জাতীয় পুরস্কারে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র
মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতার পর থেকেই চলচ্চিত্র নির্মান শুরু হয়েছে। চাষী নজরুল ইসলাম নির্মান করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম চলচ্চিত্র – ওরা ১১ জন। প্রতি বছরই মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এর মধ্য থেকে সুনির্মিত চলচ্চিত্রগুলো যোগ্যতার বলে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। এই পোস্টে আমরা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের তালিকা উপস্থাপন করছি।
১. মেঘের অনেক রং (১৯৭৬)
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র পুরস্কৃত হয় ‘মেঘের অনেক রং’।সাদা কালো এই ছবিটি পরিচালনা করেন ‘হারুনুর রশীদ’।সিনেমাটি মোট ৫ টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।
১. সেরা চলচ্চিত্র
২. সেরা পরিচালক- হারুনুর রশীদ
৩. সেরা সংগীত পরিচালক- ফেরদৌসি রহমান
৪. সেরা শিশু শিল্পী- আদনানা
৫. সেরা চিত্রগ্রাহক- হারুন আল রশিদ।
২. একাত্তরের যীশু (১৯৯৩)
শাহরিয়ার কবিরের উপন্যাস অবলম্বনে নাসির উদ্দিন ইউসুফ নির্মান করেন ‘একাত্তরের যীশু’। প্রশংসিত এই সিনেমাটি মাত্র ১ টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।
১. সেরা সংলাপ রচয়িতা- সেলিম আল দীন
৩. আগুনের পরশমনি (১৯৯৪)
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের নির্মিত প্রথম ছবি ‘আগুনের পরশমনি’।মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই চলচ্চিত্রটি তখন বেশ জনপ্রিয়তা পায়।সরকারী অনুদানে নির্মিত এই সিনেমাটি মোট ৮ টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।
১. সেরা চলচ্চিত্র
২. সেরা কাহিনীকার- হুমায়ূন আহমেদ
৩. সেরা সংলাপ রচয়িতা- হুমায়ূন আহমেদ
৪. সেরা সংগীত পরিচালক- সত্য সাহা
৫. সেরা অভিনেত্রী- বিপাশা হায়াত
৬. সেরা শিশু শিল্পী- শীলা আহমেদ
৭. বিশেষ শাখায় সেরা শিশু শিল্পী- হোসনে আরা পুতুল
৮. সেরা শব্দগ্রাহক- মফিজুল হক।
৪. নদীর নাম মধুমতি (১৯৯৫)
তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত প্রশংসিত চলচ্চিত্র ‘নদীর নাম মধুমতি’ মোট ৩ টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।
১. সেরা কাহিনীকার- তানভীর মোকাম্মেল
২. সেরা সংলাপ রচয়িতা- তানভীর মোকাম্মেল
৩. সেরা গায়ক- সাইদুর রহমান বয়াতী।
৫. হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৯৭)
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম নির্মান করেন ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। এই সিনেমায় সুচরিতার অনবদ্য অভিনয় সবার মন ছুঁয়ে যায়। সরকারী অনুদানে নির্মিত এই সিনেমাটি মোট ৩ টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।
১. সেরা পরিচালক- চাষী নজরুল ইসলাম
২. সেরা কাহিনীকার- সেলিনা হোসেন
৩. সেরা অভিনেত্রী- সুচরিতা।
৬. এখনো অনেক রাত(১৯৯৭)
কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার ও সংগীতজ্ঞ খান আতাউর রহমান নির্মিত শেষ চলচ্চিত্র ‘এখনো অনেক রাত’।মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই চলচ্চিত্রের কিছু দৃশ্য সেন্সর বোর্ড বাদ দেওয়ার কথা বললে খান আতা আপত্তি জানান।সিনেমাটি মোট ২ টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।
১. সেরা সংগীত পরিচালক- খান আতাউর রহমান
২. সেরা সুরকার- খান আতাউর রহমান।
৭. চিত্রা নদীর পাড়ে (১৯৯৯)
