ঢাকাই সিনেমার মেগাস্টার অভিনেতারা
মেগাস্টার নিয়ে কথা বলতে গেলে কিছু দর্শক মনে করে নিজের সময়ে তারা যাকে শীর্ষে দেখেছে তারাই শুধু মেগাস্টার। কেন ভাই! আপনার বাবা যে তারকাদের ক্রেজ দেখে বড় হয়েছিল তারা কোথায় গেল! সব যুগেই মেগাস্টার ছিল এবং থাকবে। প্রকৃতির নিয়মেই থাকবে। কেউ কেউ সময়ও নির্ধারণ করে দিচ্ছে এতবছর ইন্ডাস্ট্রিতে রাজত্ব করলে তবেই নাকি মেগাস্টার যাতে নিজের পছন্দের তারকাকে সবার আগে রাখতে পারে। কত যে ক্যালকুলেশন! সোজা হিসাব হচ্ছে প্রথমত চলচ্চিত্র দ্বিতীয়ত ক্রেজ দিয়ে একটা কমিউনিটিকে প্রভাবিত করার মতো ক্ষমতা যারা দেখিয়ে গিয়েছে তারাই চলচ্চিত্রে মেগাস্টার। এমন তারকা আমাদের চলচ্চিত্রে ভালো পরিমাণেই আছে, যাদের জানার ব্যাপ্তি কম তাদের কাছে দু’চারজন মনে হবে কিন্তু যারা ঠিকঠাক জানে চলচ্চিত্র সম্পর্কে তাদের কাছে সংখ্যাটা বেশি হবে। দেখে নেয়া যাক।
‘নায়করাজ’ উপাধিই তাঁকে মেগাস্টার বলার জন্য যথেষ্ট। তিনি বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ করেছেন নায়ক হিসেবে। দীর্ঘ ২৮ বছর নায়ক হয়ে অভিনয় করে গেছেন, বয়স যখন নায়ক হিসেবে আর সাপোর্ট করেনি বাবার চরিত্রেও দাপুটে কাজ করে গেছেন। এক ‘বাবা কেন চাকর’ ছবি দিয়েই বাবাদের চরিত্রকে চলচ্চিত্রে আইকনিক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। তাছাড়া পরিচালক হিসেবেও ‘সন্তান যখন শত্রু’-র মতো ছবি দিয়ে তিনি জনগণের মন জয় করেছেন। চলচ্চিত্রের বাইরেও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা সমাজের কাছে অতুলনীয়। এইসব সাফল্যে তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে মেগাস্টারে পরিণত হয়েছেন।
জসিম বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে যা দিয়েছেন সেটার তুলনা শুধু তিনি নিজেই। দেশের চলচ্চিত্রের একমাত্র তারকা যিনি নায়ক ও খলনায়ক দুই ইমেজেই পরিপূর্ণভাবে সফল হয়েছেন। এমন অনেক দর্শক ছিল জসিমের খলনায়ক থেকে নায়ক হওয়াটা কোনোভাবেই মানতে পারেনি এতটাই জনপ্রিয় খলনায়ক ছিলে। হিন্দি আইকনিক ফিল্ম ‘শোলে’-র রিমেক ‘দোস্ত দুশমন’-এর গাব্বার সিং-এর চরিত্রে সেই সময়ে জসিম মানুষের মন জয় করেছিলেন। তাঁর খলনায়কের ক্যারিয়ারই ছিল দীর্ঘ। তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অ্যাকশনেরও প্রতিষ্ঠাতা যা ‘রংবাজ’ ছবির মাধ্যমে এসেছিল। এই অ্যাকশন সৃষ্টি করাটা তৎকালীন রিভ্যুলুশন ছিল। তাঁর সমসাময়িক তারকাদের মতে জসিম ছিলেন চলচ্চিত্র অন্তঃপ্রাণ, তাঁর চিন্তায় চলচ্চিত্র ছাড়া আর কিছু ছিল না। চলচ্চিত্রের বাইরেও তার ইমেজ ছিল চমৎকার। জসিম শতভাগ মেগাস্টার দেশের চলচ্চিত্রে।
