জীবনানন্দের কথাসাহিত্য যে জন্য সিনেমা হতে পারে
কবি জীবনানন্দ দাশের কথাসাহিত্যের সিনেমাকেন্দ্রিক সম্ভাবনার কথা বলব। মনোযোগ দিয়ে বিষয়টি দেখতে হবে।
কবি জীবনানন্দ দাশ কথাসাহিত্যিক হিসেবে কেমন?
এ প্রশ্ন সমালোচকরা বারবার করেছেন। অনেকে তাঁকে কথাসাহিত্যিক বলতেই নারাজ। জীবনানন্দ জীবনের বাইরে গল্প-উপন্যাস লেখেননি। জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে কল্পনার মিশেল দিয়েই লিখেছেন। সেসব গল্প-উপন্যাসে নারী-পুরুষের সম্পর্কের বিভিন্ন রেখাকে স্পর্শ করেছে। ব্যর্থ মানুষের সংখ্যা সেখানে বেশি। সেটা নিয়েই অাপত্তি সমালোচকদের। তাদের প্রতি একটাই কথা এ বিশ্বে ব্যর্থ মানুষই বেশি বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে।
জীবনানন্দের কয়েকটি গল্পের কথা বলব। তিনি কী বলতে ও দেখাতে চেয়েছেন দেখুন।
ছায়ানট
গল্পটি ছোট।প্রেমেন্দ্র মিত্র এ গল্পটির প্রশংসা করেছেন। কথক তার স্ত্রী রেবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। তাই স্ত্রী অন্য কারো প্রতি অাসক্ত।ডাক্তার আসে কথকের বাসায়। দোতলায় থেমে থেমে চুমুর শব্দ অাসে। তখন কথক নিজেকে বিকৃত শবদেহ ভাবতে থাকে। রেবা কিছুক্ষণ পরে নিচে এসে কথকে বলে -‘ডাকছিলে তুমি?’ এ প্রশ্নটা মূলত insulting. কথক বুঝতে পারে তার অবস্থানটা কোথায়।
সঙ্গ নিঃসঙ্গ
কথক তার জীবনে বিয়ে করেনি। সে অাত্মবিশ্বাসী না। একদিন রাতে কথকের পূর্বপুরুষরা সবাই তাকে ঘিরে ধরে। তারা বলে তাদের ঐতিহ্য, শক্তি, পৌরুষ সবকিছুকে কথক শেষ করে দিচ্ছে যেটা তাদের অপমান। কথক অাশ্চর্য হয়।পূর্বপুরুষদের ঘিরে ধরার মতো যে কাল্পনিক অাবহ গল্পতে এসেছে এ জন্যই গল্পটি অালাদা মাত্রা পেয়েছে।
গ্রাম ও শহরের গল্প
পুঁজিবাদী বিকাশে সুবিধাভোগীরা অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গেছে। বেকারত্বে পড়েছে তরুণরা। রাষ্ট্র তাদের জন্য তেমন কিছু করতে পারেনি। শচীশ গ্রাম ভালোবাসে তবে কলকাতাও তার প্রিয়। প্রকাশের কলকাতা ভালো লাগে না। সোমেন নিজে কিছু করতে চায় জীবনে। শচীর কাছে সোমেনের বেকারত্ব হাস্যকর এবং তাকে ‘ভ্যাগাবন্ড’ ভাবে। মেয়েরা ভ্যাগাবন্ডকে পছন্দ করে না।সোমনের বেকারত্বের লক্ষণ ছিল এমন- শার্টে চুরুটের ছাই, মুখে দাড়ি, মাথার চুলে তেল নেই, চোখজোড়া মেহেদি রঙের। কথা হচ্ছে অাজকের বাংলাদেশেও নিজ নিজ অাইডিওলজির তরুণরা অাছে যাদের বাস্তবতা এরকম।
আর্টের অত্যাচার
অসাধারণ গল্প। এ ধরনের গল্প লেখাই হয়নি অার। গল্পের তরুণ-তরুণীরা ছবি আঁকে, গল্প লেখে, কবিতা লেখে। এক একজনের এক এক দর্শন।একজন বলে- ‘যারা কবি তারা ছাড়া আর কেউ অার্টিস্ট না।’ সেটা অন্যরা মানে না। আবার একজন বলে- ‘চিত্রশিল্পীরা নিজেকে ফাঁকি দিয়ে ছবি অাঁকে কারণ তারা ছবিতে পুরোটা প্রকাশ করে না।’ অালাদা দর্শনের ছেলেমেয়েগুলোর বেকারত্ব আছে, প্রেম অাছে, প্রতিষ্ঠা না পাওয়ার জ্বালা অাছে।তারপরেও এরা নিজেদের শিল্পচর্চাটা বাদ দিতে পারে না। সেখানেই এই ‘অার্ট’ তাদের মাঝে অদ্ভুত এক ‘অত্যাচার’ তৈরি করে। এ চিন্তা তো চিরন্তন যারা শিল্পচর্চা করে সবাই মানবে এটা ছাড়তে চাইলেও ছাড়া যায় না। মধুর অত্যাচারই বটে।
