Select Page

ছেলেটি আবোল তাবোল মেয়েটি পাগল পাগল : সুস্থধারার সুন্দর নির্মাণের যুগোপযোগী ছবি

ছেলেটি আবোল তাবোল মেয়েটি পাগল পাগল : সুস্থধারার সুন্দর নির্মাণের যুগোপযোগী ছবি

129349বখাটে শাহেদের উৎপাতে টিকতে না পেরে আইরিন আর তার মা মফস্বল ছেড়ে ঢাকায় মামার বাসায় এসে ওঠে। ঢাকার ভার্সিটীতে পড়তে গিয়ে আরজুর সাথে আলাপ। তারপর নানা ঘটনার পর তাদের প্রেম। কিন্তু আরজু নিতান্তই প্লেবয় টাইপের ছেলে। অনেক মেয়ের প্রেমে পড়েছে সে। কিন্তু সত্যিকারের ভালোবাসা কাকে বলে সে জানে না। তবে কি আইরিনের ভালোবাসাকেও স্রেফ ছেলেখেলা ভেবে উড়িয়ে দেবে সে? আর মফস্বলের বখাটে শাহেদও যে পিছু নিয়েছে তাদের। তাহলে এই জটিল প্রেমকাহিনীর পরিণতি কি? এই নিয়েই কাহিনী ‘ছেলেটি আবোল তাবোল মেয়েটি পাগল পাগল‘।

নিখাদ প্রেমের ছবি। আর প্রেমের ছবিতে কাহিনী খুব জমজমাট না হলে দর্শকের মন ভরে না। সেদিক দিয়ে এ ছবির কাহিনীর সামান্য খামতি রয়েছে। ছবির প্রথমার্ধে যতটা আশা জাগিয়েছিল, শেষ অর্ধে সেই আশার প্রতিদান পাওয়া যায়নি কাহিনীতে। বরং বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় সাবপ্লট আর ক্লাইম্যাক্সের দুর্বলতা কাহিনীতে জল ঢেলে দিয়েছে। তারপরও এ ছবির কাহিনী অতি সময়োপযোগী, বিশ্বাসযোগ্য এবং দর্শকের হৃদয়গ্রাহী। বিনোদনের পরিমাণ কিছুটা কম ছিল। তবে ভালো লেগেছে যে জিনিসটা তা হল একেবারে দৈনন্দিন জীবনের কিছু দিক খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে ছবিতে।

চিত্রনাট্য গোলমেলে। এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমন্বয়তার অভাব ছিল। মাঝেমধ্যে হুট করেই এমনভাবে এক দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যে চলে যাওয়া হয়েছে যে সাধারণ দর্শককে ব্যাপারটা বুঝতে কিঞ্চিত বেগ পেতে হয়েছে। তাই বেশ কয়েকবার দর্শকদের মুখে কি হল, কি হল আওয়াজ শোনা গেছে।

সংলাপ সিনেমাটিক না। অল্প কিছু দৃশ্য বাদে প্রায় সবক্ষেত্রেই এমন সংলাপ ব্যবহার হয়েছে যার সাথে দর্শক সহজেই রিলেট করতে পারবে। তাই সংলাপকেও যুগোপযোগিই বলতে হয়। আজকালকার দর্শক এমন সংলাপই চায়। খেয়ে ফেলব, মেরে ফেলব টাইপ সংলাপের দিন শেষ। তবে সংলাপে আরেকটু হাস্যরস থাকলে বোধহয় ভাল হতো।

সাইফ চন্দনের পরিচালনাকে মোটের উপর ভালোই বলা চলে। তবে কিছু বড় ধরণের দুর্বলতা ছিল। যেমন প্রথমত দর্শক সিনেমা হলে ছবি দেখতে গিয়ে যে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ফ্লেভার আশা করে সেটা মিসিং ছিল। টেলিফিল্ম টেলিফিল্ম ভাব ছিল অনেকটা। ফিল্মি ব্যাপারটা কম ছিল। আমি বলছি না যে ফিল্মি ভাব আনতে উরাধুরা ডায়লগ, ঢিসুম ঢিসুম ফাইট আর গল্পের বিড়ালকে গাছে উঠাতে হবে। তারপরও আমার কাছে মনে হয়েছে আনুসাঙ্গিক সবকিছুকে রিয়ালিস্টিক রেখেও পরিচালক কাহিনীর ন্যারেটিভে কিছুটা বৈচিত্র্য এনে সিনেম্যাটিক ভাবটা বজায় রাখতে পারতেন। দ্বিতীয় আরেকটা বিষয়, আজকালকার দিনেও অহেতুক হঠাৎ হঠাৎ গান শুরু হয়ে যাওয়াটা বিরক্তিকর। ছবিতে গানের দরকার আছে কিন্তু কাহিনীর সাথে সম্পর্ক থাকাটাও জরুরি। এই ছবির একটা গানও সিচুয়েশন নির্ভর মনে হয়নি। তো এগুলো ছিল নেতিবাচক দিক। ইতিবাচক দিকও অনেক আছে। প্রথমত পরিচালকের গল্প বলার ধরণটা প্রশংসনীয়। একেবারে প্রথম দৃশ্য থেকেই দর্শকের মনে মুগ্ধতা জাগানো পরিচালনা। নির্মাণশৈলী চমৎকার। আর অবশ্যই যেটা আবারও বলব, কাহিনীর শুরু থেকে শেষ অব্দি বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখা।

