ঢাকাই সিনেমার বাণিজ্যসফল নির্মাতারা
[বাণিজ্যকে বড় করে দেখার অনেক মুশকিল আছে। আবার চলচ্চিত্রকে ইন্ডাস্ট্রি আকারে বা বিনোদনের চাহিদা-জোগান অর্থে দেখা ছাড়াও বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একইসঙ্গে যেকোনো শিল্পের নিজস্ব একটা ধাঁচ রয়েছে। এবং সেটা কখনো স্রেফ শিল্পের জন্য শিল্পে আটকে থাকে না… এ অনুমান মাথায় রেখেই সুনির্দিষ্ট অর্থে লেখাটির অবতারণা। তাই এটি শুধু বাণিজ্য নয়, সাধারণ অর্থেই বাংলা সিনেমার একটি খণ্ড চিত্র। এখানে ধারাবাহিকভাবে সফল হওয়া নির্মাতাদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। সেই বিষয়ও মাথায় রাখলে সুবিধা হবে।]
আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ সিনেমার দৃশ্য
জহির রায়হানের অন্তর্ধানের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার দেড় মাসের মাথায় বড় ধরনের ধাক্কা খায় বাংলাদেশের সিনে জগত। ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রির বাণিজ্যিক বা শৈল্পিক; যেকোনো ধারায় তার নাম আসবে অগ্রপথিক হিসেবে। অবশ্য বাণিজ্যিক ও শৈল্পিক কতটা প্রয়োগিক তা সব সময় সংজ্ঞায়িত করা মুশকিল। যাই হোক; প্রসঙ্গটি জহির রায়হান। অভিনেতা, অন্য কলাকুশলীর পাশাপাশি তিনি ছিলেন নির্মাতা তৈরির কারিগরও। তার হারিয়ে যাওয়ার পর শিষ্যদের অনেকেই নির্মাণ চালিয়ে গেছেন। তাদের হাত ধরে শক্তিশালী রাজনৈতিক বয়ান পর্দায় উঠে এসেছে। বাণিজ্যিক ছবিতে সফল ছিলেন তার শিষ্যদের অন্যতম আমজাদ হোসেন। নয়নমণি থেকে শুরু করে জন্ম থেকে জ্বলছি, ভাত দে বা দুই পয়সার আলতার মতো সিনেমায় উঠে এসেছে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া দেশের অবক্ষয় ও গণতন্ত্রহীনতা। মধ্যবিত্তের পাশাপাশি একদম প্রান্তিক মানুষের জবানে এসেছে সদ্য স্বাধীন দেশের যন্ত্রণা। জনপ্রিয়তা পাওয়া এসব সিনেমা একদম মানুষের কাছাকাছি।
বরাবরই বাংলা সিনেমার বাণিজ্যিক ধারার প্রধান লড়াই ছিল সামন্তবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রীয় চরিত্রের সমান্তরালে গণতন্ত্র বা ব্যক্তিমানুষের বিকাশ ততটা উঠে আসেনি এসব সিনেমায়। তাই সামাজিক প্রশ্নগুলো উচ্চকিত থাকলেও এ নিদান হয়নি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। উল্টো দিকে প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে আত্মপরিচয়ের সন্ধানে গিয়ে বারবার হোঁচট খেয়েছে অন্য ধারাটি। এসব সিনেমা কিছু ব্যতিক্রম বাদে সমসাময়িক বা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারেনি। অবাক হওয়ার বিষয় নয় যে, প্রথাগত ছবির তুমুল সমালোচক হলেও জহির রায়হানের আরেক শিষ্য আলমগীর কবির মহানায়ক বা পরিণীতার মতো বাণিজ্যিক সিনেমায় সমর্পণ করেন নিজেকে। তবে তার সবচেয়ে বড় কাজ ‘রূপালি সৈকতে’ নিয়ে বাংলাদেশের দর্শক বা বোদ্ধা কেউই সুবিচার করতে পারেননি।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ছবি ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ থেকে ‘বসুন্ধরা’র মতো সাহিত্যনির্ভর সিনেমা উপহার দিয়েছেন সুভাষ দত্ত। যুদ্ধের আগে তার অভিষেক, বরাবরই শৈল্পিক নির্মাণে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। সিনেমার পোস্টার আঁকা দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন তিনি, পূর্ব পাকিস্তানে নির্মাণ করেছিলেন দুটি ভিন্ন গল্প নিয়ে আলাদা আলাদা সিনেমার কোলাজ ‘আয়না ও অবশিষ্ট’। পরে সামাজিকধর্মী বেশকিছু হিট সিনেমা উপহার দেন তিনি।
