‘ডুব’ নিয়ে কেন বিতর্ক?
কথা ছিল আসবে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’। কিন্তু হুট করেই সামনে হাজির হলো ‘ডুব’। তাও আবার ভারতের নামিদামি অভিনেতা ইরফান খান প্রধান ভূমিকায়। এসব নিয়েই আলোচনার মাঝখানে হুট করেই সামনে চলে আসলেন বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্র হুমায়ূন আহমেদ। বিপুল জনপ্রিয়তার অধিকারী এই লেখকের ‘ছায়া’ নাকি আছে ‘ডুব’ সিনেমায়। তার ভক্তকূল বিতর্ক শুরু করলেন। তৈরি হলো পক্ষ-বিপক্ষ। যদিও নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বরাবরই দাবি– ‘ডুব’ হুমায়ূনের বায়োপিক নয়। এতসব কিছুকে ছাপিয়ে মুক্তি পেল ‘ডুব’।
‘ডুব’ কেমন হলো?
‘ডুব’ আসলে কেমন সিনেমা? এমন প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, দর্শকরা ‘ডুব’কে ব্যাখ্যা করবেন নানান উপায়ে। তবে সত্যিকার অর্থে ডুব সিনেমায় এক নতুন ফারুকীকে আবিষ্কার করবে দর্শক। তার আগে ফয়সালা করা জরুরি, ফারুকী আসলে কেমন সিনেমা বানান?
অনেকেই বহু বছর ধরে বলে আসছেন, ফারুকী সিনেমা কেন যেন ‘সিনেমা’ হয়ে উঠতে পারে না। এটি নাটক কিংবা সর্বোচ্চ টেলিফিল্মে গিয়ে ঠেকে। কিন্তু সিনামার একজন নিয়মিত দর্শক হিসেবে এর ভিন্ন ব্যাখ্যাও হাজির করা যায়। প্রতিটি পরিচালকের নিজস্ব একটা ঢং থাকে। পরিচালক তার গল্প একটি ভিন্ন স্টাইলে বলতে চান। ফারকীর স্টাইলটা কিংবা গল্প বলার ঢংটাই ওমন। সেটা নিয়ে বিতর্ক করার চেয়ে বরং একজন পরিচালকের নির্মাণ পাঠ করা জরুরি।
ফারুকী এখন পর্যন্ত যে সিনেমাগুলো নির্মাণ করেছেন- সেগুলো হলো– ব্যাচেলার (২০০৩), মেড ইন বাংলাদেশ (২০০৭), থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার (২০০৯), টেলিভিশন (২০১২), পিঁপড়াবিদ্যা (২০১৪)। প্রতিটি সিনেমায় ফারুকী যে কোনও একটি প্রেক্ষাপটকে বাছাই করেছেন। যেমন, ধরা যাক ব্যাচেলার ছবিতে ফারুকী এঁকেছেন তরুণ প্রজন্মের প্রেমকে। কিছু যৌন সুড়সুড়িও ছিল–লিটনের ফ্ল্যাট, একজনের গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে আরেকজনের প্রেম, বিয়ের পরও অন্য নারীর সঙ্গে প্রেম ইত্যাদি। আর ভাষার জন্য তো ফারুকীকে কম ‘হ্যাপা’ পোহাতে হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ সিনেমাও একটি গুরুত্ব বহণ করে। তৎকালীন রাজনৈতিক সংকট তিনি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তার মতো করে। যদিও অতিরিক্ত সংলাপে বিরক্ত ছিলেন অনেকেই, কিন্তু তৎকালীন সময়ের আলাপকে হাজির করেছিলেন ফারুকী। তারপরের নির্মাণ ছিল ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’। এই সিনেমা একজন নারীর সংকটকে তিনি হাজির করেছেন। একজন মানুষকে ভেঙে তিনটি চরিত্র হাজির করেছিলেন দর্শকের সামনে। এই সিনেমায় একটি প্রথাকে তিনি হাজির করেছিলেন, সেটি হলো লিভটুগেদার প্রথা। যে দেশে এটি