
জংলি: বাণিজ্যিক কাঠামোয় এক মানবিক বিপ্লব
‘জংলি’র পরিচালক বাণিজ্যিক সিনেমার পাঁচফোড়নের সঙ্গে একটি মানবিক গল্প বললেন এই সিনেমায়। এআই টেকনোলজির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা মানুষের ভেতরে এখনো যে কত আবেগ লুকিয়ে আছে তা সিনেমাটির গল্প বুননের মুনশিয়ানার কারণে প্রতিফলিত হয় হলভর্তি দর্শকদের চোখে…
মা-বাবা হয়ে উঠা বায়লোজিক্যাল কোনো বিষয় না। এইটা মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। আবার পারিবারিক, সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক চাপে বায়লোজিক্যাল অনেক মা-বাবাও সন্তানের দায়িত্ব নিতে অপারগতা দেখায়। এমন নির্মম সত্যগুলো আমাদের মাঝেই রয়েছে।
শুধুমাত্র পিতৃপরিচয় দিতে না পারার দায়ে কত ইঁদুর, কুকুর কিংবা বিড়াল দিয়ে আহত কিংবা মৃত নবজাতকদের আমরা দেখতে পাই লোকালয়ের আশপাশের বর্জ্য ফেলে দেয়া স্থানগুলোতে।

অদ্ভুত এক মানবিকতা আমাদের সমাজ ব্যবস্থা আমাদের মননে তৈরি করে দেয়। যেখানে মৃত কিংবা আহত নবজাতকের প্রতি আমাদের মায়ার কোনো শেষ নেই। কিন্তু সেই নবজাতকের মায়ের প্রতি আমাদের ঘৃণারও শেষ নেই। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কাছে নিজের সন্তানের পিতৃপরিচয় দিতে না পারা সেই মা যদি নিজ দায়িত্বে ওই সন্তানকে বড় করতে চায় সমাজ কোনোদিন তা মেনে নিতে চায় না। এমনকি এই রাষ্ট্রও পিতৃপরিচয় ছাড়া ওই নবজাতকের জন্ম নিবন্ধন গ্রহণ করে না।
আজ থেকে সহস্র বছর আগের কুন্তিপুত্র কর্ণ কিংবা মেরিপুত্র যিশুকে আমরা মেনে নিতে পারলেও এই সময়ে কর্ণ কিংবা যিশুদের কোনো স্থান নেই আমাদের সমাজে। আবার একই নবজাতককে যদি তার জন্মদায়িনী মায়ের বুক থেকে আলাদা করা যায় তখন রাষ্ট্র কিংবা সমাজ সেই শিশুকে তার মিথ্যা পিতৃপরিচয়ের কোলে নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করে।
এম রাহিম পরিচালিত ‘জংলি’ সিনেমা দেখলাম সম্প্রতি। ‘জংলি’ একটি বাণিজ্যিক সিনেমা। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রগুলো পুঁজিবাজারের লগ্নিকৃত অর্থে নির্মিত হয়। আর এই পুঁজিবাজারের প্রভুদের সব সময় চেষ্টা থাকে সমাজকে কুসুম কুসুম আনন্দ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা। যেকোনো রাষ্ট্রের পুঁজিবাজার সচেতন কিংবা জাগ্রত নাগরিকদের ভয় পায়।
এই পুঁজিবাজার সব সময় জনসাধারণের মননে এমন এক বিশ্বাস তৈরি করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে যা দেখে সাধারণ মানুষেরা মনে করে আমাদের সমস্যা সমাধানে সব সময় কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি এগিয়ে আসবে। নিজেদের সমস্যা যে নিজেরই সমাধান করতে হবে এই আত্মবিশ্বাস ইচ্ছাকৃতভাবেই মানুষের ভেতর থেকে নষ্ট করা হয়।