আশির দশকে অ্যাকশনের রমরমা বাজারের মধ্যে যুদ্ধপরবর্তী বাস্তবতা ও সামাজিক ধারায় সফল ছিলেন ঢাকাই নির্মিত প্রথম সিনেমা ‘জাগো হুয়া সাভেরা’র নায়ক খান আতাউর রহমান। ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ও ‘সুজন সখী’ তার উল্লেখযোগ্য নির্মাণ। যুদ্ধের আগে নির্মাণ করেছিলেন ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’, যা কিনা বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের প্রতীকী ব্যঞ্জনা ও তাৎপর্যে আবর্তিত। সমসাময়িক মহিউদ্দিনের দয়াল মুরশিদ, ঈসা খাঁ বা বড় ভালো লোক ছিল বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। একই ধারায় সবচেয়ে সফল ছিলেন আজিজুর রহমান। তার উল্লেখযোগ্য ছবি ছুটির ঘণ্টা, জনতা এক্সপ্রেস ও অশিক্ষিত। এসব সিনেমা সামাজিক বার্তাকে নাটকীয় কায়দায় তুলে ধরেছে। আবার বিদেশের লোকেশনে সর্বাধিক সিনেমা করেন আজিজুর রহমান বুলি। একদম পারিবারিক সিনেমায় জনপ্রিয় ছিলেন নারায়ণ ঘোষ মিতা, যার অন্যরকম ‘আলোর মিছিল’, যুদ্ধ পরবর্তী বাস্তবতা নিয়ে হাতেগোনা কয়েকটি সিনেমার একটি এটি। এর কাছাকাছি সিনেমা ছিল খাত আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’। কিন্তু এ ধারা ততটা বিকশিত হয়নি। এছাড়া ‘অবুঝ মন’ বা ‘বধূ বিদায়’-এর মতো হৃদয়স্পর্শী সিনেমা নির্মাণ করেছেন কাজী জহির।
বাণিজ্যিক সিনেমার বিকাশে আরেকজনের নাম না নিলে নয়, এহতেশাম। যিনি শুধু নির্মাতাই নন শবনম, শাবানা থেকে শাবনাজ বা শাবনূর অনেক তারকা ও নির্মাতা এসেছেন তার হাত ধরে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে তার আইকনিক সিনেমা ‘চাঁদনী’। তবে ‘দূরদেশ’-এর বেহিসেবি যৌথ প্রযোজনার জন্য সমালোচিতও হন তিনি। ভারতের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনার সেই সামঞ্জস্যহীন ধারা এখনো বিদ্যমান।
রাজনৈতিকভাবে ভঙ্গুর সমাজের একটি রূপ দেখা যায় জহিরুল হকের ‘রংবাজ’ ছবিতে। যেটি কিনা যুদ্ধের কয়েক বছর পর মুক্তি পায়। একে শুধু প্রথম অ্যাকশন সিনেমা হিসেবে দেখলে চলবে না। সেই মারকুটে নায়কের পেছনে সম্ভবত এই প্রেরণা ছিল যে, যুদ্ধ করে যখন গণতন্ত্র আসেনি, আসো লড়াই করেই নিজের অধিকার কেড়ে নিই। জহিরুল হক পরে স্যারেন্ডার, বিজয়ের মতো সফল সিনেমা নির্মাণ করেছেন।
ফোক বা আরব্য রজনীর জনপ্রিয়তা যুদ্ধের আগেও ছিল। সত্তরের শেষ দিক ও আশির দশকে বাণিজ্যিক সফল সিনেমা নাটাই চলে যায় এ ধারায়। সঙ্গে যুক্ত হয় ওয়েস্টার্ন ঘারানা। অনেকেই ধারণা করেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাসনা যে দগদগে ঘা তৈরি করে সমাজকে পিছিয়ে দিয়েছে, তারই প্রতিফলন এ ধারার সিনেমা। ফোক ফ্যান্টাসির রাজা ইবনে মিজানের আবির্ভাব একাত্তরের আগে হলেও পরবর্তী দুই দশকে একের পর এক ব্লকবাস্টার