বলতে মানা সেদেশে সেই কথাটি ফারুকী বলেই দিলেন। যদিও এই সিনেমাতেও যৌন সুড়সুড়ির জন্য বিতর্ক হয়েছে। অন্যদিকে বলতে গেলে একজন নির্মাতা হিসেবে অনেকটাই পরিণত দেখা গিয়েছিল ‘টেলিভিশন’ সিনেমায়। সেখানে ফারুকী অনেক কিছু বলতে চেয়েছেন। ধর্মীয় কুসংস্কার, পিতা-পুত্রের সম্পর্ক, প্রযুক্তির বিস্তার, হজ নিয়ে বর্তমান সময়ের প্রতারণা এসব। আর ‘পিঁপড়াবিদ্যা’র প্রেক্ষাপটও বিবেচনায় আনতে হবে। প্রেমিক-প্রেমিকার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করা মোবাইলটি জনপ্রিয় মডেলের হাতছাড়া হয়ে যায়। তারপর সেই পরিণতির ছক এঁকেছেন ফারকী।
কনটেক্সট বিবেচনায় নিলে ফারুকী একটি সময়ের ভেতর ঘটে যাওয়া ঘটনাকেই পর্দায় হাজির করেন। সেই হাজির করার স্টাইলটা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। পরিচালক তার ঢং ত্যাগ করে সমালোচকদের পছন্দের ঢং আয়ত্ত করতেও বাধ্য নন। আবার দর্শকও বিতর্ক করবে না– সেটাও দাবি করা ঠিক নয়।
তবে ডুব আসলে কোন প্রেক্ষাপটকে ধারণ করলো? এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, ‘ডুব’ও সমসাময়িক একজন জনপ্রিয় লেখকের জীবনকেই ধারণ করলো। সেটা দর্শক ‘ছায়া’ বলুক, ‘বায়োপিক’ বলুক। সেটা নিয়ে বিতর্ক করার অধিকার দর্শকের আছে। কিন্তু যখন দর্শক দাবি করবেন, কেন সিনেমা বানালেন? তখন নির্মাতাও প্রশ্নে করতে পারেন, কেন পারবো না? যদিও ফারুকী এটি বলেননি। তবে ‘ডুব’ সিনেমার শেষের দিকে মায়া চরিত্রটির একটি সংলাপ অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়। স্বামী জাভেদ হাসানের মৃত্যুর পর মায়া চরিত্র বলে ওঠে– ‘তুমি আজ থেকে কারও অধিকারে নেই’।
অতএব ‘ডুব’কে কারও জীবনের বায়োপিক না বলে বলতে হয় এটি একটি মানুষেরই গল্প। যে মানুষটি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। যার একজন কন্যা এবং একজন পুত্র সন্তান আছে। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে যার গোছানো সংসার ছিল। সেই গোছানো সংসারে যখন অসম প্রেম হাজির হয় তখন আসলে পরিণতি কী হয়? সে গল্পই বলতে চেয়েছেন ফারুকী।
‘ডুব’ সিনেমায় যা ছিল ভালো:
প্রথমত বলতে হয়, ‘ডুব’কে বুঝতে হলে প্রথমে বিতর্কিত বিষয়টি থেকে দর্শককে বের হয়ে আসতে হবে। মাথা থেকে বের করতে হবে পর্দায় আপনি হুমায়ূন আহমেদকে দেখছেন। দর্শককে প্রথমেই নির্ধারণ করতে হবে তিনি একটি সিনেমা দেখছেন। সে সিনেমার প্রধান চরিত্র জাভেদ হাসান একজন প্রতিষ্ঠিত চলচ্চিত্র নির্মাতা। তার স্ত্রী মায়া, কন্যা সাবেরী, পূত্র আহির এবং কন্যার বান্ধবী যিনি পরবর্তীতে স্ত্রী হন- নিতু চরিত্র দিয়ে একটি পরিবারের বিষাদের গল্প গেঁথেছেন ফারুকী। জাভেদ হাসানের গল্প যখন হাজির করবেন মানসপটে তখন দেখা যাবে ‘ডুব’ হয়ে উঠেছে একটি নিস্তব্ধতার সিনেমা। কারণ বিষাদের সঙ্গে নিস্তব্ধতা মিশে আছে।
