জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা
রুবাইয়াত হোসেন নির্মিত তৃতীয় চলচ্চিত্র ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ (২০১৯) মুক্তি পেয়েছে। তাঁর প্রথম ছবি ছিল ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন।’ ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ নামে আরো একটি ছবি নির্মিত হয়েছিল যার পরিচালক ছিলেন মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী। দুটি ছবি দুই প্রেক্ষাপটে নির্মিত।
‘মেড ইন বাংলাদেশ’ পোশাক শ্রমিকদের সংগ্রামী জীবন, তাদের প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা, বৈষম্য, শ্রমিকদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, বেআইনি পদক্ষেপ নেয়া এবং এগুলোর বিপরীতে শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনভাবে নেতৃত্ব তৈরির মতো জরুরি বিষয়গুলো নিয়ে নির্মিত। ছবিটি বাংলাদেশ, ডেনমার্ক, যুক্তরাষ্ট্র, পর্তুগালের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত। টরেন্টো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়েছে ক্রিটিকদের প্রশংসাসহ।
‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’ গানের এ লাইনটি ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ছবিকে পরিচিতি দেয়ার জন্য যথেষ্ট। পরিচালক রুবাইয়াত হোসেন বক্তব্যধর্মী ছবির নির্মাতা হয়ে উঠেছেন প্রথম ছবি ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’-এ, দ্বিতীয় ছবিতেও তাই করেছেন তিনি। সমাজের জরুরি সমস্যার প্রতি দৃষ্টিপাতই তাঁর ছবির বক্তব্য। পোশাক খাতের বাস্তবতা, দুর্নীতি দেশের বড় একটি সমস্যা। নারী-পুরুষ শ্রমিকদের আলাদাভাবে ট্রিট করা হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটা শাসনের মানসিকতা প্রশাসনিকভাবে অনেক ক্ষেত্রে থাকে পোশাক খাতটাও তেমনই। কিন্তু নারী চাইলে বাধার মুখেও নিজের অধিকার আদায়ের পদক্ষেপ নিতে পারে। সেই পদক্ষেপ থেকে নতুন কিছু সৃষ্টির ছবিই হচ্ছে ‘মেড ইন বাংলাদেশ।’
গল্পটা সহজ। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ করে কিছু মেয়েরা। একদিন আগুন লেগে একজন মারা যায় তারপর প্রতিষ্ঠান ছক আঁকতে থাকে শ্রমিকদের ঠকানোর। সেগুলোর মুখে পড়ে একজনের নেতৃত্বে কয়েকজন মেয়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। প্রতিবাদটা ক্রমশ বড় হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত এমন একটা জায়গায় গিয়ে পড়ে যেখানে একজন সাধারণ শ্রমিকই অনেকের জন্য আদর্শ হয়ে ওঠে। কিন্তু কিভাবে! সেটাই ছবির পিনপয়েন্ট।
এই গল্পকে পরিচালক উপস্থাপন করেছেন কয়েকটি ধাপে –
১. পোশাক শ্রমিক
২. অনিয়ম
৩. প্রতিবাদ
৪. প্রাতিষ্ঠানিক সেবা
৫. চূড়ান্ত কিছু
ধাপগুলোকে ডিটেইল দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। খুব সূক্ষভাবে শ্রমিকদের খাটুনি, মালিকদের অনিয়ম, শ্রমিকদের প্রতিবাদী অবস্থান, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা এবং চূড়ান্ত কিছুর দিকে যাত্রা করা দেখানো হয়েছে। ছবির ক্লাইমেক্সটি ছিল অনবদ্য। ক্লাইমেক্সের দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই দর্শক বুঝে যাবে নারী কিভাবে ‘বহ্নিশিখা’ হয়ে ওঠে। এখানে নারীর সৎসাহস, মেধা, বুদ্ধির একটা চমৎকার মেলবন্ধন ঘটেছে। পোশাক শ্রমিকদের নিজেদের ভেতরের বিনোদন, মজা-ঠাট্টা, ব্যক্তিজীবনও ছবিতে উঠে এসেছে। ডিটেইলে স্টোরি টেলিং ছবির টোটালিটি তুলে ধরতে সাহায্য করেছে।
প্রধান চরিত্রে রিকিতা নন্দিনী শিমু অসাধারণ অভিনয় করেছে। মেয়েটি পরিচালকের আগের ছবিতেও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে ছিল। অভিনয়ে লেগে থাকলে তাঁর ভবিষ্যৎ ভালো। বিদেশ থেকে পুরস্কৃতও হয়েছে শিমু। ডালিয়া চরিত্রে নভেরা ইম্প্রেসিভ। শাহানা গোস্বামী তার ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী পারফেক্ট চরিত্রই করেছে। অন্যান্য চরিত্রে মোস্তফা মনোয়ার, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, শতাব্দী ওয়াদুদ, জয়রাজ নিজেদের স্বাভাবিক অভিনয় করে গেছে।
রুবাইয়াৎ হোসেনের ক্যামেরা জীবন্ত হয়ে কথা বলেছে পুরো ছবিতে। দিনরাতের প্রকৃত ফিল দিতে পেরেছে তাঁর ক্যামেরার ভাষা। ধোঁয়া ওঠা রাস্তায় শিমুর হেঁটে যাওয়ার শট অনবদ্য। স্টিল লাইফের গুরুত্ব ছিল বেশি পুরো ছবির শটে এটা তিনি ছবির বিষয়বস্তু থেকে সচেতনভাবেই করেছেন।
‘মেড ইন বাংলাদেশ’ এ বছরের সেরা ছবি এখন পর্যন্ত।
রেটিং – ৮.৫/১০