আলমগীর দেশের চলচ্চিত্রের গর্বিত নাম। টল অ্যান্ড হ্যান্ডসাম ফিগারের এত সুন্দর নায়ক কম এসেছে। সব ধরনের চলচ্চিত্রে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। দেশের চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা জুটি শাবানার সাখে তাঁরই। তাঁর ক্যারিয়ারে এমন কিছু চলচ্চিত্র আছে যেগুলোর বিকল্প নেই যেমন ‘দেশপ্রেমিক, ভাত দে, মরণের পরে’। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক বাস্তবতার ওপর নির্মিত এসব চলচ্চিত্র বিশাল জনগোষ্ঠীর মনে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছিল। নায়কের পাশাপাশি বাবার চরিত্রেও তিনি আইকনিক ছিলেন পরবর্তী প্রজন্মের তারকাদের সময়ে। ক্যারিয়ারও দীর্ঘদিনের। তিনি দেশের চলচ্চিত্রের একজন মেগাস্টার।
পাকিস্তান আমলের প্রথম ‘মিস্টার ইস্ট পাকিস্তান’ ও ‘মিস্টার ঢাকা’ নির্বাচিত হন ওয়াসিম। বাপ, চাচাদের কাছে তাঁর ক্রেজ সম্পর্কে গল্প শুনতাম যেটি তুলনামূলকভাবে বর্তমান নায়কদের থেকেও বেশি ছিল। চিন্তা করা যায় তৎকালীন সময়ের প্রথম বডি বিল্ডার হিরো! কত আধুনিক ছিলেন তিনি! ওয়াসিমের জনপ্রিয়তা থেকে প্রচুর সুপারহিট ছবি ও গান চলচ্চিত্রে এসেছে। অলিভিয়া ও অঞ্জু ঘোষের সাথে সুপারডুপার হিট জুটি ছিল। তাঁর যত সুপারহিট গান আছে বেশিরভাগই আইকনিক যা বর্তমানে অনেক তারকাদের কল্পনার বিষয়। ওয়াসিম শতভাগ মেগাস্টার দেশের চলচ্চিত্রে।
তাঁকে বলা হত ‘ড্যাসিং হিরো’। তাঁর প্রভাব এতটাই ছিল যে দেশের চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকনের মতো পরিচালকও তাঁকে গুরু মানতেন। রুবেলের মতো সেরা মার্শাল আর্ট হিরোর চলচ্চিত্রে সাফল্যের কৃতিত্বও সোহেল রানার মাধ্যমেই এসেছে। তিনিই তার গাইড ছিলেন। জসিমের মতো মেগা তারকাও সোহেল রানার কিছু ছবিতে চরিত্রের দিক থেকে পিছিয়ে ছিল। নায়কের পাশাপাশি পরিচালক হিসেবেও তিনি অসাধারণ ছিলেন। সেই সময়ের ‘মাসুদ রানা, জীবননৌকা’-র মতো ছবির নির্মাণ দেখলেই সেটা বোঝা যায়। সেই সময়ই তাঁর পরিচালনাতে আধুনিকতা ছিল। আমাদের আগের প্রজন্মের সাথে কথা বলুন দেখুন সোহেল রানা কি ছিল তারা বলে দেবে। তিনি ১০০% মেগাস্টার।
চলচ্চিত্র ও সামাজিক কার্যক্রম মিলিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন আইকনিক এক নাম। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে দুর্দান্ত সফল নায়ক। তার ক্যারিয়ারের গ্রাফ নিয়ে তখনকার পত্রিকায় সরাসরি বলা হয়েছিল ‘রাজ্জাকের পর কাঞ্চন’। এটা তাঁর চলচ্চিত্রের একটা প্রভাবের ফসল। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ দিয়ে আপামর জনসাধারণের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়া ইলিয়াস কাঞ্চন সব ধরনের ছবিতেই শতভাগ সফল। সাপের ছবি ‘শঙ্খমালা’-ও সে বছরের সর্বোচ্চ ব্লকবাস্টার ছবি ছিল। ফ্যামিলি ড্রামার বস ছিল কাঞ্চন। মানুষ বলে তাঁকেই চলচ্চিত্রের গল্পে সবচেয়ে বেশি ভুল বোঝা হয়েছে তার মানে সেই ইমেজ কতটা বাস্তবসম্মতভাবে তৈরি হয়েছিল সেটা তো বলাই যায়। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের মাধ্যমে লম্বা সময় ধরে কাঞ্চন দেশের মানুষের কাছে স্মরণীয় ও শ্রদ্ধেয় হয়ে আছে। এরকম সামাজিক কার্যক্রম আর কোনো নায়ক করেনি দীর্ঘসময়ে। ইলিয়াস কাঞ্চন দেশের চলচ্চিত্রে মেগাস্টার।
মান্না হচ্ছে দীর্ঘ সময়ে স্ট্রাগল করে টপ পজিশনে আসা একমাত্র নায়ক। ধৈর্যের নিখুঁত পরিচয় দেয়া নায়ক। অ্যাকশন চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা নায়ক এবং পলেটিক্যাল গল্পের চলচ্চিত্রের একমাত্র আইকনিক নায়ক। তাঁর মতো এসব চলচ্চিত্রে এত বাস্তবসম্মত অভিনয় আর কেউ করেনি। ‘গণমানুষের নায়ক’ হিসেবে তাঁর ইমেজ গড়ে উঠেছিল। প্রতিবাদী কোনো ইমেজে মান্নার মানুষ বেছে নেয় অনায়াসে। নিজের সময় পার করে বর্তমান সময় পর্যন্ত মান্নার প্রভাব মারাত্মক। ‘আম্মাজান, দাঙ্গা, দেশদ্রোহী, বর্তমান, শান্ত কেন মাস্তান, যন্ত্রণা, ত্রাস, লুটতরাজ, ধর, তেজী, কষ্ট, বীর সৈনিক, আমি জেল থেকে বলছি’ এত আইকনিক রাজনৈতিক চলচ্চিত্র আর কারো ক্যারিয়ারে নেই। রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো মানুষের চূড়ান্ত বাস্তবতা আর সেখানেই মান্না কিংবদন্তি। তাঁর নাম আসলেই মানুষের মধ্যে বিশাল একটা কিছুর আভাস দেয় এই প্রভাব অবশ্যই মেগাস্টারের জন্য যথেষ্ট।
এই একটি নাম বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সবসময় বিশেষ একটি নাম হয়ে থাকবে। টুইটারে ভারতীয় দর্শকের কাছ থেকেই একটা পোস্ট এসেছিল যে দর্শক নব্বই দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মেগাস্টার বলেছেন সালমান শাহকে। শাহরুখ খানের সাথে সালমান শাহর যে ছবিটা পাওয়া যায় সেটা পোস্ট করে লিখেছিল। সেই সময়ই বাইরের দেশের দর্শক তাঁকে সেভাবে চিনত ভাবা যায়! অনেকে ঠুংকো যুক্তি দেয় সালমানের অকালমৃত্যুর পরেই বেশি আলোচিত হয়েছে। সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। বেঁচে থাকতেও সালমানের আকাশছোঁয়া ক্রেজ ছিল। তখনকার সময়ে সবচেয়ে ক্রেজ ছিল। সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিকও ছিল নায়কদের মধ্যে। