জাম্বু গিমিক
চাইলেই সম্ভব– লাইনটা কিছুক্ষেত্রে বাধ্য হয় অসহায় আত্মসমর্পণে। বাংলা সিনেমার প্রয়াত অভিনেতা জাম্বুকেন্দ্রিক ১৫০০ শব্দের বিশ্লেষণ লিখবো গত বছর থেকে ভাবছি, পেরেছি কি? পারিনি, কারণ অধিকাংশ সিনেমায় যার উপস্থিতির ব্যাপ্তি ৫-৭ মিনিট মাত্র, তাকে উপজীব্য করে সুদীর্ঘ নিবন্ধ লিখতে চাইলে সেটিও অপ্রাসঙ্গিক আলাপনে ভরপুর হওয়াই ভবিতব্য।
তবু
মন যে মানে না!
প্রায় সকল অভিনয়শিল্পীকেই কারো না কারো সাথে মেলানো সম্ভব, জাম্বুর মতো কাউকে চোখে পড়ে না।
জাম্বুর বিশেষত্ব কী? সে মূল ভিলেন নয়, সহকারী ভিলেন বললেও অত্যুক্তি হয় কিছুটা। কুখ্যাত রংবাজ/খুনী বা ফাইটার হিসেবে তাকে পরিচিত করা হয় স্ক্রিনে, অতঃপর নায়কের সাথে মুখোমুখি লড়াইয়ে মার খেয়ে ভর্তা। অভিনীত প্রায় প্রতিটি সিনেমাতেই ফরমুলা অভিন্ন, যে কোনো অভিনেতার জন্য একঘেয়েমিতে ভোগা অনিবার্য, তবু দর্শকের অবস্থান থেকে একঘেয়েমিতাই হয়তবা ইউনিক অভিজ্ঞতা হয়ে উঠতো। জাম্বুর ভুরি আর টেকো মাথায় ঘুষি মারেনি এমন নায়ক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, বেশির ভাগ সিনেমায় তার কণ্ঠ দিত অন্য কেউ; সিনেমায় ওই স্বল্প উপস্থিতি থাকা বা না থাকায় কতটুকু পরিবর্তন আসতো আসলে? অথচ ওইটুকু উপস্থিতি দিয়েই জাম্বু দর্শকের মনোযোগ কেড়ে নিত। এই বিরল ক্ষমতার উৎস কি শুধুই স্থূলাকৃতি?
জাম্বু একটা স্বতন্ত্র ব্রান্ড হয়ে উঠেছিল। আলিফ লায়লার বাংলা সংস্করণ তৈরি করা হলো, জ্বীনের চরিত্রে জাম্বু। সিরাজউদদৌলার খুনী মোহাম্মদী বেগ চরিত্র লাগবে? কাস্ট করো জাম্বুকে।
জাম্বু কী চাইত, বা কোন প্রত্যাশা থেকে সিনেমায় এসেছিল? মেথরপট্টি থেকে উঠে আসা স্বল্পশিক্ষিত একজন মানুষের সিনেমাকেন্দ্রিক কোনো পূর্বপরিকল্পনা না থাকাই অধিক বাস্তবসম্মত। সে হয়তবা ঘটনাচক্রে বনে যাওয়া অভিনেতা।
২-৩ টা সিনেমা পাওয়া যাবে যেখানে সে-ই মূল ভিলেন, কিন্তু ৫ মিনিটের ক্যামিওতে যে জাম্বুকে পাওয়া যেত পূর্ণকালীন অভিনেতা হিসেবে আগত জাম্বুকে মোটেই সমধর্মী ক্যারিশমাটিক লাগেনি।
কীভাবে চিন্তা করতো জাম্বু, প্রশ্নের উত্তর পেতে যতটুকু রিসোর্স প্রয়োজন অনলাইনে তার কিয়দংশও সহজলভ্য নয়। জাম্বু লিখে সার্চ দিলে ২-৩ টা নিবন্ধ যা পাওয়া যায় সেখানেও তার চিন্তাচরিত্র পরিপূর্ণরূপে অনুপস্থিত।
আরও পড়ুন: জাম্বু কাহিনি
আমরা বাঙালিরা ফিটনেস সচেতন কম, বডি শেপই তার সাক্ষ্য দেয়। তাই স্থূলাকৃতির অভিনেতা বিভিন্ন সময়েই এসেছে, এখনো আসে। কিন্তু কেউই জাম্বু মানের ব্রান্ড কেন হতে পারলো না? নিয়ামকটা কী; অভিনয় দক্ষতা নাকি বাহ্যিক চেহারা? জাম্বুকে যতই দুর্ধর্ষ তকমা দেয়া হোক, দর্শক নিশ্চিন্ত থাকে সে আসল সময়ে ধমাধম মার খাবে এবং মার খাওয়াকালীন যে এক্সপ্রেসন এটাই তার সিগনেচার, এবং ওটুকু দেখবার আশাতেই জাম্বুর জন্য দর্শক পিপাসার্ত থাকে।
