ছবি কথা বলে : সেই রুনা লায়লা এই…
রুনা লায়লার গানে কোনো অলৌকিকত্ব নেই। নেই কোনো অলীক বিষয়। তার গান বরং আমাদের রূপ-রস; গন্ধ-স্পর্শের জগতেই তীব্রভাবে আকৃষ্ট করে। তার গানের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত এই জগতেরই উপাদান— যৌবধর্মের সহজ সুস্থ ও স্বাভাবিকত্ব। এক সময় রুনার গানকে বলা হত— ‘শরীরী সংগীত’- অর্থাৎ তার গান শুধু শোনার জন্য নয়, দেখারও বিষয়। রুনার কৈশোর, যৌবন ও যৌবনের লাস্য তার গানকে যেমন মোহাবিষ্ট করেছে, পরিণত বয়সে তাকে তেমনি রূপান্তর করেছে একক মহিমায় অনন্য উচ্চতার সংগীতশিল্পীতে।
এ সবের বাইরেও পুরনো দিনের গান নতুন করে শুনলে যে কেউ সুরের যে মূর্ছনা অনুভব করবেন, সেটা যে রুনা লায়লার কণ্ঠ নিঃসৃত সাবলীল ইন্দ্রজালেই অনুভূত হবে!
সঙ্গীতের জীবন্ত এ কিংবদন্তীর তারকা দিনগুলো সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি জানি। তারপরও তার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের দিনগুলোর কথা আরেকবার জেনে নিতে পারি; নিজেদের জানার সঙ্গে মিলিয়েও নিতে পারি!
রাজশাহীর ছেলে সৈয়দ মোহাম্মদ এমদাদ আলী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে এম এ পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতাতেই কাস্টমস এ্যান্ড এক্সাইজ ডিপার্টমেন্টে চাকরি জীবন শুরু করেন ১৯৪৫ সালে। আশৈশব সংগীতানুরাগী এমদাদ আলীকে আকৃষ্ট করেছিলেন বিদ্যাসাগর স্ট্রিটের গায়িকা অমিতা সেন। তিনি চট্টগ্রামের বিশিষ্ট জমিদার পরিবারের মেয়ে। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে এই অমিতা সেন— আমিনা লায়লা হয়ে এলেন এমদাদ আলীর ঘরে। তাদের দাম্পত্যজীবনের এক বছর পর ১৯৪৮ সালে ঘর আলো করে এলো দীনা লায়লা।
দীনার মধ্যে যেন পিতা-মাতার সংগীতানুরাগ একেবারে মূর্ত হয়ে দেখা দিল। বিস্ময়কর প্রতিভার প্রমাণ দিলেন তিনি। ওস্তাদও রেখে দেওয়া হলো তার জন্য। মাত্র সাড়ে চার বছর বয়সে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করে দীনা লায়লা বিচিত্রানুষ্ঠানের সব দর্শকদের বিস্মিত করে দেন।
১৯৫২ এর ১৭ নভেম্বরে জন্ম হলো রুনা লায়লার। রুনার যখন আড়াই বছর বয়স, তখন তার বাবা বদলি হয়ে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানের মুলতানে, ১৯৫৫ সালের মার্চ মাসে। রুনার বড় বোন দীনা লায়লার সংগীত চর্চা তখন অব্যাহত গতিতে চলছে। শিশু রুনা লায়লা তখন বড় বোনের আশপাশে ঘুরঘুর করে। চর্চার সময় দীনার পাশে বসে থাকে। আর সাথে সাথে গান গাইতে চায়।
দু’বছর পর, ১৯৫৭ সালে মুলতান থেকে করাচি বদলি হয়ে আসার পর সৈয়দ এমদাদ আলী দীনা লায়লার সংগীত চর্চার সুযোগ করে দেন। ওস্তাদ আব্দুল কাদের ভূপালী দায়িত্ব নিলেন দীনা লায়লার। রুনার সম্ভাবনার কথা তখনো মনে হয়নি কারোর। এর আগে নাচের স্কুলে নাচ শেখার জন্য ভর্তি করানো হয়েছিল রুনাকে। সম্ভবত ওই শাখাতেই সিদ্ধি লাভ করুক রুনা, এই ছিল বাবা-মার ইচ্ছা।
