসুজ্জামান, দিলদার, প্রবীর মিত্র প্রমুখ; উল্লেখযোগ্য গান: খায়রুন লো ও দাদা গো তোর পাও ধরিয়া কই; মুক্তি: ১৭ জুলাই ২০০৪
কতদিন হয় গ্রামগঞ্জের ছবি দেখেন না?
অনেকদিনই তো হওয়ার কথা। ভাবুন তো একবার আগে যেভাবে দরদ দিয়ে গ্রামবাংলার চিরায়ত সংস্কৃতির ছবি নির্মিত হত এখন তার কানাকড়িও হয় না। একুশ শতকের নগরায়ণ যেভাবে গিলে খাচ্ছে আমাদের তাতে করে একদিন তো গ্রামই থাকবে না, গ্রামের ছবি নির্মাণ তো পরের কথা। সে দিন দেখতেও বেশি দেরি নেই।
একটা ছবির হাইপ আপনি যখন দেখবেন সেটার প্রতি আপনার একটা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করবে। যেমন ধরুন ‘বেদের মেয়ে জোছনা’। এ ছবি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ব্যবসাসফল ছবি। নব্বই দশকেরও আগের ঘটনা অথচ কী অসাধারণ ঘটনা ঘটিয়ে গোটা দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল এই ফোক ঘরানার ছবিটি। হাইপ বাংলাদেশী ফোক ঘরানার ছবিতে আরো আছে সেগুলোর মধ্যে বাঙালি গৃহবধূর প্রেম, সংসার ও করুণ পরিণতি নিয়ে অন্যতম সেরা হাইপ তোলা সুপারহিট ছবি ‘খায়রুন সুন্দরী’। এ ছবি মুক্তির সময় বন্যা ছিল দেশে। বন্যার মধ্যেও নৌকায় করে মা-বোনদের সিনেমাহলে আসতে দেখা গেছে। খবরের কাগজে খবরও বেরিয়েছিল। বিশেষ করে নারী দর্শকই ছবিটিকে হিট করাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল। ‘খায়রুন সুন্দরী’ পার করল একযুগ।
নারীপ্রধান ছবির গল্পে যাকে নিয়ে গল্প সাজানো হয় সে থাকে লাইমলাইটে। সেসূত্রে মৌসুমী এ ছবির প্রাণ। খায়রুন আর মমতাজ-পলাশ তখন সারাদেশে একনামে পরিচিত ছিল। গ্রামীণ নারীর সৌন্দর্য বর্ণনায় মমতাজ ও পলাশের ফোক স্টাইলের পারফেক্ট কণ্ঠে গানটি বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। গানের প্রধান আকর্ষণ ছিল উপমার ব্যবহার-
‘খায়রুন লো তোর লম্বা মাথার কেশ
চিরল দাঁতে হাসি দিয়া পাগল করলি দেশ
খায়রুন লো।’
গানটি গ্রামের মানুষজন গায় খায়রুনের রূপ বর্ণনা করে। গানের মধ্যে গ্রামবাংলার মানুষের অভ্যাস ফুটে ওঠে। খায়রুন বা মৌসুমীর পরিচিতি দেয় গানটি। মৌসুমী হেসে যায় যখন সিনেমাহলের আওয়াজ বাড়তে থাকে। দারুণ ছিল দর্শক রেসপন্স।
গাঁয়ের ছেলে পরিণত বয়সে বিয়ের পাগল হয়। বিয়েপাগলা চ্যাংড়া বলে কিছু বোলও চালু আছে। ফেরদৌস মৌসুমীকে প্রথম দেখেই ভালোবেসে ফেলে। খায়রুনকে জানালার ধারে গিয়ে প্রেম নিবেদন করে। মৌসুমী যে রাজি না তা নয়। ফেরদৌস তখন দাদাকে রাজি করাতে পণ করে। দাদা এটিএম শামসুজ্জামান তো রাজি না প্রথম প্রথম। ফেরদৌস গান ধরে-