একশন এ ছবিতে খুব কম ছিল। যেটুকু ছিল সেটা বেশ ভালো হয়েছে। ফাইট মাস্টারকে ধন্যবাদ যে তিনি ছবির কাহিনী আর চরিত্র মাথায় রেখে কাজ করেছেন। নায়ককে সুপারম্যান বা স্পাইডারম্যান বানিয়ে দেন নাই।

এই ছবির একটা গানও খুব ভাল লাগার মত না। দুই একটা গান শুনতে মোটামুটি ভাল লেগেছে কিন্তু মুগ্ধ করতে পারেনি। তবে গানগুলোর দৃশ্যায়ন ছিল এক কথায় অসাধারণ। কোরিওগ্রাফিও চমৎকার। লোকেশনও নয়নাভিরাম। শুধু যদি গানগুলো সিচুয়েশন নির্ভর হত তাহলে নির্দ্বিধায় গানগুলোকে ভাল বলা যেত।

kayes arju 1

গানগুলোর দৃশ্যায়ন ছিল এক কথায় অসাধারণ। কোরিওগ্রাফিও চমৎকার। লোকেশনও নয়নাভিরাম। শুধু যদি গানগুলো সিচুয়েশন নির্ভর হত তাহলে নির্দ্বিধায় গানগুলোকে ভাল বলা যেত।

অভিনয় এই ছবির একটা প্লাস পয়েন্ট। আরজুকে ভাল লেগেছে। তিনি তার চরিত্রটা যথেষ্ট ভালভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ওভারএক্টিং ছিল না। তাছাড়া এমনিতেও তার চরিত্রটি অতিমানবীয় কিছু ছিল না। প্লেবয় ইমেজটা বাদ দিলে নায়কের চরিত্রটিকে সাধারণই বলা চলে। কিন্তু সেই সাধারণত্বটাও পর্দায় ফুটিয়ে তোলা একটা কঠিন কাজ। সেই কাজটি আরজু ভালোভাবে করেছেন। তার এক্সপ্রেশন ভাল ছিল, ডায়লগ ডেলিভারিও ভাল। একজন ‘অভিনেতা’ হিসেবে তাকে ৮০ পার্সেন্ট মার্ক দেয়া যায়। কিন্তু ‘কমার্সিয়াল ছবির নায়ক’ হিসেবে তার ভবিষ্যৎ কেমন হবে সেটা বুঝতে তার আরও কাজের অপেক্ষায় রইলাম।

আইরিনও খুব ভাল। অতি সাবলীল অভিনয় করেছেন। নায়িকাসুলভ ন্যাকামি অপেক্ষাকৃত কম। তার অভিনয় ইদানিংকালের অধিকাংশ নায়িকার চেয়েই ভাল। তার চেহারা আর আকর্ষণীয় ফিগারও একটা প্লাস পয়েন্ট।

ছবির শুরুর দিকে সবচেয়ে ভালো লাগছিল শাহেদকে। তার হাঁটাচলা, ডায়লগ ডেলিভারি, এক্সপ্রেশন, একশন, লুক সবকিছুই নায়কদের মত। এবং তার ফলে বোঝা গেল পরিচালকরা চাইলে নায়ক হিসেবে তিনি ভালোই করতে পারতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, শুরুটা চমৎকার হলেও কাহিনীর এগিয়ে চলার সাথে সাথে তার চরিত্রটি যতটা দানা বাধার কথা ছিল, সেটা হয়নি। ফলে ছবির প্রথম দিকে তার কাজ দেখে যে মুগ্ধতা সৃষ্টি হয়েছিল তার রেশ শেষ পর্যন্ত থাকেনি। তারপরও এই ছবির সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি মানবো ‘এন্টি হিরো’ শাহেদের অসাধারণ অভিনয়কেই।

সবমিলিয়ে ‘ছেলেটি আবোল তাবোল মেয়েটি পাগল পাগল‘ একটি সুস্থধারার, চলনসই গল্পের, ভালো নির্মাণের, ভাল একটি ছবি। ছবি মুক্তির আগে পোস্টারের কারণে ছবিটার নামে অশ্লীলতার অপবাদ জুটেছিল। কিন্তু ছবিতে সেসব অশ্লীলতা খুব একটা দেখা যায়নি। বরং পরিবারের সবার সাথে মিলে দেখার মত একটা আদর্শ ছবিই বলব এটিকে। বিনোদনের কমপ্লিট প্যাকেজ যাকে বলে তা এ ছবি না। তাই সর্বস্তরের দর্শকের চাহিদা হয়ত এ ছবি মেটাতে পারবে না, কিন্তু রুচিশীল শিক্ষিত শ্রেণীর দর্শক ছবিটা দেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেই বাড়ি ফিরতে পারবেন।


Leave a reply