১. ‘ডুব’ সিনেমাকে একবাক্যে বলা যায়– একটি পয়েটিক নির্মাণ। কম সংলাপে মানুষের নিস্তব্ধতার ভেতরও যে অনেক কথা বলা যায় সেসব প্রসঙ্গই তুলে ধরেছেন নির্মাতা।
২. ‘ডুব’র অসাধারণ বিষয়টি ছিল লোকেশন। ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে টপশট থেকে যখন প্রকৃতিকে তুলে ধরেছেন পর্দায়– তা এক ভিন্ন আঙ্গিক দিয়েছে। যা দর্শক উপভোগ করবে। টপশট থেকে যখন পুরো প্রকৃতিকে দেখানো হয় তখন চারপাশের পরিবেশ ও জাভেদ হাসানের অসহায়ত্বও প্রকাশ পায় এর মধ্যে দিয়ে।
৩. এই সিনেমার বিশেষত্ব হলো সিনেমেটোগ্রাফির কাজ। এই নির্মাণে ক্যামেরার কাজে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলেই মনে করা যায়। তার শটগুলো সত্যিই ভিন্নতা তৈরি করে সিনেমায়। বিশেষ করে, জানালা দিয়ে একটি দৃশ্যের শট, যেখানে মনে করা যেতে পারে ঘটনাটি উঁকি দিয়ে দেখছে দর্শক। দর্শক হয়তো মনে করবে জাভেদ এবং নিতুর ঘটনা দর্শক উঁকি দিয়ে দেখছেন। আবার জাভেদ যখন অভিমানি কন্যা সাবেরীকে ফোন করবে তখনও দর্শক ভাববে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে বাবা-কন্যার বিষাদের গল্প দেখছেন। ফারুকী এই সিনেমায়ও রকিংশট জারি রেখেছেন কিছু কিছু জায়গায়। অর্থাৎ মনে হবে ক্যামেরা কেউ একজন নাড়াচ্ছে, ঝাকাচ্ছে। তার ‘টেলিভিশন’ সিনেমায় এই ধরনের শট দেখা যায়। এধরনের শট অনেক সময় দর্শকের কাছে দৃশ্যের পরিবেশকে জীবন্ত করে তোলে।
৪. কন্যা সাবেরী যখন তার মা মায়ার জন্মদিন পালন করতে আশুলিয়ার কাশবনে নিয়ে যায়। এবং আড়ালে গিয়ে মাকে ফোন করে তার লড়াইয়ের কথা বলে উৎসাহিত করে। শেষ বিকেশে তুমুল বাতাসে কাশবনের পাতা নড়ছে সেই দৃশ্যটি ছিল অসাধারণ অভিব্যক্তি।
৫. ছবিতে সংলাপ খুবই কম। শুরুতেই বলা হয়েছে, ফারুকী এই ছবিতে খেলেছেন প্রকৃতির কাব্য নিয়ে। বাতাস, গাছের নড়াচড়া, ফুল বাতাসে নড়ছে, বৃষ্টির শব্দ, সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ। এসবই কানে বাজে। একজন মানুষ যখন নিস্তব্ধতার মধ্যে থাকে, যখন সে বিষাদের ভেতর হারিয়ে যায়–তখন যে নিসঙ্গতার আবহ হয়, সেটাই নির্মাণ করতে চেয়েছেন ফারুকী। বিশেষ করে কন্যার সঙ্গে বাবার সংলাপগুলোর বাস্তবতার গুরুত্ব বহন করে।
৬. চরিত্রগুলোর অভিনয় নিয়েও বলতে হয়–জাভেদ হাসান চরিত্রে ইরফান খান, কন্যা সাবেরী চরিত্রে তিশা, প্রথম স্ত্রী চরিত্রে রোকেয়া প্রাচী, পূত্র আহির, দ্বিতীয় স্ত্রী চরিত্রে পার্নো মিত্র সবাই যার-যার জায়গায় চেষ্টা করে গেছেন। তবে বলতে হয়, কম সংলাপে নিজেকে মেলে ধরতে পারাটা চ্যালেঞ্জ বটে। তিশার সঙ্গে ইরফান খানের নির্বাক থেকে কান্নার মুহূর্তগুলো সুন্দর। কিংবা বাবার কাছে অনেক কথা বলার আছে, কিন্তু মুখ বাকা করে কান্না দিয়েই যেন অনেক কিছু বলে দিচ্ছে বাবাকে। এই বিশেষ মুহূর্তগুলো হৃদয় ছুয়ে যাবে।
তবুও যা অসম্পূর্ণ থেকে যায়:
১. এই সিনেমার সবচেয়ে মন্দ দিক হচ্ছে গল্পের ডিটেইলে না যাওয়া। মনে হচ্ছিল নির্মাতা কিছু ছিন্ন ছিন্ন দৃশ্যকে হাজির করছেন দর্শকের সামনে। আর বলছেন, বাকিটা বুঝে নাও। কিন্তু আদতে তো দর্শক একটি পূর্ণ গল্প দেখতে চায়।
২. গল্পটা শুরু করেছেন একটি রিইউনিয়নের দৃশ্য দিয়ে। যেখানে কন্যা সাবেরী এবং দ্বিতীয় স্ত্রী নিতু পাশাপাশি একটু দূরত্ব রেখে বসা। তারপর সেখান থেকে গল্পের ভেতর প্রবেশ করা। জাভেদ হাসানের সংসারে ভেতরে যখন প্রবেশ করে গল্প তখন দর্শক আরও অনেক কিছু দেখতে চায়। তাদের প্রেম, তাদের খুনসুটি– কেন জাভেদ এই জীবনে ক্লান্ত এসবই দর্শক জানতে চান। কিন্তু নির্মাতা জানান না। তিনি ছোট ছোট সংলাপে বুঝিয়ে দেন বহুকিছু। যেমন, জাভেদ যখন মায়াকে বলে, আমরা কিভাবে যেন চাকরিজীবী হয়ে গেলাম, তুমি স্ত্রীর চাকরি করছো আমি স্বামীর চাকরি করছি। অর্থাৎ সংসারটা তাদের কাছে শুধু দায়িত্ববোধের হয়ে গেলো। তবুও দর্শক তো আরও অনেক কিছু জানতে চায়।
৩. সিনেমার ভেতর দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে খুব একটা প্রেমের সম্পর্ক দেখানো থেকে কেন যেন বিরত থেকেছেন নির্মাতা। যদি বিয়েই হয় কন্যার বান্ধবীর সঙ্গে। তবে সেখানে প্রেম কিছুটা হলেও ছিল। সেই প্রেম দেখানোতে বাধা কেন? এই প্রশ্ন দর্শকের থেকেই যাবে। বলতে হয়– সম্পর্কের গভীরে কেন যেন প্রবেশ করেননি নির্মাতা।
৪. সিনেমায় কোনও কৌতুহল তৈরি করেনি। দর্শক ভাবেনি, আচ্ছা পরে কী হবে। সিনেমায় একটা কৌতুহল দাবি করে। সিনেমাটি চলেছে এক জানা গল্পের ভেতর দিয়ে।
৫. সিনেমায় বেশ কয়েকটি শট আছে চেয়ার, টেবিলসহ আসবাবপত্রের। এর কোনও ভাষা হয়তো তৈরি করতে চেয়েছেন নির্মাতা। হয়তো বলতে চেয়েছেন, সম্পর্ক যেমন হাহাকার করে বেড়ায়, সম্পর্কের মানুষগুলো একসঙ্গে না থাকলে ঘরের জড়বস্তুগুলোও হাহাকার করে ওঠে। কিন্তু এত গভীর ভাবনায় ফেলতে হলে দর্শকের ভেতর সুক্ষ্ম হাহাকার শুরুতে তৈরি করে নিতে হয় বলেই জানি। যার প্রচেষ্টা খুব একটা লক্ষণীয় নয়।
৬. গল্পের ডিটেইলের কথা বলেছি শুরুতেই। এই ডিটেইলের অভাবে চরিত্রগুলো সঠিক আকারে বিস্তার লাভ করতে পারেনি। কোনও একক চরিত্রও এখানে বিস্তার করেনি। তবুও রোকেয়া প্রাচীকেই মনে হয়েছে তার চরিত্রের যথেষ্ট ডিটেইল আছে। বাকি চরিত্র ইরফান খান, পার্নো মিত্র, তিশার এবং তার ভাই চরিত্র (আহির) গুলো বিস্তার করতে পারেনি। যার কারণে অভিনয়ের কারিশমা দেখানোরও সুযোগ মেলেনি।
নারী চরিত্রের বয়ান:
এবার একটু নারীদের দৃষ্টিভঙ্গিও যদি ফেলি। তবে এখানে অনেকগুলো নারী চরিত্র উঠে এসেছে। যেমন:
ক. জাভেদ হাসানের প্রথম স্ত্রী মায়াকে অত্যন্ত শক্ত সামর্থ্য নারী হিসেবেই উপস্থিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। যিনি স্বামীর পরকীয়ার টের পেয়ে প্রতিবাদ করেছেন শুরুতে। তারপর স্বামীকে সুযোগ দিয়েছেন। কিন্তু তবুও যখন স্বামী ঠিক রাস্তায় নেই তখন তিনি চলে যেতে চাইলে স্বামী জাভেদ হাসানই ঘর থেকে চলে যায়। তারপর তিনি একাই এই সংসারের হাল ধরেন শক্ত হাতে। যা তার কন্যা জন্মদিনে এই বক্তব্যগুলো মোবাইলের মাধ্যমে মায়ের কাছে হাজির করেন।
খ. জাভেদ হাসানের কন্যা সাবেরী। সাবেরীকে দেখানো হয়েছে বাবার সঙ্গে নিরবতায় বিষাদ ভাগাভাগি করছে। এবং সেও প্রতিবাদ করেছে। সেও তার বাবাকে গিয়ে একদিন বলে আসে, আজ থেকে তুমি তোমার ছেলে-মেয়ে কারও চেহারা দেখবা না।
বাবা তার জন্য গিফট পাঠায়, আর কন্যা সেটা বারবার ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু কন্যাও মনে মনে ঠিকই বাবার জন্য বিষাদে ভোগে…
গ. জাভেদের দ্বিতীয় স্ত্রী নিতু। তাকে আসলে কোন দিশা পরিচালক দিতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট না করলেও ইশারায় বুঝিয়েছেন, জাভেদ না চাইলেও নিতু তাকে প্রেমের শিকারে আনতে চাইছেন। আর তা ছাড়া দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে নিতুর সঙ্গে প্রেমের কোনও অনুভূতিও দেখাননি নির্মাতা। আর এই পরকীয়ায় জাভেদও যে ইচ্ছুক সেটাও স্পষ্ট করেন না। শুধু তাই নয়, কন্যাকে গিফট পাঠানো নিয়েও নিতু জাভেদকে বলে, তুমি এটা কিভাবে পারলা?
অর্থাৎ কন্যার সঙ্গে সম্পর্ক থাকুক এ বিষয়টিও চাচ্ছে না দ্বিতীয় স্ত্রী।
তিনটি নারী চরিত্রকে তিনভাবে পোট্রেট করেছেন ফারুকী। সেটারও ভাগ আছে। যেমন:
১. প্রথম স্ত্রী, কন্যা, কন্যার বান্ধবী
২. প্রথম স্ত্রী, কন্যা, দ্বিতীয় স্ত্রী
৩. মা, মেয়ে, বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী।
সম্পর্কের কয়েকটি স্তরকে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন ফারুকী। এই নারী চরিত্রগুলো আসলে ঠিক কোন দিশায় হাজির হলো তার ব্যাখ্যা অবশ্য নারীবাদ যারা চর্চা করেন তারা দিতে পারবেন। তাদের বিশ্লেষণের অপেক্ষায় থাকা যায়।
কেন ‘ডুব’ বায়োপিক নয়:
বায়োপিক বলা হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের তো? যদিও এই বিতর্ক পুরনো। তবুও বলা যেতে পারে। বায়োপিক মানে কী? সব কিছুই সত্য। এখন সিনেমাতে যা ছিল তার সব কি সত্য ছিল? কয়েকটি বুলেট পয়েন্টে মিলিয়ে নিন।
১. হুমায়ূন আহমেদের কি একজন কন্যা এবং একজন পূত্র সন্তান ছিল?
২. হুমায়ূন আহমেদ কি শুধুমাত্র জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন?
৩. হুমায়ূন আহমেদের কন্যার সঙ্গে কি তার দ্বিতীয় স্ত্রীর কোনও রিইউনিয়নে পুনরায় দেখা হয়েছিল?
৪. হুমায়ূন আহমেদ প্রথমবার পালিয়ে বিয়ে করার পর কি লুকিয়ে শাশুড়ির ব্যবস্থা করে দেওয়া কোনও স্টোর রুমে ছিলেন?
৫. হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে তার প্রেমিকা কি সময় কাটিয়ে সকালে দেয়াল টপকে বের হতে গিয়ে রিসোর্টের কেয়ারটেকারের চোখে পড়েন?
কেন এত বিতর্ক?