‘দাদা গো তোর পাও ধরিয়া কই
এবার বিয়া না করাইলে দ্যাশত থাইকবার নই, দাদা গো।’
দাদা-নাতির খুনসুটিতে গানটা উপভোগ্য। এটিএমের অঙ্গভঙ্গি কমেডির নিখুঁত উপস্থাপনা দেয়। ফেরদৌস রাজি করিয়েই ছাড়ে। নিয়মমাফিক গ্রামীণ সংস্কৃতিতে বিয়ের এন্তেজাম চলে। দিলদার যায় ঘটক হয়ে। কথা পাকা করার পর বিয়ে হয়। বিয়ের রাতে দাদা-নাতবৌ বাঙালি সংস্কৃতির মজার সম্পর্কের একটা সিকোয়েন্স থাকে। বাসর রাতে দেখা যায় এটিএম ঘরে ঢুকে মৌসুমীকে দেখে বলছে-‘কী অপূর্ব!’ মৌসুমী বিয়ের বাড়িতে ফেরদৌসকে দেখেনি। মৌসুমী বলে ওঠে-‘ও আল্লাহ গো আব্বা এইটা কি করল!’ এটিএম বলে-‘আমি কি সুন্দর না!’ ফেরদৌস ঘরে ঢুকে মৌসুমীর ভুল ভাঙায়।
খায়রুন সুন্দরীর সংসারে অশান্তিটা লাগে ফেরদৌসের বন্ধুর মাধ্যমে। সে খায়রুনকে টার্গেট করে। তাকে পাবার জন্য সংসারে অশান্তি লাগানোর পরিকল্পনা করে। আস্তে আস্তে সফলও হয়। মৌসুমী-ফেরদৌসের ছেলে বিস্কুট খাওয়ার পরে মারা যায়। বিস্কুটে বিষ ছিল। ফেরদৌসের বন্ধুর বুদ্ধিতে এটা করা হয়। ফেরদৌস তার বন্ধুর কথায় মৌসুমীকে ভুল বোঝার অনেক আলামত পায়। শেষ পর্যন্ত বিষয়টা ট্র্যাজেডিতে গড়ায়।
ফিনিশিং দেখে সেসময় অঝোরে কেঁদেছে দর্শকরা। মূলত ফিনিশিং এর কারণেই ছবির দর্শক বেড়ে গিয়েছিল গ্রামীণ আবেদন থাকাতে। মৌসুমী নদীর মাঝ থেকে সাদা শাড়িতে ভেসে ওঠে আর বলে-‘আমারে মারছেন, মাইরা সুখ পাইছেন? যদি পান আমার কোনো দুঃখ নাই কারণ আমার মরণ হইছে আপনার হাতে।’ এ সিকোয়েন্সটা টাচি এবং মৌসুমীর অসাধারণ অভিনয় ছিল। ফেরদৌসকে পরদিন সকালে পুলিশ নিয়ে যাবার সময় ‘খায়রুন খায়রুন’ বলে আর্তনাদ থাকে তার কণ্ঠে সাথে পাগলামি। স্বাভাবিক না থাকারই কথা।
নারী-পুরুষ সম্পর্কে কে বেশি ভু্ল বোঝে? বিতর্কের জন্য প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলে দুইদিকেই অনেক পক্ষপাতিত্ব আসবে যার যার অবস্থানে। আসল বিষয় ভুল বোঝার সুযোগ থাকলেও মানিয়ে চলাই প্রকৃত কাজ। খায়রুন বা মৌসুমী সবসময় সংসারের মঙ্গল চেয়েছে। তৃতীয় পক্ষের কারণে সন্দেহ এবং ছেলের মৃত্যুর পরে ফেরদৌসের মাথা খারাপ হওয়াই খায়রুনের পরিণতির কারণ। বাঙালি গ্রামীণ নারীরা স্বামীভক্ত হয় তাই নৌকায় মৃত্যুর আগে ফেরদৌসের হাসতে হাসতে খায়রুনকে মারার কথা বলাতে সে বলেছে-‘আমি সবসময় আপনার মঙ্গল চাইছি, আমারে ভুল বুইঝেন না।’ খায়রুনকে ফেরদৌসের দাদা এটিএমও বুঝেছে তাই ফেরদৌসের মাথা গরম দেখে তাকে আটকাতে বাধ্য হয়েছিল। খুব জোরে চেপে ধরেছিল ফেরদৌসকে। ফেরদৌস ছাড়াতে পারছিল না যখন বলেছিল-‘দাদা, আমারে ছাইড়া দাও কইতাছি।’ ফেরদৌসকে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই এটিএম মারা যায় আর সে ডুকরে কাঁদে ‘দাদা দাদা’ বলে। ফেরদৌস সংসারে সেইসব মানুষদের একজন যারা মানুষ চিনতে ভুল করে। তাও আবার একসাথে তিনজন মানুষকে চিনতে সে ভুল করেছে খায়রুনকে, তার দাদাকে আর তার বন্ধুকে। পরে আর্তনাদ করেছে ‘খায়রুন খায়রুন’ করে সে আর্তনাদ আকাশে-বাতাসে মিলিয়ে গেছে শুধু। ছবিটি মেসেজ দেয় নারী-পুরুষের ভালোবাসার সম্পর্কে তৃতীয় পক্ষ নিয়ে সচেতন থাকতে।
অভিনয়সমৃদ্ধ এ ছবিতে মৌসুমী নাম ভূমিকায় পর্দা শাসন করেছে। গ্রামীণ নারীদের মেটে সৌন্দর্যটাকে দারুণভাবে উপস্থাপন করেছেন পরিচালক এ কে সোহেল। ‘খায়রুন লো’ গানে মৌসুমীকে গ্রামীণ সংস্কৃতির আবেদনে তুলে ধরেছেন তাই গানটি তৃণমূল পর্যায়ে আলোড়ন তোলে। ফেরদৌসের প্রথমদিকের লুক আর পরের লুকে তফাত ছিল। এটা উল্লেখযোগ্য দিক তার। অভিনয়ও অসাধারণ ছিল। এটিএম শামসুজ্জামান তার ভূমিকায় আনন্দ-বেদনা সমানভাবে দিয়েছে। ফেরদৌসের বন্ধুর চরিত্রের অভিনেতাও ভালো ছিল।
সাংস্কৃতিক দিক ফুটিয়ে তোলা ছবি ‘খায়রুন সুন্দরী।’ মৌসুমীর ‘খায়রুন লো’ গানে তার হাসি, চুলের সৌন্দর্য,গলার অলংকার, কোমরের বিছা এসবের বর্ণনা আসে। এগুলো গ্রামের মেয়েদের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। মৌসুমীর ফেরদৌসের জন্য নকশা করে কাপড় বোনার কাজ এটা হাতের সেলাই করা কাপড়ের ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। দিলদারের ঘটকালির মাধ্যমে ঘটক সংস্কৃতি দেখানো হয়। এগুলো ছবির আবহমান সংস্কৃতির সচেতন প্রকাশ।
যতদূর মনে পড়ে প্রতিবেদন দেখেছিলাম একটা যেখানে বলা হয়েছে ‘খায়রুন সুন্দরী’-র করুণ গল্পটা বাস্তবে ঘটেছিল। টলিউডে রিমেক হয়েছে ‘প্রাণের স্বামী’ নামে সেখানে ফেরদৌসের বিপরীতে ছিল রচনা ব্যানার্জী। জানি না সত্য কিনা তবে ঘটা অসম্ভব কিছু নয়। বাস্তবতা বরং এর থেকেও করুণ হয়। ‘খায়রুন সুন্দরী’ বাস্তব গ্রামীণ পটভূমিতে গৃহবধূর একটা ট্র্যাজেডি যেটা কারো না কারো জীবনে মিলে যেতেই পারে এবং সেখানেই ছবিটা ক্লাসিক। ব্যবসায়িক সাফল্যে ছবিটি ব্লকবাস্টার ছিল এবং বন্যা পরিস্থিতির মধ্যেও বিশেষত নারী দর্শকরা নৌকাযোগে সিনেমাহলে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছিল। ছবিটি জনপ্রিয় হয়ে থাকবে।