উপহার দেন। তার আলোচিত ‘রাখাল বন্ধু’ ছিল উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেটের’ অনুকরণ। লাইলী মজনু, এক মুঠো ভাত বা চন্দন দ্বীপের রাজকন্যার মতো ছবি রয়েছে তার ঝুলিতে। সমান্তরালে ওয়েস্টার্ন ঘরানার সিনেমায় দারুণ জনপ্রিয়তা পান দেওয়ান নজরুল। হিন্দি শোলের রিমেক ‘দোস্ত দুশমন’ দিয়ে শুরু, এরপর আসামি হাজির, বারুদসহ একাধিক ব্যবসাসফল সিনেমা উপহার দেন। একই সময় ফ্যান্টাসিকে নতুন ধাঁচে পরিবেশন করেন আরও দুই নির্মাতা এফ কবির ও এস এম শফি। যথাক্রমে ‘সওদাগর’ ও ২৬টি দেশে মুক্তি পাওয়া ‘দি রেইন’ তাদের তুমুল জনপ্রিয় সিনেমা।
স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ছবি ‘ওরা ১১ জন’-এর নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম পরবর্তী একাধিক বাণিজ্যসফল সিনেমা নির্মাণ করেছেন। ব্যতিক্রমভাবে সাহিত্যধর্মী সিনেমায় তিনি বেশ সফল ছিলেন। বিশেষ করে ‘দেবদাস’সহ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একাধিক কাহিনী তুলে এনেছেন।
বাংলাদেশের সিনেমার বাণিজ্যিক সফলতার চূড়ান্ত মাইলফলক তোজাম্মেল হক বকুলের ‘বেদের মেয়ে জোসনা’, ছবিটির বাঁধভাঙা জনপ্রিয়তা ভারত পর্যন্ত ছড়িয়েছে। বকুল পরে পাগল মন, বালিকা বধূসহ বেশ কয়েকটি সফল সিনেমা নির্মাণ করেছেন। তার হাত ধরে এ ধারায় জোয়ার এলেও স্তিমিত হতে সময় লাগেনি। এ শতকের শুরুর দশকে এ কে সোহেলের ‘খায়রুন সুন্দরী’ গ্রামীণ গল্প তুলে এনে বেশ সফল হলেও এই নির্মাতা পরে কোনো চমৎকারিত্ব দেখাতে পারেননি।
সামাজিক অ্যাকশন ধারার বেশ লম্বা সময় ধরে জনপ্রিয় সিনেমা উপহার দিয়ে গেছেন এ জে মিন্টু ও শিবলী সাদিক। ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সিনেমায় সহকারী পরিচালক ছিলেন মিন্টু। তার ঝুলিতে রয়েছে সত্যমিথ্যা, বাঁধনহারা, মান সম্মানসহ অনেক জনপ্রিয় ছবি। অন্যদিকে তিনকন্যা, ভেজাচোখ, দোলনা, আনন্দঅশ্রু নির্মাণ করেন শিবলি সাদিক। সম্ভবত নন্দন বিচারে এই ধারার সর্বশেষ সফল পরিচালক জাকির হোসেন রাজু। উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে জীবন সংসার, নিঃশ্বাসে তুমি বিশ্বাসে তুমি ও ভালোবাসা কারে কয়।
আরও উল্লেখযোগ্য হলেন মতিন রহমান। রাঙাভাবি, নারীর মন, বিয়ের ফুল, অন্ধবিশ্বাসসহ অনেক হিট সিনেমা রয়েছে তার। মালেক আফসারী ও মনতাজুর রহমান আকবর বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। আফসারী ক্ষতিপূরণ বা এই ঘর এই সংসার-এর মতো পারিবারিক সিনেমায় তুমুল প্রতিভা দেখালেও পরে অ্যাকশনে ঝুঁকে পড়েন। ছবিগুলো নানাভাবে সমালোচিত হয়। একই কথা প্রেম দিওয়ানা, ডিসকো ড্যান্সার সিনেমার পরিচালক মনতাজুর রহমান আকবরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এবং তাদের সিনেমায় নকলের প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষণীয়।
ঢাকাই সিনেমায় সবচেয়ে বেশি নির্মাণের রেকর্ড এখন পর্যন্ত দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর। ৭৫টির মতো ছবি পরিচালনার পাশাপাশি অজস্র ছবির সঙ্গে বিভিন্ন ভূমিকায় জড়িত ছিলেন। মাটির কোলে, কন্যাদান, নীল দরিয়ার মতো সামাজিক সিনেমার পাশাপাশি সাপ বিষয়ক সিনেমায় রয়েছে তার ওস্তাদি। আবার রবিনহুড-টারজান থেকে শুরু করে সুপারহিরোধর্মী সিনেমার সঙ্গেও জড়িত।
