জাকির হোসেন রাজু : পরিচ্ছন্ন নির্মাতা
‘বেদের মেয়ে জোছনা’-খ্যাত পরিচালক তোজাম্মেল হক বকুলের সহকারী হয়ে চলচ্চিত্র জগতে নিজের নাম লিখিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতায় পড়া এক ছাত্র, পরবর্তীতে দিলীপ সোমের জনপ্রিয় সিনেমা ‘দোলা’তে সহকারী পরিচালক হয়ে কাজ করার পর নব্বই দশকের মাঝমাঝি নিজেকে পূর্নাঙ্গ পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
প্রথম সিনেমাতেই পান বড় সাফল্য, সেই থেকে শুরু এখন পর্যন্ত তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের একজন প্রতিষ্ঠিত নির্মাতা, পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। তার বেশিরভাগ ছবিই ছিল রোমান্টিক-সামাজিক ধারার, তিনি জাকির হোসেন রাজু।
বাংলা চলচ্চিত্রের সেই দুঃসময়ে বহু বাণিজ্যিক ধারার সফল নির্মাতারা অশ্লীল সিনেমা নির্মাণে জড়িয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু তিনি তরুণ নির্মাতা হয়েও অশ্লীল সিনেমায় তিনি নাম লিখাননি, তার জন্য সাধুবাদ প্রাপ্য।।
১৯৬৪ সালের আজকের এইদিনে (১৫ জানুয়ারি) জন্মগ্রহণ করা এই পরিচালকের প্রতি রইল শুভেচ্ছা।
জাকির হোসেন রাজুর পরিচালিত চলচ্চিত্রসমূহ—
১৯৯৬ : দুই প্রজন্মের দুই সাড়া জাগানো জুটিকে নিয়ে ভালোবাসা ও পারিবারিক আবহে নির্মাণ করেন প্রথম সিনেমা ‘জীবন সংসার’, অভিনয় করেছিলেন ফারুক- ববিতা ও সালমান শাহ-শাবনূর জুটি। সিনেমাটি ছিল সেই বছরের অন্যতম সেরা ব্যবসাসফল সিনেমা, এই সিনেমার ‘পৃথিবীতে সুখ বলে’ গানটি দর্শকমনে অর্জন করে নিয়েছে বিশেষ স্থান। সিনেমাটি ব্যবসা করার পাশাপাশি নন্দিত ও হয়েছিল। পরিতাপের বিষয়, এই সিনেমার প্রযোজক সম্প্রতি আত্বহত্যা করেছেন।
১৯৯৮ : দুই প্রজন্মের ভালোবাসার মান-অভিমান নিয়ে মতিউর রহমান পানুর প্রযোজনায় নির্মাণ করেছিলেন ‘এই জীবন তোমার আমার’। এই সিনেমায় ফারুক, ববিতা, রিয়াজের পাশাপাশি অভিনয় করেছিলেন অভিষিক্ত নায়িকা পূর্ণিমা। বাণিজ্যিক সাফল্য না এলেও পরবর্তীতে সুনির্মিত সিনেমা হিসেবে বেশ সমাদৃত হয়েছিল, গানগুলো ও ছিল শ্রুতিমধুর।
২০০০ : নব্বই পরবর্তী অন্যতম জনপ্রিয় তিন তারকা শাবনূর, রিয়াজ ও পূর্ণিমাকে নিয়ে মেঘনা কথাচিত্রের ব্যানারে নির্মাণ করেছিলেন ত্রিভুজ প্রেমের সিনেমা ‘নিঃশ্বাসে তুমি বিশ্বাসে তুমি’। ছবিটি বাণিজ্যিক সফলতার পাশাপাশি প্রশংসিত ও হয়েছিল, পূর্ণিমার ক্যারিয়ারের এটি অন্যতম সেরা সিনেমা।
২০০২ : এই বছর নির্মাণ করেন দুইটি সিনেমা। এর মধ্যে একটি ‘ভালোবাসা কারে কয়’, অভিনয় করেন রিয়াজ, শাবনূর, বাপ্পারাজ, রাজিব’সহ আরো অনেকে। আব্দুর রউফ মোল্লা প্রযোজিত এই ছবিটিও বাণিজ্যিকভাবে বেশ সফল হয়, গানগুলিও শ্রুতিমধুর, পাশাপাশি শাবনূর-রিয়াজ জুটির অন্যতম সেরা সিনেমা এটি। অন্যদিকে কাঁকন ফিল্মসের ব্যানারে আলমগীর-শাবনূর-রিয়াজকে নিয়ে নির্মাণ করেন ‘মিলন হবে কত দিনে’, তবে সিনেমাটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হতে ব্যর্থ হয়।
