গোলাম মামুন কেন সিরিজই হলো
শিহাব শাহীনের সব কাজ আমি দেখি, ভালো লাগে; তবে আমি তার অন্ধ ভক্ত নই। সাম্প্রতিককালে তার নির্মিত কাছের মানুষ দূরে থুইয়া, মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন, আগস্ট ১৪ দেখে যেমন মুগ্ধ হয়েছিলাম, আবার ‘সিন্ডিকেট’ দেখে অতটা তৃপ্ত হতে পারিনি। মরীচিকা, যদি কিন্তু তবুও দেখে চূড়ান্ত মাত্রায় হতাশও হয়েছিলাম।
এবার শিহাব শাহীন হইচইয়ের মত জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মে ডেব্যু করেছেন, আমাদের কাছে পরিচিত একটি চরিত্রের ওপর ভর করে। চরিত্রের নাম: গোলাম মামুন; যাকে আমরা গত বছর দেখেছিলাম হইচইয়েরই ‘বুকের মধ্যে আগুন’ ওয়েব সিরিজে। প্রয়াত নায়ক সালমান শাহের জীবনের অনুপ্রেরণায় নির্মিত বলেই কিনা জানিনা, সিরিজটি দেখার পরপরই ভুলে গিয়েছিলাম, মনে দাগ কাটেনি। সেই সিরিজে ‘গোলাম মামুন’ চরিত্রে ছোট পর্দার চিরচেনা ‘কিং অব রোমান্স’ অপূর্বকে ভিন্নভাবে দেখেছিলাম। ভালো লেগেছিল। অতটুকুই। স্বাভাবিকভাবেই নতুন সিরিজ ‘গোলাম মামুন’ নিয়ে অতটা প্রত্যাশা ছিল না।
তবে গত বৃহস্পতিবার রাতে আস্ত সিরিজটি দেখে শেষ করেছি। সাড়ে ৩ ঘণ্টার ৮টি পর্ব এক নিঃশ্বাসে দেখতে বাধ্য হয়েছি। ‘মাস্টারপিস’ বা ‘সময়ের সেরা সিরিজ’-এমন বিশেষণে ভূষিত করতে চাই না। তবে ‘গোলাম মামুন’ হইচই এবং নির্মাতা শিহাব শাহীনের ভালো কাজের তালিকায় ওপরের দিকেই থাকবে। ক্রাইম থ্রিলারের চেনা টেমপ্লেটে ৮টি পর্ব সাজিয়েছেন শিহাব শাহীন। প্রথম পর্বের প্রথম দৃশ্য থেকেই তিনি দর্শককে বসিয়ে রেখেছেন। অজান্তেই আমরা প্রবেশ করেছি গোলাম মামুন, রাহী, রবিন, তানিয়া, সাকিবদের জীবনগল্পে। যদিও ‘গোলাম মামুন’ ৮ পর্ব না হয়ে ৫ বা ৬ পর্ব হলেও মন্দ হতো না। ৬/৭ পর্বের দিকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মনে হয়েছে— সম্পাদক সামান্য কাঁচি চালিয়ে পর্ব কমিয়ে আনতে পারতেন।
যদিও বাংলাদেশের নির্মাতার তৈরি একটি ওয়েব সিরিজে অ্যাকশন, থ্রিলার, একাধিক চেজিং সিকোয়েন্স, দুর্দান্ত মিউজিক-সবকিছু দেখে গর্ব হয়েছে। আরো গর্ব হয়েছে, প্রতিটি শিল্পীর অভিনয় দেখে। নির্মাতা শিহাব শাহীন এই সিরিজে সবার কাছ থেকেই সেরা অভিনয় আদায় করে নিয়েছেন। জিয়াউল ফারুক অপূর্ব নাম ভূমিকায় সাম্প্রতিক সময়ে তার সেরা অভিনয় করেছেন। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। ‘গোলাম মামুন’ চরিত্রের জন্য অপূর্ব’র প্রেম, পরিশ্রম-সব স্ক্রিনে ফুটে উঠেছে। অপূর্বর মাঝ রাস্তায় চেজিং সিকোয়েন্স, গাড়ি/ বাইক চালিয়ে ছুটে চলা, চরিত্রের প্রয়োজনে চুল ফেলে দেয়া-সবকিছুই মুগ্ধ করেছে। বারবারই মনে হয়েছে, ইশ! এমন অপূর্বকেই তো আমরা দেখতে চাই। কেন এই অপূর্বকে আমরা বড় পর্দায় পাই না? চাইলে ‘কিং অফ রোমান্স’-ও ‘কিং অফ অ্যাকশন’ হতে পারেন; এই সিরিজটি আবারো সে কথাটি মনে করিয়ে দিলো।
সাবিলা নূরকে ট্রেলারে দেখে মনে হয়েছিল, এ ধরনের চরিত্রে তাকে কতটা মানাবে? বিশেষ করে সাবিলাকে খুব কম নির্মাতাই সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পেরেছেন বলে আমার মনে হয়। তবে ‘গোলাম মামুন’-এর শুরু থেকে শেষ অব্দি সাবিলা ভীষণ ম্যাচুওর অভিনয় করেছেন। এক মুহূর্তের জন্যও ‘রাহী’ থেকে বের হয়ে যাননি, অতি অভিনয় করেননি। ‘মারকিউলিস’-এর ‘জয়িতা’র পর ‘গোলাম মামুন’-এর ‘রাহী’ সাবিলার ক্যারিয়ারের একটি বিশেষ চরিত্র হয়ে থাকবে।
ইমতিয়াজ বর্ষণ সাম্প্রতিককালে অনেক সিরিজেই সেকেন্ড লিড বা প্যারালাল চরিত্র পাচ্ছেন। তবে সব চরিত্রেই নিজের সেরাটুকু দেখানোর সুযোগ পান না তিনি। এই সিরিজে ‘রবিন’ চরিত্রে বর্ষণকে দেখে আমি মনের অজান্তে বেশ কয়েকবার অস্ফুটস্বরে বলেছি, ‘ওয়াও’! লুক, এক্সপ্রেশন, বডি ল্যাংগুয়েজ-সবকিছুই দুর্দান্ত।
রাশেদ মামুন অপুকে আমার স্ত্রী খুব একটা পছন্দ করেন না। তিনি স্ক্রিনে এলেই মিতু বলে, ‘উফ! এই লোকটা আবারো’। আমি প্রশ্ন করি, সমস্যা কী? মিতুর উত্তর: দেখলেই ভয় লাগে। এখানেই রাশেদ মামুন অপুর অভিনয়ের সার্থকতা। ‘গোলাম মামুন’ সিরিজে তিনি যতক্ষণ স্ক্রিনে ছিলেন, চরিত্রে ছিলেন।
শার্লিন ফারজানা এই সিরিজের মাধ্যমে কামব্যাক করেছেন। যদিও তার কামব্যাক প্রজেক্ট হিসেবে আমি আরো বেশি কিছু আশা করেছিলাম। প্রিয় অভিনেত্রীর পরবর্তী ভালো কাজের অপেক্ষায় রইলাম। মাসুম বাশার, সুষমা সরকার, সৈয়দ নাজমুস সাকিব, শরীফ সিরাজ, নাফিস, লাবণ্যসহ এই সিরিজের প্রায় সব অভিনয়শিল্পীই চরিত্রের প্রতি সৎ ছিলেন, যা স্ক্রিনে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
যদিও ‘গোলাম মামুন’ দেখার সময় বার বার ভেবেছি: কেন এই সিরিজটি ‘সিরিজ’ হলো? সিনেমা নয়? পরক্ষণে নিজেই উত্তর খুঁজে নিয়েছি: এত সাহসী প্লট, ক্ষুরধার সংলাপ সেন্সর বোর্ড কতটা ছাড় দিতেন, আমি সন্দিহান। হইচই এবং শিহাব শাহীনকে ধন্যবাদ, কোনো কিছুর পরোয়া না করে দর্শককে একই সাথে বিনোদিত এবং মনকে আলোড়িত করার মত একটি সিরিজ উপহার দেয়ার জন্য।