সামাজিক সিনেমার উল্লেখযোগ্য এক পরিচালক কামাল আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধের আগে ফোকধর্মী চলচ্চিত্র দিয়ে তার পরিচালনায় অভিষেক। স্বাধীন দেশে অবাঞ্ছিত, অশ্রু দিয়ে লেখা, রজনীগন্ধা, মা ও ছেলে, ব্যথার দান, লালু ভুলু ও গরীবের বউয়ের মতো চলচ্চিত্রের নির্মাতা তিনি। নব্বই দশক এবং কেউ কেউ আরো পরে পর্যন্ত জনপ্রিয় সিনেমা উপহার দিয়ে গেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন মোতালেব হোসেন, সাইফুল আজম কাশেম, ফখরুল হাসান বৈরাগী, দারাশিকো, ছটকু আহমেদ, রায়হান মুজিব, নূর হোসেন বলাই, মোহাম্মদ হান্নান, এফ আই মানিক ও সৈয়দ হারুন। এর মধ্যে অভিনেতা ও প্রযোজক হিসেবে খ্যাতিমান দারাশিকো। তার নির্মিত ঐতিহাসিক সিনেমা ‘ফকির মজনু শাহ’ বেশি পরিচিত। এছাড়া সিনেমা প্রযোজনা, পরিচালনা থেকে প্রদর্শন পর্যন্ত হাত ছিল শফি বিক্রমপুরীর। তার উল্লেখযোগ্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে রাজদুলালী ও দেনমোহর। তার যমুনা ফিল্মসকে ঢাকাই সিনেমায় একটি ব্র্যান্ড বলা চলে। অন্যদিকে মেরিনা মুভিজের কর্ণধার মোতালেব হোসেন একাধারে প্রযোজক, কাহিনী ও চিত্রনাট্যকার। তার উল্লেখযোগ্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে দুশমন, স্ত্রী হত্যা, হিংসা ও ঘাত প্রতিঘাত।
নায়ক উজ্জ্বলকে অ্যাকশন অবতারে হাজির করেছিলেন মমতাজ আলী। তার ঝুলিতে রয়েছে ঈমান, কুদরত, নসীব, নালিশ, উসিলা, বিশাল ও কারণের মতো অনেক সুপারহিট সিনেমা। ঢাকার অ্যাকশন সিনেমায় বড় নাম বলতে হয় মাসুদ পারভেজ সোহেল রানাকে। তার পরিচালিত ও অভিনীত স্পাই থ্রিলার ‘মাসুদ রানা’ ঢাকাই সিনেমায় কিছু ব্যতিক্রমী সংযোজন। তিনি আবার শহীদুল ইসলাম খোকন, আবুল খায়ের বুলবুল, শামসুদ্দিন টগরের মতো মারপিটনির্ভর সফল পরিচালকদের গুরু। এটা ঠিক যে কয়েক হাজার সিনেমা ঢাকায় নির্মিত হলেও সেই অর্থে পুরোপুরি অ্যাকশন ধারা দেখা যায় না। সেই খামতি কিছুটা পূরণ করেছিলেন শহীদুল ইসলাম খোকন। রুবেলের সঙ্গে জুটি বেঁধে সফল সব সিনেমা উপহার দিয়েছেন। লড়াকু, বিপ্লব, সন্ত্রাস, বিশ্বপ্রেমিক, ভণ্ডসহ নামের সারি দীর্ঘ। তার হাত ধরেই বাণিজ্যিক সিনেমায় হুমায়ুন ফরীদির নবজন্ম ঘটে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর মধ্যে বাণিজ্যিক সিনেমা অনেক সংস্কার ও জীবনধর্মী বিষয় তুলে এনেছে। সমান্তরালে নানান অনিয়মকে সামনে এনেছে। সেই প্রতিবাদ সরাসরি রাজনৈতিক বক্তব্য আকারে খুব বেশি ছবিতে আসেনি। বরং স্থানীয় রাজনীতি বা প্রশাসন কেন্দ্রিক ছিল। কাজী হায়াৎ রাজনীতিসচেতন সিনেমার বড় নাম। আমজাদ হোসেন ও গুটিকয়েকদের মতো সরাসরি রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করেছেন তিনি। আলমগীর কবিরের সঙ্গে সহকারী হিসেবে একটি সিনেমায় কাজ করেন কাজী হায়াৎ। প্রথম ছবি ‘দি ফাদার’ পারিবারিক ঘরানার। কাল্ট খেতাব জুটলেও তার সাফল্য মূলত রাজনৈতিকধর্মী সিনেমায়। দেশপ্রেমিক, সিপাহি, আম্মাজান, লুটতরাজ, ধর তার উল্লেখযোগ্য সিনেমা। নায়ক মান্নার সঙ্গে গড়েছিলেন তুমুল জনপ্রিয় জুটি। তার সাফল্যের পেছনে অন্যতম অনুঘটক ছিল প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে জনগণের অস্বস্তি।
বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ধারার জমজমাট একটি পরিভ্রমণ শেষ হয় নব্বই দশকে। ততদিনে দেশে ‘গণতন্ত্র’ চলে এসেছে। কিন্তু সেই গণতন্ত্র মূলত নতুন একটা লড়াই। সম্ভবত বাণিজ্যিক সিনেমা সেই দিকটি ততটা ধরতে পারেনি। বরং অনেক ক্ষেত্রে জনমানসকে ধরতে না পেরে রাজনীতিহীনতার অংশ হয়েছে বা জনপ্রিয় সিনেমার সংস্কারমূলক অংশ থেকে দূরে সরে গেছে। এ সময় একঝাঁক তারকা এসেছেন। তারা স্বভাবতই নির্দিষ্ট শ্রেণির নায়ক-নায়িকা হয়েছিলেন। কিন্তু তারা তাদের পরিচিত ও লাইফস্টাইলজাত মোড়ক নতুন পরিচয় দিয়েছে। বিজ্ঞাপনী জগতের তাদের ছিল তুমুল চাহিদা। তাদের একাংশের আবিষ্কারক সোহানুর রহমান সোহান। এ নির্মাতার হিট অনেক সিনেমা থাকলেও সমাজকে কোনোভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারেননি। যেভাবে আগের অনেকে হারিয়ে গেছেন, তিনিও তেমন হয়ে থাকলেন। এরপর বিংশ শতকের প্রায় সিকি শতাব্দীজুড়ে যে নামটি পুরো বাংলাদেশের সবাই জেনেছে, গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘মনপুরা’। কিন্তু এই ছবিতে ‘নন্দন’ বহির্ভূত কোনো প্রতিশ্রুতি নেই।
এরপর বাংলা সিনেমাও কিছু ব্যতিক্রম ও বিজ্ঞাপনী ধামাকা ছাড়া এরপর আর জমজমাট বাণিজ্য দেখেনি। তবে দিনে সিনেমার বাণিজ্য নিয়ে নাক চিটকানোর দিনও ফুরিয়ে এসেছে। কিন্তু এ ধারাকে অনাদর-অবহেলা এবং ইতিহাসের খোঁজ না রাখার দায় এখনো কাটেনি। ব্যতিক্রমের মধ্যে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ‘ব্যাচেলর’ বা ‘টেলিভিশন’ বাণিজ্য সাফল্যের পাশে নতুন ভাষা ও গ্রাম-শহরের দূরত্বের যে মীমাংসা ঘটছে; তা কিছুটা ধরতে পেরেছে। কিন্তু বিজ্ঞাপনী সাফল্য যখন সিনেমায় ভর করায় নির্মাতারা সম্ভবত ভবিষ্যতের কোনো স্বপ্ন দেখেননি। সমাজও তাদের কাছ থেকে দূরে সরে গেছে। কিন্তু আমরা বরাবরই বাণিজ্যিক সিনেমাকে অগ্রাহ্য করার ছলে এই দিকটাও অগ্রাহ্য করি। তখন দিনে সিনেমা হয়ে গেছে কনটেন্ট। সর্বশেষ ধারাবাহিক সফলতায় নাম আছে রায়হান রাফীর। কিন্তু তিনি যতটা না নিজস্বতা তৈরি করেছেন তার চেয়ে বেশি দেখা গেছে প্রচারণায় ঝোঁক এবং ক্ষমতা ও প্রবৃত্তির সঙ্গে আপস। এ দিক থেকে দেখলে তার সিনেমার সাফল্য ও বোঝাপড়া স্পষ্ট হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাফীই আমাদের বাণিজ্যিক সিনেমায় মন্দের ভালো
স্বাধীন বাংলাদেশে তিন হাজারের বেশি সিনেমা নির্মিত হয়েছে। যেকোনো অর্থে এই সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে ও মানুষের সামনে জীবন জিজ্ঞাসাকে তুলে আনতে কয়েকশ’ নির্মাতার ভূমিকা রয়েছে। এর মধ্যে নির্মাণে সফল অনেক ছবি নির্মমভাবে বাণিজ্যে ব্যর্থ। ছোট এই লেখায় সফলদের একটি খণ্ডচিত্র তুলে ধরা হলো, নিঃসন্দেহে আরও অনেকেই বাদ পড়ে গেছেন।
*লেখাটি ২০২৩ সালের শুরুতে দেশ রূপান্তর পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আয়োজনে প্রকাশিত। পরে কিছুটা সংযোজন ঘটেছে