বাংলাদেশে দেশভাগ নিয়ে নির্মিত একমাত্র চলচ্চিত্র ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’।সিনেমাটি পরিচালনা করেন স্বনামধন্য পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল।ভূয়শী প্রশংসা পাওয়া এই সিনেমাটি মোট ৭ টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।
১. সেরা চলচ্চিত্র
২. সেরা পরিচালক – তানভীর মোকাম্মেল
৩. সেরা কাহিনীকার – তানভীর মোকাম্মেল
৪. সেরা সংলাপ রচয়িতা – তানভীর মোকাম্মেল
৫. সেরা সহ অভিনেত্রী – রওশন জামিল
৬. সেরা শিল্প নির্দেশক – উত্তম গুহ
৭. সেরা রুপসজ্জাকর- দীপক কুমার সুর।
৮. মাটির ময়না (২০০২)
বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা সিনেমা ‘মাটির ময়না’। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের প্রথম পূর্নদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এটি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই চলচ্চিত্রটি কান উৎসবে পুরস্কৃত হয়, পাশাপাশি বাংলাদেশের হয়ে প্রথম অস্কারে প্রতিনিধিত্ব করে। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে বলে দাবী করলে সেই সময়ের সরকার সিনেমাটিকে নিষিদ্ধ করে, পরবর্তীতে অবশ্য কয়েক মাস পরেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। জাতীয় পুরস্কারে সিনেমাটিকে অবমূল্যায়িত করায় বেশ বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এই পুরস্কারের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিতর্ক এই সিনেমা নিয়েই হয়। অনেকেই একে রাজনৈতিক চাপ বলে উল্লেখ করেন। সিনেমাটি মাত্র ৩ টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।
১. সেরা চিত্রনাট্যকার- তারেক মাসুদ
২. সেরা শিশু শিল্পী- রাসেল ফরাজী
৩. বিশেষ শাখায় সেরা শিশু শিল্পী- নুরুল ইসলাম বাবলু।
৯. বীর সৈনিক (২০০৩)
স্বনামধন্য পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘বীর সৈনিক’ ২ টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।
১. সেরা অভিনেতা- মান্না
২. সেরা সহ অভিনেত্রী- সাথী।
১০. জয়যাত্রা (২০০৪)
আমজাদ হোসেনের ‘অবেলায় অসময়’ অবলম্বনে জনপ্রিয় অভিনেতা তৌকির আহমেদ নির্মান করেন ‘জয়যাত্রা‘।এটি ছিল তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র। এই সিনেমার অভিনয় শিল্পীরা কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই কাজ করেন।সর্বমহলে প্রশংসিত এই সিনেমাটি মোট ৭ টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।
১. সেরা চলচ্চিত্র
২. সেরা পরিচালক- তৌকির আহমেদ
৩. সেরা কাহিনীকার- আমজাদ হোসেন
৪. সেরা সংলাপ রচয়িতা- তৌকির আহমেদ
৫. সেরা সংগীত পরিচালক- সুজেয় শ্যাম
৬. সেরা সহ অভিনেত্রী- চাঁদনী
৭. সেরা চিত্রগ্রাহক- রফিকুল বারী চৌধুরী।
১১. মেঘের পরে মেঘ (২০০৪)
কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম নির্মান করেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘মেঘের পরে মেঘ‘। সর্বমহলে প্রশংসিত এই সিনেমায় রিয়াজ ও পূর্নিমার অনবদ্য অভিনয় সিনেমাটিকে বেশ প্রানবন্ত করেছে। তবে তাদের জাতীয় পুরস্কার না পাওয়ায় অনেকেই হতাশ হন।সিনেমাটি মাত্র ১ টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।
১. সেরা গায়ক- সুবীর নন্দী।
১২. গেরিলা (২০১১)
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের। ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাস ও নিজস্ব অভিজ্ঞতা অবলম্বন করে নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু নির্মান করেন ‘গেরিলা‘।মুক্তিযুদ্ধ কে অনেক বড় পরিসরে তুলে ধরেন।এই সিনেমায় বাস্তবিক কিছু চরিত্র ও তুলে ধরা হয়েছে।মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাসই এঈ সিনেমার মাধ্যমে জানা যায়।এই সিনেমায় অভিনয় করে জয়া আহসান ব্যাপক ভাবে প্রশংসিত হন।সর্বমহলে জনপ্রিয় ও প্রশংসিত সরকারী অনুদানে নির্মিত সিনেমাটি মোট ১০টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।
