ট্রেলারে যা দেখেছেন তা-ই ‘দিন দ্য ডে’
আমাদের এলাকার একমাত্র সিনেমা হল ‘মনিহার’ (হবিগঞ্জ)। এখানে নতুন সিনেমা রিলিজ হওয়া স্বপ্নের মতো। অবশ্য ঈদের সময় নতুন সিনেমা রিলিজ হয়; তখন শুধু শাকিব খানের সিনেমা আনা হয়। এই ঈদে শাকিবের সিনেমা না থাকায় তারা ‘দিন দ্য ডে’ রিলিজ করেছে।
এই সিনেমাহলে দর্শক তেমন একটা থাকে না, তবে ঈদুল আজহার দ্বিতীয় দিন বিকেলের শো’তে দেখলাম প্রথম শ্রেণীতে প্রায় ৫০-৬০ জন এবং ডিসিতে ২০-২৫ জনের মতো দর্শক ছিল। মানে এভারেজে ৭০-৮০ জন দর্শক ছিল পুরো হলে। মনিহারের জন্য সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। দর্শকদের মধ্যে বেশিরভাগই মূলত ট্রেলারে ধুন্ধুমার অ্যাকশন দেখে এই সিনেমা দেখতে এসেছে।
ট্রেলারে যা দেখেছেন গল্পও তাই, নতুন কিছু নাই সিনেমায়। বাংলাদেশের পুলিশের সোয়াট ডিপার্টমেন্টের একজন কমান্ডো হচ্ছেন অনন্ত জলিল, এমনকি তার স্ত্রী বর্ষা যিনি সিনেমাতেও অনন্তর স্ত্রী চরিত্রে অভিনয় করেছে সেও একই ডিপার্টমেন্টে আছে। তো, মূলত গল্পে দেখানো হয়— কাজ খুঁজতে মানুষেরা মধ্যপ্রাচ্যে যেতে দালাল চক্রের দারস্থ হয় কিন্তু তাদেরকে লোভ দেখিয়ে পাচার করে আফগানিস্তানে পাঠানো হয়; যেখানে বাংলাদেশের অনেক মানুষকেও জিম্মি রাখা হয়। তারপর তাদের দিয়ে নানানভাবে ড্রাগ পাচার করা হয়। মূলত তাদের রক্ষা করার জন্যই অনন্তকে বাংলাদেশ তুরস্কে পাঠায়। আর তুরস্ক থেকে ইরান, তারপর আফগানিস্তান।
তারপর কীভাবে অনন্ত তাদের রক্ষা করে এবং একটা সময় অনন্তকে রক্ষা করতে কীভাবে তার স্ত্রী বর্ষাও তার কাছে ছুটে যায় সেটা নিয়েই গল্প! অনেকটা ‘টাইগার জিন্দা হ্যায়’ সিনেমার প্লট মেরে দিয়েছে!
‘দিন দ্য ডে’র গল্প লিখেছেন অনন্ত জলিল নিজে, এমনকি ডায়ালগেও উনি কাটাছেঁড়া করেছেন। গল্পে কিছুই নেই সত্যি বলতে। এত বড় একটা সিনেমার জন্য একদম দুর্বল একটা গল্পকে বাছাই করা হয়েছে। সিনেমাটা সবচেয়ে বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে এখানে। গল্প খারাপ হলেও দেখা যায় চিত্রনাট্য অনেক সিনেমায় ভালো হয় তবে এখানে সমস্যা চিত্রনাট্যেও। খুব বাজেভাবে চিত্রনাট্য সাজানো হয়েছে। মানে কোনো থ্রিল নেই, মিস্ট্রি নেই! আপনি যে পরের দৃশ্যের জন্য অপেক্ষা করবেন তেমন কোনো জায়গাও নেই। একেবারে আনকোরা টাইপের একটা চিত্রনাট্য, ইন্টারেস্টিং কিচ্ছুই নেই।
এখন আসি টেকনিক্যাল দিকে। বিশ্বাস করেন, সিনেমাটাকে ১০০ কোটির সিনেমা ঠিক-ই বলা হচ্ছে কিন্তু টেকনিক্যাল দিক দেখলে মনে হবে এটা মাত্র কয়েক লাখ টাকার সিনেমা। সিনেমার মেকিং সম্পর্কে বলি, যারা নিয়মিত সিনেমা দেখেন বা ফিল্ম মেকিং সম্পর্কে ধারণা রাখেন তাদের চোখে প্রচুর ভুল ধরা পড়বে। দুয়েকটা ভুল বলি, সিনেমায় অনন্ত ও বর্ষার যে ছেলে আছে সে কয়েকবার-ই ফেইক লুক দেয় সিনেমায়। মানে বুঝলাম না, ইরানের একজন নির্মাতা এবং এত বড় ক্রু টিম- কারোর চোখে এইটা পড়লো না?