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’-র পর তখনকার সময়ে সালমানের ছবিই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবসাসফল ছবি হয়েছিল ‘স্বপ্নের ঠিকানা’। ক্রেজটা জাস্ট চিন্তা করুন কোথায় ছিল। আনন্দ বিচিত্রার মতো সেরা বিনোদন পত্রিকা তখন লিখেছিল ‘সালমান শাহ : সবাইকে ছাড়িয়ে’। মৃত্যুর পর সালমানের প্রভাব আরো বেড়েছে সেটা কেন হয়েছে? কারণ তাঁর অভাবটা ছিল অপূরণীয়। প্রতিভার প্রভাবটা আগে দেখতে হবে কেন তাঁকে নিয়ে এখনো কথা হয়। নব্বই দশকীয় প্রজন্ম ছাড়িয়ে আজকে একবিংশ শতাব্দীর মানুষেরাও কেন তাঁকে নিয়ে এত মুগ্ধ সেই প্রভাব আগে চিন্তা করেন। আদর্শ নায়কের কথা বা কোন নায়কের মতো হতে চায় বর্তমান প্রজন্মের নায়কেরা সে প্রশ্নে সালমানই কেন প্রথম চয়েজ হয় সেটা আগে ভাবুন। এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ইমেজই তাঁকে আইকনিকভাবে মেগাস্টার বানিয়েছে। এটা সবাই নাও বুঝতে পারে।
দেশের চলচ্চিত্রে অ্যাকশনের ব্যাপ্তি এবং দর্শকের কাছে তুমুল জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে যার অবদান চিরস্মরণীয় তার নাম রুবেল। জাহাঙ্গীর আলম শুরুটা হয়তো করেছিল কিন্তু পরিপূর্ণতা দিয়েছিল রুবেল। মার্শাল আর্টের অতুলনীয় পারদর্শিতায় রুবেল দেশের আনাচে-কানাচে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাকে দেখে অনেকে শিখত এটা এমনকি ছবি দেখেই শিখত বা প্র্যাকটিস করত। রুবেলের মার্শাল আর্টভিত্তিক বহু ছবির ভিউকার্ডের রমরমা বিজনেস ছিল। তার ক্যারিয়ারে বহু বছর ফ্লপ ছবি ছিল না এবং সিনেমাহল গরম থাকত তার ছবি আসলে। রুবেল অবশ্যই এদেশের চলচ্চিত্রের মেগাস্টার।
শাকিব খান নব্বই দশক যেটা ছিল বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ সময় সেই সময়ের সর্বশেষ আবিষ্কার যে এখন পর্যন্ত নিজের রাজত্ব ধরে রেখে কাজ করে যাচ্ছে। দীর্ঘ ক্যারিয়ার এবং বহু হিট, সুপারহিট ও ব্লকবাস্টার ছবির নায়ক। প্রতিযোগিতা করে নিজেকে টপ পজিশনে আনা এবং সেখান থেকে নিজেকে ধরে রেখে ধারাবাহিক সাফল্য দিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করা নায়ক। তার সময়ের নায়কেরা অনেকেই হারিয়ে গেলেও শাকিব খান একচেটিয়া রাজত্ব করে গেছে, অনেকের মতে সেটা ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশ না থাকার কারণে। হ্যাঁ এটা ফ্যাক্টর তবে সেটার জন্য যারা টিকে থাকতে পারেনি তাদেরই ব্যর্থতা তাছাড়া উঠতি ক্যারিয়ারে প্রতিযোগিতা করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শাকিব। তাকে ঘিরেই বর্তমান সময়ে বড় ছবির মেকানিজম তৈরি হচ্ছে এবং একমাত্র তার উপর ভরসা করেই সফল ছবির গ্যারান্টি পাওয়া যাচ্ছে এটাও বড় বিষয়। বিশাল ফ্যানবেজ তৈরি করার পারঙ্গমতাও তার ক্যারিয়ারে আছে। এসব ফ্যাক্টরে শাকিব খান এখন পর্যন্ত চলচ্চিত্রের শেষ মেগাস্টার।
স্পেশাল মেনশন হিসেবে ফারুকের গ্রামীণ চরিত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানকে বিবেচনায় আনা যেতে পারে, তবে সেটা তর্কসাপেক্ষ।