২০০৭ : অশ্লীলতা ভয়াবহতার জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন, পাঁচ বছর বিরতি দিয়ে নির্মাণে এসে মো. আব্দুল কালামের প্রযোজনায় এই বছর নির্মাণ করেন দুইটি সিনেমা। প্রথমটি পারিবারিক গল্পের ছবি ‘স্বামীর সংসার’, অভিনয় করেছিলেন সোহেল রানা, ববিতা, শাকিব খান, অপু বিশ্বাস’সহ আরো অনেকে। তবে সিনেমাটি বাণিজ্যিকভাবে সফলতা পায়নি। অন্যদিকে ববিতা-শাকিব খান-পূর্ণিমাকে নির্মাণ করেন ‘মা আমার স্বর্গ’। ছবিটি বাণিজ্যিক সফলতার পাশাপাশি সুনির্মিত সিনেমা হিসেবেও সমাদৃত হয়েছিল।
২০০৮ : তৎকালীন সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি শাকিব খান-অপু বিশ্বাস জুটিকে নিয়ে নির্মাণ করেছিলেন ‘মনে প্রানে আছো তুমি’, এছাড়া এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক। হার্টবিট প্রোডাকশনের ব্যানারে সিনেমাটি ছিল সেই বছরের অন্যতম সেরা ব্যবসাসফল সিনেমা, এই সিনেমার গান ‘এক বিন্দু ভালোবাসা দাও’ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
২০০৯ : শাকিব খান ও বিদ্যা সিনহা মিমকে নিয়ে হার্টবিট প্রোডাকশনের ব্যানারে নির্মাণ করেন বাণিজ্যিক সফল সিনেমা ‘আমার প্রাণের প্রিয়া’।এই সিনেমার গানের অ্যালব্যাম বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, হৃদয় খানের জনপ্রিয় গান ‘চাই না মেয়ে’ এই সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছিল, এছাড়া ‘কী যাদু করেছো’ গানটিও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এই সিনেমায় নৃত্য পরিচালনার জন্য জাতীয় পুরস্কার পান ঈগল ড্যান্সের কর্ণধার তানজিল আহমেদ।
২০১০ : এই বছর নির্মাণ করেন ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সিনেমা ‘ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না’। মাসটেক্স ফিল্মসের ব্যানারে নির্মিত এই সিনেমাটি সেই বছরের সর্বোচ্চ বাণিজ্যিক সফল ছিলোই, জাতীয় পুরস্কারেও জয়জয়কার ছিল। শাকিব খান, অপু বিশ্বাস, রোমানা অভিনীত ত্রিভুজ প্রেমের গল্প সমৃদ্ধ এই ছবিটি মোট ৭টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার পায়। পরিচালক নিজে পান সেরা কাহিনীকার ও সংলাপ রচয়িতার পুরস্কার, এছাড়া শাকিব খান পান প্রথমবারের মতো জাতীয় পুরস্কার, এছাড়া পুরস্কৃত হন রোমানা, শেখ সাদী খান, এস আই টুটুল ও শাম্মী আখতার। সত্তরের দশকে রেডিওতে প্রচার হওয়া জনপ্রিয় গান ‘ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না’ ব্যবহৃত হয়।
২০১১: আগের বছরে প্রত্যাশা পূরণ করলেও, এই বছর তিনি দর্শকদের হতাশ করেন। শাকিব খান, অপু বিশ্বাস, চঞ্চলা চঞ্চু, মিশা সওদাগরকে নিয়ে নির্মাণ করেন ‘মনের ঘরে বসত করে’, ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হতে ব্যর্থ হয়, পাশাপাশি সমালোচিত ও হয়।
২০১২ : আনন্দমেলা চলচ্চিত্রের ব্যানারে নবীন অভিনয়শিল্পী সাইমন ও জেরিনকে নির্মাণ করেন ‘জ্বি হুজুর’, ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে অসফল হলেও,নন্দিত হয়েছিল।