‘ডুব’ অবশ্যই হুমায়ূন আহমেদের জীবনের ছায়া থেকে অনুপ্রাণিত। এককথায় সারমর্ম যদি বলা যায়, অসমপ্রেম এবং বিয়ে, জনপ্রিয় ব্যক্তি, সন্তানদের সঙ্গে দূরত্ব, মৃত্যুর পর দাফন নিয়ে দ্বন্দ্ব, পিতার সঙ্গে তার সন্তানদের জন্য গোপন হাহাকার। এসবই আছে এই সিনেমায়। এখানে সত্য হলো হুমায়ূনের জীবনের সারমর্ম। বাকি সব নির্মাতার কল্পনা। আর এই সারমর্ম সবার জানা। সবার চেনা ঘটনা। এই চেনা ঘটনার সঙ্গে কল্পনার রঙ মিশিয়েই তৈরি হয়েছে একটি সিনেমা ‘ডুব’। আর এজন্যই বিতর্ক হচ্ছে।
এখন দর্শক বলতে পারেন, মাথায় হুমায়ূন আহমেদ না রেখে দেখার কোনও সুযোগ নেই। সেটাও দর্শকের বলার অধিকার আছে। দর্শক পয়সা দিয়ে সিনেমা দেখেছেন। তার একশভাগ অধিকার আছে– সমালোচনা করার, তার যুক্তি পেশ করার, ‘কিছুই হয় নাই’ এমন শত মন্তব্য করার। সেটা বাংলা সিনেমার সুবাতাস হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত। কারণ এসবের মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে এই দেশে সিনেমার দর্শক তৈরি। তারা শুধু অপেক্ষা করছেন ভালো গল্পের। ভালো সিনেমা আসবে- দর্শক দেখবে, কথা বলবে। এই দৃশ্যটিই তো সুন্দর। যদিও ব্যক্তি আক্রমণে রূপ নিয়েছে বহু তর্ক-বিতর্ক। সেসব ইগনোর করলে বাকি পুরোটাই বাংলা সিনেমার জন্য সুসংবাদ।
ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, ফারুকী যদি ডিটেইলে যেতেন তবে এত বিতর্ক হওয়ার সুযোগ কম হতো। যদিও এটা ফর্মুলার বাইরের সিনেমা।
সবশেষে:
অনেক বিতর্ক আছে নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী কেন স্বীকার করছেন না– এটা হুমায়ূন আহমেদের জীবন থেকে নেওয়া। বিষয়টা হলো এখানে স্বীকার করার প্রয়োজন নেই, কারণ স্বয়ং পর্দায় সবকিছু উপস্থিত। শুধু প্রয়োজন একজন মানুষকে বোঝা, জানা, উপলব্ধি করা। কারণ এমন ঘটনা আমাদের এই দেশে বহু মানুষের জীবনেই ঘটে। কিংবা এর চেয়েও বড় ঘটনা ঘটে। আমরা জানি তাদেরটাই যাদেরটা সামনে আসে। আর এটা যদি হুমায়ূন আহমেদকে বিবেচনায় নেওয়াও হয় তবুও বলা যেতে পারে এই হুমায়ূনের জীবনের যতটুকু ঘটনা এই দেশের মানুষ জানে- তাতে এই লেখকের প্রতি তাদের ভালোবাসা একবিন্দুও কমেনি। আবার অন্যদিকে এই সিনেমার মাধ্যমে শাওনকেও খারাপ ভাবার কোনও সুযোগ তৈরি করে না। কারণ যদি তাকে খারাপ বলতে হয় তবে স্বয়ং সেখানে আমাদের জনপ্রিয় লেখকও জড়িত। এক হাতে তো তালি বাজেনি। আবার এই ঘটনায় একটি পরিবারের ক্রাইসিসও আমরা শুধুমাত্র বুঝতে পারি। কিন্তু আমরা যারা বিতর্কে হাজির হয়েছি তাদের কারও এই পাহাড়সম বেদনা উপলব্ধি করতে পারাটাও সম্ভব নয়। যে উপলব্ধি হুমায়ূনের প্রথম পরিবার, শাওন এবং হুমায়ূনও বয়ে গেছেন। যারা বেঁচে আছেন তারা আজীবন এই বিষাদ বয়ে বেড়াবেন।
যাইহোক, বাংলা চলচ্চিত্রের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রাক্কালে এমন ভিন্ন নির্মাণ দর্শকের ভাবনার জগতকে নতুন করে সাজাতে সাহায্য করতেও পারে। আজ যা বিতর্কিত হচ্ছে- কাল তা গ্রহণযোগ্য হবে না তেমন কোনও তত্ত্ব তো আপাতত কারও হাতে নেই। ‘ডুব’ যে ধারার সিনেমা তেমন সিনেমা বাংলাদেশে আগে কখনও হয়নি। ফারুকীর এই এক্সপেরিমেন্ট মন্দ হবে না।
লেখক: শেরিফ আল সায়ার