জাম্বুর মৃত্যু হয় ২০০৪ এ, কলেজ সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি তখন। জানতেই পারিনি, যখন জেনেছি ততদিনে ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলের অপেক্ষমান৷ বাংলা সিনেমা এতোটাই প্রেডিক্টেবল স্টোরিলাইনে ঘুরপাক খায়, নিছক ঠাট্টা-মশকরার প্রয়োজন ব্যতীত গভীর কোনো উদ্দেশ্যে তা দেখার অবকাশ হয়নি, জাম্বুকে নিয়ে আদিখ্যেতার তো কারণই থাকতে পারেনি।
তবু
শেষ কয়েক বছরে সময়ে-অসময়ে জাম্বুকে ভেবেছি, তাকে মনে পড়েছে, ইউটিউবে তার পুত্রদের সাক্ষাৎকার দেখেছি, যদি এক্সক্লুসিভ কোনো তথ্য পাওয়া যায় এই আশায়। একসময় এমনও বলতে শুরু করি ‘জাম্বুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে শ্রম দিতে হবে আমাদের’৷ কমেডির উদ্দেশ্যে বললেও পরমুহূর্তেই ভেবেছি জাম্বুও নিশ্চয়ই রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল ছিল, তার স্বপ্নের স্বদেশের স্বরূপ কেমন ছিল! ১৯৪৪ এ যার জন্ম বেঁচে থাকলে এতদিনে ৭৭ এ পদার্পণ করতো, তখনো কি একই চরিত্র পেত, নাকি ভিন্ন কোনো জাম্বুকে দেখতে পেতাম? এসবের মধ্যেও ‘জাম্বুর স্বপ্নের স্বদেশ’ শব্দবন্ধটি অনুরণিত হতেই থাকে।
ফিল্ম সংশ্লিষ্ট লেখালিখি বা ডকুমেন্টারিতে জাম্বু কয়টি শব্দ বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য? মাত্র ২টি শব্দ খরচ করতেও কুণ্ঠা বোধ করবে যে কোনো সচেতন গবেষক, সেজন্য দোষারোপ করারও সুযোগরহিত। মানছি সে ইউনিক স্যাম্পল, কিন্তু ইউনিক মাত্রই কি ভ্যালুয়েবল বা সিগনিফিক্যান্ট? নায়ক মাহমুদ কলি অথবা ভিলেন নাসির খানও হয়তবা কম-বেশি কন্ট্রিবিউটিং, কিংবা ২-১টা সংলাপ জনপ্রিয়তা পেয়েছে, জাম্বুর মুখে অনেক সিনেমাতেই সংলাপও থাকতো না। ডিপজলের ‘পাটক্ষ্যাতে যাবি?’ ভিডিওটা ভাইরাল হওয়ার মারফত জাম্বু হয়তবা নজরে পড়ে, কিন্তু সেখানে তার সংলাপটা কি মনে পড়ে? সম্ভবত না। বাংলা ফিল্ম যতই হাসির খোরাক যোগাক, এর একটি লিখিত ইতিহাস তৈরি হতেই পারে; ক্যামিও চরিত্র হিসেবে সেখানে জাম্বু কতটুকু প্রাসঙ্গিক? তামিল-তেলেগু সিনেমায় ব্রহ্মানন্দ নামে এক কমেডিয়ানকে দেখা যায়, ক্যামিও উপস্থিতি দিয়েই সে সর্বাধিক সংখ্যক সিনেমায় অভিনয়ের রেকর্ড গড়ে। ব্রহ্মানন্দের উপস্থিতি বা মুভমেন্টেই যেমন হাসি চলে আসে জাম্বুর ক্ষেত্রে হাসিটা আরো বেশি, তবু তাকে মনে রাখবার সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।
দেলোয়ার জাহান ঝন্টু বাংলা সিনেমার কমেডি লেভেলের উৎকর্ষ আনতে দুটো তাৎপর্যপূর্ণ কাজ করেছেন- ১. জসিমকে ভিলেন থেকে নায়ক তথা সুপার কমেডিয়ানে উন্নীত করেছেন ২৷ সুখনলাল নামের জনৈক বেকারকে জাম্বু নামের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিষিক্ত করেছেন৷ ঝন্টুকে ভুলে যাবার অসংখ্য কারণ থাকতে পারে, মনে রাখতে দুটোই যথেষ্ট।
মৃত্যুর ১৭ বছর পরেও যেহেতু জাম্বু সমুজ্জ্বল স্মৃতিতে, আশা করা যাচ্ছে জাম্বু সহজে হারাবার নয়; বিটকেল হাসি দিয়ে সে সামনে দাঁড়াবে ক্ষণে ক্ষণে।