আমি ‘জংলি’ সিনেমার প্রযোজক টিমকে সালাম জানাই পুঁজিবাজারের প্রচলিত ধারাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে কেবল একটি ফর্মুলা সিনেমা নির্মাণ না করে তারা সামাজিক দায় বুকে নিয়ে গল্প নির্ভর একটি সিনেমায় শ্রম এবং অর্থ লগ্নি করেছেন।
‘জংলি’র পরিচালক বাণিজ্যিক সিনেমার পাঁচফোড়নের সঙ্গে একটি মানবিক গল্প বললেন এই সিনেমায়। এআই টেকনোলজির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা মানুষের ভেতরে এখনো যে কত আবেগ লুকিয়ে আছে তা সিনেমাটির গল্প বুননের মুনশিয়ানার কারণে প্রতিফলিত হয় হলভর্তি দর্শকদের চোখে।
সিনেমাটির গল্পের মূল বিষয় হচ্ছে, মুখ্য পুরুষ চরিত্র জনি এবং ছয় বছরের শিশু চরিত্র পাখির মানবিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে। গল্পটিকে এগিয়ে নিতে আমরা আরো অনেক চরিত্রকে পেলেও দর্শকদের মগজে জনি ওরফে জংলি এবং পাখির আবেগী মোমেন্টগুলোই বেশির ভাগ স্থান দখল করে।
অভিনয়ের আলাপে আসলে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অভিনেতা সিয়াম আহমেদ। সিয়ামের বিগত দিনের সিনেমাগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, তিনি অভিনয়ে যেন নিজেকেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখছেন। ২০১৮ সালের ‘পোড়ামন ২’-এর সুজন চরিত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী ২০২১ সালের ‘টান’ সিনেমার রাশেদ চরিত্রের সঙ্গে। আবার ২০১৯ সালের ‘ফাগুন হাওয়ায়’ নাসির চরিত্রের সঙ্গে ২০২২ সালের ‘পাপ পুণ্য’ সিনেমার আল আমিন চরিত্রের। এই দিকে ২০২১ সালের ‘মৃধা বনাম মৃধা’র আশফাকুল মৃধা চরিত্রের সঙ্গে ২০২৫ সালের ‘জংলি’ সিনেমার জনি চরিত্রের। এমনই ধারাবাহিকভাবে সিয়াম আহমেদ নিজের কমফোর্ড জোন ভেঙে একটিকে ছাড়িয়ে অন্যটিতে এগিয়ে যাওয়ার তাড়না আমরা পর্দায় দেখতে পাই। তবে ‘জংলি’ সিনেমায় জংলি চরিত্রটির ভেতর দিয়ে অভিনেতা সিয়াম আহমেদ তার ক্যারিয়ারের একটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করলেন।

এবার শিশুশিল্পী নৈঋতার আলাপে আসি। ‘জংলি’ সিনেমায় নৈঋতা অভিনয় করেছে পাখি চরিত্রে। তার সাবলীল অভিনয় জনি চরিত্রটিকে বেশি ফুটিয়ে তুলেছে। এই দিক থেকে বলতে হবে সিয়ামের কো-আর্টিস্ট হিসেবে নৈঋতার অভিনয়ের কারণে জনি চরিত্রটিতে তার অভিনয় বুস্ট হয়েছে। বলতে গেলে জংলি চরিত্রটিতে সিয়ামের হিংস্রতার অভিনয় পাখি চরিত্রটির সফল প্রতিফলনের ফল। শিশুশিল্পী নৈঋতার অভিনয় দক্ষতা পাখি চরিত্রটির সঙ্গে দর্শকদের আবেগী সম্পর্ক তৈরি করে দেয়। দর্শক পাখির আনন্দে আনন্দিত হয় আবার পাখির কষ্টে কষ্ট পায়।