২০১৩ : এই বছর তিনি নির্মাণ করেন মোট দুইটি সিনেমা। প্রথমটি ‘পোড়ামন’, জাজ মাল্টিমিডিয়ার ব্যানারে নির্মিত ছবিটি ছিল সেই বছরের অন্যতম ব্যবসাসফল সিনেমা, অভিনয় করেন সাইমন, মাহি ও আনিসুর রহমান মিলন। গানগুলোও বেশ শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছিল, নকলের অভিযোগ উঠলেও এই ছবিটি গত কয়েক বছরের অন্যতম সুনির্মিত সিনেমা হিসেবে বিবেচিত হয়, অন্যদিকে সাইমন-নিঝুম রুবিনাকে নিয়ে নির্মিত ছবি ‘এর বেশি ভালোবাসা যায় না’ ছবিটি ফ্লপের শিকার হয়।
২০১৪ : এই বছর জাজ মাল্টিমিডিয়ার ব্যানারে নির্মাণ করেন দুটি সিনেমা। প্রথমটি কমেডি ধাঁচের ছবি ‘দবির সাহেবের সংসার’, অভিনয় করেছিলেন আলীরাজ, মাহি, বাপ্পী, ইমরোজ ও বিশেষ ভূমিকায় ছিলেন শাকিব খান। অন্যদিকে সত্তর দশকের সুপারহিট ছবি ‘ময়না মতি’ রিমেক করেন অনেক সাধের ময়না’ নামে, অভিনয় করেছিলেন মাহি, বাপ্পী ও মিলন। এর মধ্যে দ্বিতীয় সিনেমাটি ব্যবসাসফল হয়।
২০১৬ : এই বছরও মুক্তি পায় দুটি সিনেমা। প্রথমটি চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত ‘অনেক দামে কেনা’, অভিনয় করেছিলেন বাপ্পী, মাহি ও ডিপজল। আরেকটি সিনেমা হলো জাজ মাল্টিমিডিয়ার ব্যানারে যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘নিয়তি’, এটিও একটি বিদেশী সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত, অভিনয় করেছিলেন আরিফিন শুভ ও জলি। এই ছবিতে জনপ্রিয় গান ‘অনেক সাধনার পরে’ নতুন করে রিমেক করা হয়, ‘ঢাকাই শাড়ী’ গানটিও শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছিল। প্রথমটি ব্যবসায়িক ভাবে ফ্লপ হলেও,দ্বিতীয়টি মোটামুটি সাড়া জাগিয়েছিল। এছাড়া সিনেমা দুটিই সম্প্রতি জাতীয় পুরস্কারের কমিটিতে মনোনীত হয়েছে।
২০১৭ : জাজ মাল্টিমিডিয়ার ব্যানারে আরিফিন শুভ ও নুসরাত ফারিয়াকে নির্মাণ করেন ‘প্রেমী ও প্রেমী’, একটি বিদেশি সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত এই ছবিটি মোটামুটি সাড়া জাগিয়েছে, এই সিনেমার টাইটেল সং শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছে।তবে এই ছবিটি দেখে অনেকেই মন্তব্য করেছিলেন এইখানে সেই নির্মাতা রাজুকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
২০১৮ : বেশ কয়েক বছরের আস্থাভাজন প্রযোজনা সংস্থা থেকে বেরিয়ে এসে প্রতিশ্রুতিশীল প্রযোজনা সংস্থা দ্য অভি কথাচিত্রের ব্যানারে নির্মাণ করেছেন ‘ভালো থেকো’, অভিনয় করেছেন আরিফিন শুভ, তানহা তাসনিয়া ও ইমরোজ। আসছে ভালোবাসা দিবসে মুক্তি পাচ্ছে সিনেমাটি। ছবিটি নিয়ে দর্শকমনে আগ্রহ উঠেছে, প্রত্যাশা রইলো– এই ছবিটি দর্শকদের প্রত্যাশা পূরনে সমর্থ হবে। কয়েক বছর ধরেই তিনি কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাচ্ছেন না,আশা রাখি এই সিনেমা দিয়ে সফল প্রত্যাবর্তন হবে।
‘জীবন সংসার’ থেকে ‘ভালো থেকো’ মোট সিনেমা নির্মাণ করেছেন ২০টি সিনেমা, ভবিষ্যতেও নিজেকে এই ধারায় সমুজ্জ্বল রাখবেন, এই আশা রাখি।