তারপর কয়েকজন অভিনেতা আছেন, যারা তুরস্কের পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। তাদের অভিনয় দেখে মনে হচ্ছিল রাস্তা থেকে তুলে এনে জোর করে অভিনয় করানো হচ্ছে। মানে যেকোনো দর্শক তাদের অভিনয় দেখে ভুল ধরতে পারবে।
সিনেমাটোগ্রাফি কিছু কিছু জায়গাই ভালো করলেও বেশিরভাগ দৃশ্যই দেখতে ভালো লাগছিল না। মানে কোনোরকমে শট নেওয়া হয়েছে, দেখলেই বোঝা যায় কিন্তু এইসব সিনেমায় শটের বৈচিত্র থাকতে হয় অনেক। কিছু অহেতুক ড্রোন শট আছে। ইরানি সিনেমাটোগ্রাফার থেকে বাংলাদেশের রাশেদ জামান, রাজু রাজ কিংবা সাঈফুল শাহিনও ভালো শট নিতে পারবেন।
এডিটিং-এও ভীষণ দুর্বলতা। একটা শট আছে যেখানে অনন্ত বোমা ছুড়ছে; অনন্ত বোমা ছোড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে মানে হাতও পুরো উপরে তুলেনি কিন্তু সাথে সাথেই কাট টু শটে পরের সিনে গিয়ে কোনো সময় নেওয়া ছাড়াই সরাসরি বোমা ব্লাস্ট হয়ে যাচ্ছে! এমন আরও কয়েকটা দৃশ্য আছে যেগুলোর এডিটিং মারাত্মকভাবে চোখে লেগেছে।
ডাবিং ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকেরও অবস্থা খারাপ। বেশিরভাগ বিদেশি অভিনেতার লিপসিংয়ে কোনো মিল-ই ছিল না। এমনকি ডাবিংয়ের ফ্লো ঠিক ছিলো না, এক জায়গাই বেশি, এক যায়গাই কম। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক অনেক জায়গাই এত বেশি হচ্ছিল যে সংলাপ বোঝাই যাচ্ছিল না।
আর হ্যাঁ, ভিএফএক্স নিয়ে কিছু বলতেই ইচ্ছা করছে না। ১০০ কোটি টাকা বাজেটের সিনেমার ভিএফএক্স দেখলে আপনার হাসি ছাড়া আর কিছুই আসবে না।
অভিনয়ে মিশা সওদাগর ছাড়া আর একজনেরও অভিনয় শতভাগ ছিল না। তার সবচেয়ে বড় কারণ বিদেশি আনকোরা শিল্পী। একে তো তারা অভিনয়ে এত দক্ষ না সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, তার উপর জোর করে বাংলায় লিপসিং করাতে চেয়েছিল। মিশা সওদাগরকেও শো-পিস হিসেবে রাখা হয়েছে, বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই তার। ভিলেন হিসেবে যিনি অভিনয় করেছেন তার অভিনয় ভালো হলেও তাকেও ঠিকঠাকভাবে কাজে লাগানো হয়নি।
অনেক নেগেটিভ বিষয় তুলে ধরলাম এবার আসি কিছু পজেটিভ বিষয়ে। প্রথম পজেটিভ দিক হচ্ছে অ্যাকশন। নতুনত্ব না থাকলেও অ্যাকশন কোরিওগ্রাফিগুলো বেশ ভালো লেগেছে, বাংলাদেশের অন্যান্য অ্যাকশন সিনেমার সাথে কম্পেয়ার করলে অনেকটা এগিয়ে থাকবে।
সিনেমার গানগুলো ভালো লেগেছে। ইমরানের দুটো গান এবং আরেকটা ইরানি সঙ্গীত পরিচালকের গান। গানগুলো শ্রুতিমধুর, বিশেষ করে ইরানি সঙ্গীত পরিচালকের গানটা দারুণ। মিউজিকটা অসাধারণ লেগেছে।
ডান্স কোরিওগ্রাফির প্রশংসা করতেই হয়। দারুণ কোরিওগ্রাফি করা হয়েছে গানগুলোর। বিশেষ করে ইমরানের গান দুটোর, যার ডিজাইন করেছেন বাংলাদেশের হাবিব।
পরিশেষে বলবো, নির্মাণ বিবেচনায় এই সিনেমার বাজেট শত কোটি টাকা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য না। আর ধরে নিলাম ১০০ কোটি, তাহলে বলবো— বাংলাদেশের অনেক নির্মাতা আছে যাদের ৫ কোটি টাকা দিলে এর থেকে আরও ভালো অ্যাকশন সিনেমা নির্মাণ করতে পারবে। এমনকি ইরানের ডিরেক্টর হয়েও যে পরিমাণ ভুল আছে সিনেমায়, মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিলো বদিউল আলম খোকনের সিনেমা দেখছি!
যাই হোক, বাংলা সিনেমার প্রতি ভালোবাসা থেকে দেখতে গিয়েছিলাম। অনেকটা হতাশ হয়েছি, তবে কিছু ভালোলাগাও ছিলো যেগুলো মেনশন করেছি। তবে এই কয়েকটা ভালো দিক দিয়ে একটা সিনেমাকে কখনোই ভালো বলা সম্ভব না। অনন্ত সাহেবকে উদ্দেশ্য করে একটা কথা বলবো, এক সিনেমায় ১০০ কোটি খরচ না করে এই বাজেটে বাংলাদেশি তরুণ নির্মাতাদের ৪০টি সিনেমা দিন। তারপর দেখুন কিভাবে বাংলা সিনেমা আলো খুঁজে পায়। তার সঙ্গে আপনার নামটাও নেওয়া হবে সম্মানের সহিত, ভালোবাসা সহিত।