সংগীতে পিতৃসূত্রে রুনা লায়লার উত্তরাধিকার বেশ সমৃদ্ধ। আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও ছিল সহজ সাঙ্গীতিক পরিবেশ। দুজন খ্যাতিমান গায়িকা- আঞ্জুমান আরা ও জিনাত রেহানা, যথাক্রমে সৈয়দ এমদাদ আলী ভাগিনী ও নাতনি। গীতিকার জেবুন্নেসা জামাল, জিনাত রেহানার মা, তিনিও এমদাদ আলীর ভাগিনী।
করাচিতে ওস্তাদ আব্দুল কাদের ভূপালীকে শিক্ষাগুরু হিসেবে পাওয়া অবশ্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রুনার জন্য। তার প্রাণ, এ জন্যই নিজেকে কখনো পেশাদার শিক্ষকে পরিণত করতে পারেননি। সংগীতের সুধা ছিল তার মাঝে। অকাতরে তা তিনি বিলিয়ে দিতেও জানতেন। তার অসাধারণ নিষ্ঠা ও রুনার সংগীতভিত্তি রচনা করে।
বিশিষ্ট তবলাবাদক ওস্তাদ হাবিবুদ্দীনকে ওস্তাদ ভূপালী নিজেই খুঁজে এনেছিলেন— দীনার মধ্যে তিনি দেখেছিলেন এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা। সময়সূচির বাইরেও এসে গান শেখাতেন, পথে ঘাটে ঘুরে বেড়াবার সময় হঠাৎ যদি একটা কিছু খেয়াল হয়েছে, মনে করেছেন ছাত্রীর এটা শেখা উচিত। অমনি অসময়ে হলেও ছুটে এসেছেন।
দীনাকে গান শেখাতেন ওস্তাদ আর খেয়াল করতেন বড় বোনের পাশে নিশ্চুপ বসে থাকা ছোট বোন রুনা। কৌতূহল আর আগ্রহ তার চোখে মুখে। ‘ঐটুকু মেয়ে কিন্তু অনুকরণের ক্ষমতা বড় বিস্ময়ের। আর দীনার গান শেখানোর সময় তাকে দূরে সরিয়ে রাখা যায় না।’ ওস্তাদ এ স্বীকারোক্তির পাশাপাশি রুনার বাবাকে বললেন, ‘এমদাদ সাহেব, আপনার এ মেয়েটিকেও আমি গান শেখাবো।’
রুনা লায়লার শিল্পীসত্ত্বাকে উন্মোচনের ক্ষেত্রে সে ছিল ওস্তাদের এক নির্ভুল সিদ্ধান্ত। এক মাস ধরে চললো চর্চা। সে চর্চা শিশু রুনার জন্যে হলো প্রাণান্তকর। কিন্তু মনজুর হোসেনও ছাড়বেন না।
তারপর একদিন গান রেকর্ড করলেন বারো বছরের রুনা। সেই মুহূর্তে একটি অনুভূতিই শুধু সক্রিয় ছিল তার মনে, গানটি যেন ভাল হয়, সকলের প্রত্যাশা যেন পূরণ করতে পারি। এভাবে ১৯৬৪ সালে লাহোরে ‘জুগনু’ ছবিতে ‘মুন্নি মেরি’ গানের মাধ্যমে প্লেব্যাকে পা রাখেন রুনা। গানটি ছিল তার বয়সী শিশুর জন্য। এর কিছুদিন পরেই এলেন সংগীত পরিচালক নাশাদ। এবার আর শিশু শিল্পীর জন্যে শিশুশিল্পীর গান নয়। ‘হাম দোনো’ ছবির নায়িকার জন্যে গান।
শৈশবের বৃত্ত অতিক্রম করে অগ্রসর হলেন রুনা লায়লা। তারপর প্রায় এক দশক ধরে পাকিস্তানী গানের জগতে রুনা লায়লা ছিলেন এক লাস্যময়ী ঝংকার। এক জাদুকরী শিহরণ। ছায়াছবির গানের জন্যে অপরিহার্য হয়ে উঠলেন তিনি। এই প্রতিষ্ঠা এতো দূর পর্যন্ত পৌঁছালো যে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হতে হলো নূরজাহানকেও। শেষ পর্যন্ত পরাজয়ও তার স্বীকার করে নিতে হলো- বাড়িয়ে দিতে হলো আপসের হাত।