মেয়েমানুষ
হেমেন-চপলা, দ্বিজেন-লীলা দুই দম্পতির গল্প। একদিন সামান্য রসিকতায় লীলা দ্বিজেনের দিকে চাকু ছুঁড়ে মারে তখন হেমেন-চপলা বুঝে যায় তাদের সম্পর্ক ভালো না। রান্নাঘরে তখন স্টোভ জ্বলছে এবং সেটাই তাদের সম্পর্কের প্রতীক। একদিন হেমেন বাসায় ছিল না। দ্বিজেন এসে দেখে চপলা মেঝেতে গড়াচ্ছে। দ্বিজেন চপলার বিরাট মেদযুক্ত শরীরকে মেয়েমানুষের হৃদয় ভেবে নেয়। তারপর জীবনানন্দের ভাষায় ‘অাধঘণ্টা-একঘণ্টা-দুইঘণ্টা’ চপলাকে ভোগ করে দ্বিজেন। চপলাও উপভোগ করে সময়টা। এরপর অাশ্চর্যভাবে চপলার মনের কথাটা বলা হয় এবং সেখানে সে চাচ্ছিল দ্বিজেন চলে যাক কারণ হেমেন আসার সময় হয়েছে। লাইনটা ছিল-‘গিন্নিরাও চায় যে তাদের স্বামী অাসুক—এ অতিথি বেরিয়ে যাক।’ এই হচ্ছে মানুষের সাইকোলজি। নিজের কাছে ঠিক থাকা অন্যায় করার পরেও।
জীবনানন্দের ‘মাল্যবান’ উপন্যাসটিও একই বাস্তবতার তবে এখানেও অদ্ভুত সাইকোলজি অাছে। মাল্যবানের স্ত্রী অন্যের প্রতি অাকৃষ্ট। সে পুরুষের সাথে মাল্যবান নম্রভাবে কথা বলে। নিজেকে তার ‘অবাণ্ছিত’ মনে হয়। কাক, সজারু, পাঠা এসব পশুপাখির সাথে নিজের ও চারপাশের মানুষের আচরণের মিল পায় সে।
জীবনানন্দ দাশের গল্প কী জীবনের বাইরের কথা বলছে?
না, জীবনের নিবিড় কথাই বলছে যেখানে অাছে মানুষের মানসিক বিভিন্ন কলাকৌশল। আজকের কলকাতাভিত্তিক অার্ট ফিল্মে স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্কের ক্রাইসিস, লিভ টুগেদার বা বহুগামিতার যেসব স্টোরি টেলিং দেখানো হয় জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসে তো সেসব গত শতাব্দীর প্রথমদিকেই দেখানো হয়েছে। তারা কি তবে জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসের থিম থেকে নিয়েছে!! তাদের ‘নাগরদোলা, হেমলক সোসাইটি, হাওয়া বদল, রাতের অতিথি’ সিনেমাগুলো জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসের থিমকে represent করে।এমনকি তাদের ‘প্রভু নষ্ট হয়ে যাই’ সিনেমাটি ‘মাল্যবান’ উপন্যাসের representative.তবে কি তারা জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসের থিমকে তারা কাজে লাগিয়েছে? ভাববার অবকাশ আছে কিন্তু..
অার হ্যাঁ, আজকের অাধুনিক এ শতাব্দীতে নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্কের ক্রাইসিস দিন দিন বাড়ছে এবং বাড়বে যেহেতু স্বাধীন হতে চায় সবাই।সম্পর্কের সেসব ক্রাইসিস থেকে জীবনানন্দ দাশের গল্প-উপন্যাস নিয়ে অামাদের এখানেও সিনেমা নির্মাণের যথেষ্ট সুযোগ অাছে।