‘জংলি’ সিনেমায় তিথি চরিত্রে অভিনয় করেছেন শবনম বুবলি। বুবলি বরাবরের মতোই চরিত্র বুঝেই এই সিনেমায় যতটুকু দরকার ততটুকু অভিনয় করেছেন। আমার কাছে বর্তমান সময়ে পুপুলার সিনেমার অভিনেত্রীদের মধ্যে শবনম বুবলিকে অভিনয়ের ক্ষেত্রে খুব সিরিয়াস অভিনেত্রী মনে হয়। অভিনয়ে তার এমন ডেডিকেশন খুব কম অভিনেত্রীদের মাঝে দেখি।
‘জংলি’ সিনেমায় তিথি চরিত্রটি হচ্ছে গল্পের কথক। যার বলা গল্প থেকে সিনেমাটি দর্শক ভিজ্যুয়াল করে। এই চরিত্র বুবলির সামান্য অতিঅভিনয় গল্পটিকে নষ্ট করে ফেলতে পারত। কিন্তু বুবলি সংযমের ভেতর দিয়ে চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছেন। একজন কথকের ভেতরে যদি সামান্য আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয় যে স্ক্রিনে নিজের উপস্থিতি একটু বোল্ড আকারে হাজির করবে, তখনই সমস্যাটা ঘটে যায়। বাকি চরিত্রগুলো ম্লান হয়ে যায়। যে সর্বনাশটা আমরা নির্মাতা এন রাশেদ চৌধুরীর ২০২১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘চন্দ্রাবতী কথা’ চলচ্চিত্রে দেখতে পাই। যেখানে কথকের অতিঅভিনয় মুখ্য চরিত্রসহ সকল চরিত্রকে ম্লান করেছে।
‘জংলি’ সিনেমায় সুজন চরিত্র অভিনয় করেছেন রাশেদ মামুন অপু। চরিত্রটি সিনেমার ক্লাইমেক্স অংশে খুব ভালো করলেও প্রথম থেকে অতিঅভিনয় স্ক্রিনে তাকে আলাদা করছিল। এই ধারাটা একটা সময় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে ছিল। কিন্তু এখন তেমন একটা দেখা যায় না। কারণ খাপছাড়া খাপছাড়া অতিঅভিনয়ের ভাঁড় চরিত্র সিনেমার ক্ষতি করে বুঝতে পেরে স্ক্রিপ্টরাইটাররা বর্তমান সময়ের চলচ্চিত্রে এ চরিত্রগুলোকে আর হাজির করেন না। তবে এখানে রাশেদ মামুন অপুর ব্যর্থতা দেখি না। পরিচালক চাইলেই অন্যভাবে তার শুরুর দিকের দৃশ্যগুলোর অভিনয় উপস্থাপন করতে পারতেন। কিন্তু পরিচালক যদি এই অভিনয়ে সন্তষ্ট থাকেন তখন আর অভিনেতার ওপর ভালো না করার দায় দেয়া যায় না।
এখানে মোটা দাগে ‘জংলি’ চলচ্চিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে আলোচনা করলাম। বাকি চরিত্রগুলো নিয়ে আলোচনা করলে লেখাটি অনেক বড় হবে। তাই অভিনয় প্রসঙ্গটি এখানে শেষ করে স্ক্রিপ্টের দিকে মনযোগ দেয়া দরকার।

বর্তমান সময়ের সিনেমার স্ক্রিপ্টগুলো দেখলে মনে হয় সব স্ক্রিপ্টই যেন আবেগহীন এআই দিয়ে তৈরি। যেখানে আবেগঘন মুহূর্তের চেয়ে আবেগহীন কিছু ইভেন্টের প্রতি রাইটারের মনযোগ বেশি। একজন স্ক্রিপরাইটারের বুকে জগৎসংসার নিয়ে অনেক মায়া না থাকলে ‘জংলি’ সিনেমার মতো এমন একটি আবেগঘন মানবিক স্ক্রিপ্ট লেখা অসম্ভব। এই দিক থেকে সুকৃতি সাহা ও মেহেদী হাসান অসাধারণ একটি কাজ করেছেন। অসাধারণ মানেই নির্ভুল এমনটা নয়। মানবিক রাইটার বাণিজ্যিক ইভেন্ট অ্যাডাপটেশনের যে দুর্বলতাগুলো ছিলো সেগুলোর বিষয়ে নজর দিলে অ্যাকশন দৃশ্যগুলো আরোপিত মনে হতো না। শুধু টুইস্ট দেয়ার জন্য