এই জয়যাত্রা শুরু হলো ১৯৬৮ সাল থেকে। ‘কমান্ডার’ ছবির ‘জানে মান ইতনা বাতা দো’ গানের জন্য রুনা লায়লা পেলেন দুইটি পুরস্কার- গ্র্যাজুয়েট ও নিগার। ১৯৭০ সালে পেলেন ৩টি পুরস্কার- গ্র্যাজুয়েট, নিগার ও ফিল্ম ক্রিটিকস এ্যাওয়ার্ড। ‘আঞ্জুমান’ ছবির গানের জন্য এই পুরস্কার তিনি পান।
অজস্র গান ও অজস্র রেকর্ডের মাঝেও শিক্ষা জীবন রাখলেন অব্যাহত। ১৯৬৮ সালে এসএসসি পরীক্ষায় পেলেন প্রথম বিভাগ, ১৯৭০ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন দ্বিতীয় বিভাগে।
১৯৭০ সাল নাগাদ রুনা লায়লা ছায়াছবির জন্য গেয়েছেন প্রায় এক হাজার গান, তারপরও রয়েছে তাঁর ছটি আঞ্চলিক ভাষার গান। এ ছাড়াও দেশী ও বিদেশী ১১টি ভাষায় তার বেশ কিছু গান।
পর পর বেরোলো ছয়টি এলপি। সবকটিই অসম্ভব হিট। প্রথম বেরোলো ১২টি ছায়াছবির গান নিয়ে ‘দ্য টিন এজ প্রোডিজি’। পরের ভলিউম ‘রুনা লায়লা’তেও ১২টি ছায়াছবির গান। তৃতীয় ভলিউম ‘সিনসিয়ারলি ইয়োর্স’ গোলাম হাদির (পণ্ডিত) এর দশটি গান।
১৯৭০ সালের ২ আগস্ট দীনা লায়লার বিয়ে হলো মখদুম মোহাম্মদ আমীনের (এমএনএ) সাথে। দীনার শ্বশুরও ছিলেন একজন এমএলএ। তিনি হালার পীরসাহেব হিসেবে সমধিক খ্যাত। এই পীরসাহেবের লিখিত ও সুরারোপিত ১০টি গান নিয়ে বেরুলো পাকিস্তানে রুনা লায়লার শেষ এলপি ‘সংস অব তালিব-উল-মওলা’। ১৯৭৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান দীনা লায়লা। এরপর ৬টি কনসার্ট করে তার সমুদয় অর্থ শিশু হাসপাতালকে ক্যান্সার ওয়ার্ড স্থাপনের জন্য দান করেন রুনা লায়লা।
১৯৭২ সালে করাচি টেলিভিশনে শুরু হলো রুনা লায়লার সাড়া জাগানো প্রোগ্রাম ‘বাজমে লায়লা’। এই সংগীতানুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা ছিল অসম্ভব। এই অনুষ্ঠানের সূত্র ধরেই রুনা লায়লার সংগীত পরিবেশন রীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা। সংগীতকে তিনি নিয়ে আসেন শরীরে কিংবা শরীরকেও করে তোলেন সংগীত। এ অনুষ্ঠানে তার পরা পোশাকের মাধ্যমে নতুন ধরনের ফ্যাশন ট্রেন্ডও চালু হয়।
পাকিস্তানে চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠাকে ত্যাগ করে স্বদেশ অভিমুখী হলেন রুনা, ১৯৭৪ সালে। মুহূর্তে যেন শোকসংবাদে বিহবল হলো পাকিস্তান। ১৯৭৪ সালের ৫ জানুয়ারি ‘ডন’ পত্রিকা লিখলো ৩ কলামব্যাপী শোক ‘এ্যান্ড টু এ গ্লোরিয়াস চ্যাপ্টার’ শিরোনামে। ১৯৭৩ সালের ২০ ডিসেম্বর ’মর্নিং নিউজ’ লিখলো অর্ধপৃষ্ঠাব্যাপী নিবন্ধ ‘দ্য বিগিনিং অব নস্টালাজিয়া’। ১০ জানুয়ারি ১৯৭৪ এর ‘লিডার’ এ পূর্ণপৃষ্ঠা নিবন্ধে প্রথমেই প্রশ্ন রাখা হলো- ‘পাকিস্তানের ছায়াছবি ও টেলিভিশন থেকে রুনা লায়লার শূন্যতা দূর করা কি সম্ভব?
