গুণিন: লালসালুর একালের ভার্সন নাকি ডকুমেন্টারি?
গিয়াসউদ্দীন সেলিম ফিরলেন তার নতুন ছবি ‘গুণিন’ নিয়ে, যদিও পাইপলাইনে আছে ‘পাপ-পুণ্য’, যা মুক্তি পাওয়ার কথা আগামী ঈদে।
গুণিন মনে করিয়ে দেবে এই বাংলার মাটি ও মানুষের ঘ্রাণকে, মনে করিয়ে দেবে মানুষের সহজাত বিশ্বাসের অন্তরালকে। মনে করিয়ে দিতে পারে বিশ্বাসের সঙ্গে স্বার্থজনিত চাওয়া পাওয়া এমনকি দুই ভাইয়ের একজনকে বিয়ে করতে পারা না পারার দ্বন্দ্বকে। মানুষ হয়ত বিশ্বাসের ছলে তার স্বার্থকেই চাপিয়ে দেয় অন্যদের কাঁধে!
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালুর কথা মনে হতে পারে এই ছবি দেখে, যদিও ছবিটা বানানো হয়েছে হাসান আজিজুল হকের ‘গুনিন’ গল্প অবলম্বনে। গিয়াসউদ্দীন সেলিমের আগের দুই সিনেমা ‘মনপুরা’ বা ‘স্বপ্নজাল’-এ প্রচলিত সিনেমার মতো করে সব গল্প বলে দিয়েছেন। ভালো কী মন্দ সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় গুনিন তার ব্যতিক্রম। সেলিমের মতে, ‘দর্শকদের মাথা খাটাতে হবে। বুঝে নিতে হবে ঘটনা’। সিনেমাটা শেষ করার চেষ্টা করা হয়েছে ছোট গল্পের চরিত্র মোতাবেক-শেষ হইয়াও হইলো না শেষ!
গ্রামে প্রবেশের দিন দুই ভাই আলী ও রমিজের নজরে পরে রাবেয়া। স্বামী হারানো রাবেয়ার মা মনে করে বাবার সম্পত্তি থেকে তাকে ঠকানো হয়েছে। ভাই জমির ভাগ দিতে না চাইলে সে যায় গুণিনের কাছে। গুণিন রাবেয়ার মার চেয়ে রাবেয়াকেই হয়ত পছন্দ করে ফেলে। ছবির প্রথম দৃশ্যেই গুনিনের চরিত্র বোঝা যায়। জ্বীন ছাড়ানোর নামে সে আসলে মেয়েদের ভোগ করে। রাবেয়ার মা এর সামনে হাত দেখার নাম করে গুনিন রাবেয়ার হাত ধরে, হয়ত সে বুঝিয়ে দিতে চায় তার উদ্দেশ্য।
গুণিন এর ইচ্ছের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায় ছোট ভাই রমিজ। রমিজ এবং রাবেয়া দু’জন দু’জনকে ভালোবাসে। তিন ভাই এর বড় জন রহমের উপস্থিতিতে এক মারামারিতে ছোট রমিজের লাথির আঘাতে মারা যায় গুণিন। এরপর গুণিনের কবরের ওপর লাল সালু টানানো এবং দানবাক্স সংযোজিত হয়, শুরু হয় মাজার ব্যবসা।
এদিকে রাবেয়াকে নিয়ে দুই ভাই এর দ্বন্দ্ব প্রবল হয়। বড় ভাই রহম, মেজ ভাই আলীর সঙ্গে রাবেয়ার বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করলে ছোট ভাই রমিজের ভেতর ‘গুণিন’ সুলভ গুণাবলী জড়ো হতে থাকে। শেষমেষ গুণিনের জ্বীন যেন চলে আসে রমিজের ভেতর আর আলীকে এক বৃষ্টির রাতে মাটিতে মাথা পোতা অবস্থায় পাওয়া যায়, মৃত! এরপর রমিজের সঙ্গে বিয়ে হয় রাবেয়ার কিন্তু সে অন্ধকারে থাকতে পারে না। ঘোরের ভেতর সে মেজভাই আলীকেই দেখতে পায়। দুই খুনের অপরাধবোধ তাকে তাড়া করে ফেরে। শেষদৃশ্যে গুনিনের ছায়া দেখা যায় যে কিনা হেঁটে যাচ্ছে গ্রামের রাস্তা দিয়ে!