প্রার্থনা ফারদিন দিঘী অভিনীত নূপুর চরিত্রটির সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে। অথচ এই চরিত্রটিই গল্পের বুনিয়াদ তৈরি করে। বাহির থেকে দেখে এই দায় কেবল স্ক্রিপ্টরাইটারদ্বয়কে দেয়া যায় না। স্ক্রিপ্টরাইটার এতএত সফল চরিত্র নির্মাণ করে একটি চরিত্রকে অসম্পূর্ণভাবে হাজির করবেন দর্শকের সামনে, এমনটা হওয়ার কথা নয়। এর সঙ্গে পরিচালক ও সম্পাদকেরও যোগসূত্র থাকতে পারে।
সম্পাদকের প্রশ্ন আসায় ‘জংলি’ সিনেমার সম্পাদনা নিয়ে একটু আলাপ করা যাক। সিনেমাটির সম্পাদনা করেছেন মো. কালাম। সম্পাদনায় খুব দ্রুত কাট ব্যবহার করে সম্পাদক অস্থির দর্শকদের বেশ ভালোই ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দ্রুত কাটের ব্যবহার যে সব সময় সম্পাদনার টাইম লাইনের তাল ও লয় ধরে রাখতে পেরেছে তেমনটাও নয়। আর সেই কারণে সিনেমাটির বেশ কিছু জায়গায় ঝুলে পড়েছিল। এখানেও একটা টুইস্ট আছে। এর জন্য যে কেবল সম্পাদক দায়ী তাও নয়। এখানে অনেকটা দায় সিনেমাটোগ্রাফার এবং পরিচালকের। সিনেমার ডিসটিউন ফুটেজ সম্পাদকের হাতে দিয়ে সম্পাদক আর কতটাই বা পরিচালক এবং সিনেমাটোগ্রাফারকে বাঁচিয়ে দিবেন?
‘জংলি’র সিনেমাটোগ্রাফির প্রায় ৮০ ভাগ ফুটেজ গল্পকে সার্ভ করলেও ২০ ভাগ ফুটেজ ছিল ডিসটিউন অর্থাৎ দেখতে ‘জংলি’ সিনেমার ফুটেজ মনে হয়নি। বরং আরোপিত কিছু মনে হয়েছে। একটি প্রজেক্টে লম্বা সময় কাজ করতে করতে পরিচালক এবং সিনেমাটোগ্রাফারের এমন খেই হারিয়ে ফেলা অস্বাভাবিক নয়। তবে পরিচালক এই দিকে যত্নবান হলে চলচ্চিত্রটি আরো ভালো উচ্চতায় পৌঁছাতে পারত।
জনি ও পাখি দুই চরিত্রের জন্য পরিচালক সিনেমাটিকে একটি নেগেটিভ জগৎ থেকে পজেটিভ জগতে নিয়ে যেতে দুইটা ট্রানজিশন দৃশ্য রেখেছেন। দুইটা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে চরিত্র দুটির ব্যাকগ্রান্ডে আমরা বিশাল আকারের পাহাড় দেখতে পাই। এখানে সিনেমাটির একটি কাব্যিক রূপ উপস্থাপন হলেও পরে আর সেই রূপ আমাদের মাঝে হাজির হয় না। সিনেমাটি এখানে এসে একটি মহাকাব্যিক রূপ নিতে পারত। ‘জংলি’ সিনেমায় কোনো প্রডাকশন ডিজাইনার ছিল কি না আমার জানা নেই। একজন ভালো প্রোডাকশন ডিজাইনার এখানে তার খেলাটা দেখিয়ে দিতে পারতেন। নেগেটিভ ও পজেটিভ জগতের মধ্যে একটি দুর্দান্ত পার্থক্য তৈরি করতে পারতেন।
অপারেশন থিয়েটারের এক অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে ‘জংলি’ সিনেমাটি শুরু হলেও ধীরে ধীরে দর্শকদের মনকে স্থির করে ফেলে। এই সময়ের আবেগহীনতার ভান ধরা মানুষগুলোর চোখ দিয়ে পানি নিয়ে আসে সিনেমাটি। বৃষ্টির পর যেমন একটি সুন্দর আকাশ দেখা যায়, তেমনি ‘জংলি’ সিনেমা শেষ করে হল থেকে বের হওয়া মানুষ গুলোকে দেখে আমার মনে হয়েছে এক একটি সুন্দর মেঘ।