কিন্তু খ্যাতি যশ প্রতিষ্ঠার চেয়ে দেশ অনেক বড়। সেই দেশের মাটিতে ফিরে আসতে পারার সুখই মহত্তর। রুনার চেতনায় দেশপ্রেম এক উজ্জ্বল অস্তিত্ব।
পাকিস্তানী ছায়াছবির গানে ও টেলিভিশনে রুনা লায়লা হয়ে উঠেছিলেন বিস্ময়। নবীন ও প্রবীণ অনেক সংগীত পরিচালকই তাঁর কণ্ঠসম্পদ ব্যবহারের জন্য ছিলেন উৎসাহী।
এভাবে গান পরিবেশনের বিশিষ্ট ভঙ্গি অর্জন করলেন। গান, গানের তালে নৃত্য, হাতের ভঙ্গিমা ও ফ্যাশনে হয়ে উঠলেন ‘এ্যালটিমেট ডিভা’। ঢাকা, দিল্লী, বোম্বে ও লন্ডনের মঞ্চে এসে দাঁড়ান তিনি, এখন দাঁড়ান মাইকের সামনে : ঠোঁটে যৌবনের উচ্ছ্বল হাসি আর সমবেত দর্শকের মধ্যে হিল্লোলিত হয়ে ওঠে আবেগ। মুহূর্তে এক অপার বিস্ময়ে সবাইকে জয় করে নেন তিনি। উপমহাদেশে ও উপমহাদেশের বাইরে এই ঘটনার কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি কোথাও।
এর পরের রুনা লায়লার গল্প আমরা জানি। গত চার দশকে দেশের সংগীতাঙ্গনে হয়ে উঠেছেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী। পেয়েছেন অনেক সম্মান। এভাবে ২০১৪ সালে পূর্ণ হলো তার প্লেব্যাকের ৫০ বছর। এখনও তিনি সমান তালে গেয়ে চলেছেন গান। দেশে-বিদেশে নামি-দামি অনুষ্ঠানে তার ডাক পড়ে।
তার গানের শরীরী ঝংকার ও মাধুর্য নিয়ে আমরা কথা বলেছি। এটি হলো রুনা লায়লার গানের একটি দিক। চোখ বন্ধ করে তার গান শুনুন। দেখবেন দেখার বাইরেও রুনার গানে অশ্রুত অনেক কিছু রয়ে গেছে। তার কণ্ঠের কারুকাজ নিয়ে যাবে সুদূর কোনো দেশে। আপনার মগ্নতা ক্ষণে ক্ষণে রং বদলাবে। রুনা লায়লাও নবীন রঙে জেগে উঠবেন। মনে হবে রুনা লায়লা আসলে এক সাংগীতিক ভ্রমণের পরিপূর্ণ রূপ।
ছবি কথা বলে
রুনা লায়লার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের দিনগুলো সে সময়ের পত্রিকার পাতায় গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়। সেই সব বর্ণাঢ্য ছবি দেখেও বোঝা যায়— সঙ্গীতে নিজের উপস্থিতিকে নানা ভঙ্গিমায় রুনা লায়লা কতটা মোহনীয়; আকর্ষণীয় করেছেন।
*দ্য রিপোর্ট টোয়েন্টিফোরে পূর্ব প্রকাশিত।