গুণিনের নাম ভূমিকায় বহুমাত্রিক অভিনয় করেছেন আজাদ আবুল কালাম পাভেল। রহমের চরিত্রে ইরেশ যাকের, আলীর চরিত্রে মোস্তফা মনওয়ার আর রমিজের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শরীফুল রাজ। রাবেয়ার মা এর ভূমিকায় শিল্পী সরকার অপু, নানীর চরিত্রে দিলারা জামান আর মামার চরিত্রে অভিনয় করেছেন ঝুনা চৌধুরী। অভিনয়ে কম বেশি সবাই ভালো করেছেন। রাবেয়া চরিত্রে পরীমনিকে ‘নায়িকা’ হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়েছে! শরীফুল রাজ দুর্ঘটনা থেকে সেরে ওঠার পর পর অভিনয়ে নেমেছিলেন, সম্ভবত সে কারণে তাকে খাবার খেতে দেখা গেছে বাম হাতে।
সিনেমায় ধাঁধাঁ আছে দু একটা। গুণিনের ঘরের ছাদের নিচের অংশ খুলে একবার দেখে রমিজরূপী শরীফুল রাজ। সেখানে সে একবার পরী মনিকেও লুকিয়ে রাখে। শেষদৃশ্যে আবার গুণিনকেও দেখা যায়। কবরে আগুনের দৃশ্যের পর কী এটাই বোঝানো হয়েছে যে অন্ধবিশ্বাস এবার দূর হচ্ছে অর্থাৎ গুণিন চলে যাচ্ছে? বৃষ্টির সঙ্গে সংলাপের ‘ওভারল্যাপ’ বা অতিরিক্ত ব্যবহারও চোখে লাগে। রাজ আর পরীমনির জড়াজড়ি, বাসর রাতে দুধ খাওয়ার দৃশ্য বা তাড়াহুড়ো না করার অনুরোধ, রাজের অন্ধকারকে ভয় পাওয়া এবং শেষমেষ ‘অপরাধবোধের’ কারণে শরীরের আগুন না নেভাতে পারার দৃশ্যগুলো দীর্ঘসূত্রী মনে হতে পারে।
উপাসনার আড়ালে মানুষের কুকর্ম, অপরাধ ঢেকে রাখার প্রবণতা, পরিশ্রম না করে প্রার্থনা থেকেই যদি কিছু পাওয়া যায় সেই ভরসা থেকেই হয়ত মানুষ মাজার বা ভণ্ড পীরদের কাছে যায়। কুসংস্কারের হাত ধরেই হয়তো অন্ধ বিশ্বাস মাথাচাড়া দেয়।
মূলত রাবেয়াকে পাওয়ার জন্য দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্ব আর গুনিনের তেলেসমাতি ঘটনার মিশেল এই ছবি। সিনেমাটিক ট্রিটমেন্টের সঙ্গে গল্পের বাস্তবায়ন করার মধ্যে ‘ডকুমেন্টারি ফ্লেভার’ও পাওয়া যায় ছবিতে । ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জোড়া বটগাছের এক গ্রামে সেট বানিয়ে শুটিং হয়েছিল গুণিনের। গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ভিন্নধারার এক ছবি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বড় ফ্রেমের একশটে গানের দৃশ্য ধারণে মুন্সিয়ানা আছে। একই সঙ্গে আছে গল্পের ‘ডকুমেন্টেশন’ এর প্রভাব।
জয় হোক বাংলা ছবির। গুণিন ও আগামীতে মুক্তি পাওয়া ‘পাপ- পুণ্যের’ জন্য শুভকামনা।
*লেখাটি বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোরে পূর্ব প্রকাশিত