১. সেরা চলচ্চিত্র
২. সেরা পরিচালক- নাসির উদ্দিন ইউসুফ
৩. সেরা চিত্রনাট্যকার- নাসিরউদ্দিন ইউসুফ ও এবাদুর রহমান
৪. সেরা সংলাপ রচয়িতা- নাসিরউদ্দিন ইউসুফ ও এবাদুর রহমান
৫. সেরা অভিনেত্রী- জয়া আহসান
৬. সেরা খল অভিনেতা- শতাব্দী ওয়াদুদ
৭. সেরা সম্পাদক- সামির আহমেদ
৮. সেরা শিল্প নির্দেশক- অনিমেষ আইচ
৯. সেরা সাজসজ্জা- শিমুল ইউসুফ
১০. সেরা রুপসজ্জাকর- মো: আলী বাবুল।
১৩. আমার বন্ধু রাশেদ (২০১১)
জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক ড.মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলাম নির্মান করেন ‘আমার বন্ধু রাশেদ’।এটি বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র।এই সিনেমায় আফনানের অভিনয় বেশ প্রশংসিত হয়,ওর জাতীয় পুরস্কার না পাওয়াটা হতাশাজনক ছিল।সরকারী অনুদানে নির্মিত এই সিনেমাটি মোট ৩ টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।
১. সেরা কাহিনীকার- ড.মুহম্মদ জাফর ইকবাল
২. সেরা চিত্রগ্রাহক- অপু রোজারিও
৩. সেরা শব্দগ্রাহক- রতন পাল।
১৪. খন্ডগল্প ৭১ (২০১১)
বদরুল আনাম সৌদের প্রথম চলচ্চিত্র ‘খন্ডগল্প ৭১’। সিনেমাটি ১ টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।
১. সেরা শিশু শিল্পী- সৈমন্তী।
১৫. নেকাব্বরের মহাপ্রয়ান (২০১৪)
কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা অবলম্বনে সরকারী অনুদানে মাসুদ পথিক নির্মান করেন ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়ান‘।এই সিনেমায় সিমলার অভিনয় বেশ প্রশংসিত হয়েছিল,জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্য হলেও বঞ্চিত হন।মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই সিনেমাটি মোট ৬ টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।
১. সেরা চলচ্চিত্র
২. সেরা সংগীত পরিচালক- ড.সাইম রানা
৩. সেরা গীতিকার- মাসুদ পথিক
৪. সেরা সুরকার- বেলাল আহমেদ
৫. সেরা গায়িকা- মমতাজ
৬ .সেরা রুপসজ্জাকর- আব্দুর রহমান।
১৬. মেঘমল্লার (২০১৪)
কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোট গল্প’রেইনকোট’ অবলম্বনে জাহিদুর রহিম অঞ্জন সরকারী অনুদানে নির্মান করেন ‘মেঘমল্লার‘।মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বর্ষাকালের জীবনযাত্রা নিয়ে নির্মিত সিনেমাটি বেশ প্রশংসিত হয়।সিনেমাটি মোট ৫ টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।
১. সেরা পরিচালক- জাহিদুর রহিম অঞ্জন
২. সেরা কাহিনীকার- আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
৩. সেরা সংলাপ রচয়িতা- জাহিদুর রহিম অঞ্জন
৪. বিশেষ শাখায় সেরা শিশু শিল্পী- মারজান
৫. সেরা শব্দগ্রাহক- রতন পাল।
১৭. একাত্তরের মা জননী (২০১৪)
আনিসুল হকের উপন্যাস অবলম্বনে সরকারী অনুদানে শাহ আলম কিরন নির্মান করেন ‘একাত্তরের মা জননী‘। নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন চিত্রনায়িকা নিপুন। সিনেমাটি ১ টি শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।
১. সেরা সহ অভিনেত্রী- চিত্রলেখা গুহ।
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রেক্ষাপট নিয়ে নির্মিত দাঙ্গা, দেশপ্রেমিক, ঘাতক, শ্রাবন মেঘের দিন, উত্তরের খেপ, লাল সবুজ, গহীনে শব্দ জাতীয়ভাবে পুরস্কার অর্জন করে।