ঢাকা অ্যাটাক : দর্শকের মুখে হাসি
ঢাকা অ্যাটাক। নামেই বলা আছে ছবির গল্প। ভয়ানক কোন সন্ত্রাসী চক্রের ঢাকা শহরে আক্রমণ ছবির বিষয়বস্তু হবে এটা পূর্ব প্রত্যাশিত। কিন্তু আক্রমণ প্রতিহত করতে কেমন তৎপরতা থাকবে আইনরক্ষাকারী বাহিনীর এটাই ছিল প্রধান আকর্ষণ।
বাংলাদেশের আইনরক্ষাকারী বাহিনী, অর্থাৎ বিমান, নৌ ও স্থল (সেনাবাহিনী ও পুলিশ) জাতিসংঘ শান্তি রক্ষী মিশনে একটি ব্র্যান্ড নেম। দেশের বাইরের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরেও তারা সদা আইন ও শান্তি রক্ষার কাজে নিয়োজিত। দেশের জনগণ যখন শান্তিতে ঘুমায়, তখনও তারা নিজেদের ঘুম ত্যাগ করে জনগণের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। অপরাধ প্রতিনিয়তই হচ্ছে, কিন্তু সেই কিছু সংখ্যক অপরাধকে ছাপিয়ে যাবে তাদের অবদান। সাম্প্রতিক গুলশান হামলার পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ প্রচেষ্টা, শোলাকিয়ায় বড় রকমের হত্যাকাণ্ডের প্রচেষ্টা থেকে উত্তরণসহ জাতীয় জীবনে অনেক প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখে চলেছে তারা। তেমনি পুলিশ বিভাগের ভিতরকার কাজের কিছু না জানা গল্প ‘ঢাকা অ্যাটাক’।
সংক্ষেপে গল্পটি হল – একটি কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি থেকে কেমিস্ট ও দারোয়ানসহ কয়েকজনকে খুন করে কিছু কেমিক্যাল চুরি হয়। কেমিক্যালগুলো আপাতদৃষ্টিতে তেমন মূল্যবান কিছু নয়। কিন্তু এর মূল্যমান সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় আরও কয়েকটি খুন ও বিস্ফোরণের পর। পুলিশ বাহিনী সতর্ক হয় এবং তাদের কাজে তৎপর হয়। ডাকা হয় পুলিশ বিভাগের সেরা অফিসারদের, গোয়েন্দা বিভাগের সাজেদুল করিম, বোমা নিস্ক্রিয়করণ দলের প্রধান আবিদ রহমান ও সোয়াট দলের কমান্ডার আশফাক হোসেন। আবিদ ও আশফাকের তদন্তের কাজ অনুসরণ করে সাংবাদিক চৈতি। সেও তদন্ত করে কিছু তথ্য খুঁজে পায়। সব তথ্য একত্র করে খুঁজে পায় এই সব ঘটনার মূল হোতাকে।
গল্পের গাঁথুনি চমৎকার, কোন অসামঞ্জস্যতা নেই। পুলিশ বিভাগের নিজস্ব গল্প এটি। লিখেছেনও ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সানী সানোয়ার। পরিচালনা করেছেন তারই বন্ধু ও টেলিভিশন নাটক নির্মাতা দীপঙ্কর দীপন। এটি দুজনেরই চলচ্চিত্রে প্রথম কাজ। কিন্তু খুবই পেশাদারী মনোভাব নিয়ে তাদের কাজ সম্পন্ন করেছেন। পুলিশ অ্যাকশন থ্রিলার হিসেবে অপরাধ সংগঠিত হওয়া, তদন্ত, তদন্ত প্রতিবেদন, পদক্ষেপ গ্রহণ, অপরাধীকে সনাক্ত করা সবকিছুতেই পেশাদারীত্বের ছাপ ছিল।
মূল চরিত্রে আরিফিন শুভ বোমা নিস্ক্রিয়করণ দলের প্রধান আবিদ রহমান চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এই ধরনের চরিত্রে এটি তার প্রথম কাজ হলেও পূর্বে ‘কিস্তিমাত’ (২০১৪) ছবিতে পুলিশ ইনস্পেকটর, ও ‘মুসাফির’ (২০১৬) ছবিতে সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টের কাছ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এক অপরাধী চরিত্র এই ধরনের চরিত্রের পূর্বপ্রস্তুতি বলা যেতে পারে। কিন্তু মুসাফির থেকে এই ছবিতে তার অভিনয়ে উন্নতি হলেও পূর্বপ্রস্তুতি অনুযায়ী তা সম্পূর্ণ নয়। কিছু ক্ষেত্রে তিনি আগের থেকে ভালো করেছেন এবং তাকে পুরোদস্তুর পেশাদার বোমা নিস্ক্রিয়করণ দলের একজন মনে হয়েছে, বিশেষ করে শেষ দৃশ্যে বোমা নিস্ক্রিয়করণ কাজের সময়। এটি তার অভিনয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে থাকবে। তবে তার হেয়ার স্টাইলের উলট-পালট দর্শককে ভুগিয়েছে বেশ!
প্রধান নারী চরিত্রে ছিলেন মাহিয়া মাহি। তদন্তকারী সাংবাদিক চরিত্রে এর আগেও তিনি দুটি ছবি, ‘দেশা : দ্যা লিডার’ (২০১৪) ও ‘ওয়ার্নিং’ (২০১৫) ছবিতে কাজ করেছেন। ফলে তার চরিত্রে নতুনত্বের সুযোগ কম ছিল। তাকে আগে থেকে দেখতে সুন্দর লেগেছে। তার পর্দায় উপস্থিতি হতাশাজনক না হলেও তার অভিনয়ে তেমন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি।
সেক্ষেত্রে প্রধান চরিত্রগুলোকে ছাপিয়ে গেছে পার্শ্ব চরিত্রগুলো। সোয়াট দলের কমান্ডার আশফাক হোসেন চরিত্রে এবিএম সুমন তার সম্পূর্ণটুকুই দিয়েছেন। তাকে এককথায় পেশাদার সোয়াট সদস্যই মনে হয়েছে। তার পেশাদারী কর্তব্য পালন অন্যদিকে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, এই দুই পরিস্থিতির মধ্যে কর্তব্যকে প্রাধান্য দেওয়ার চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছেন অসাধারণভাবে। সুমনের বিপরীতে তার স্ত্রীয়ের ভূমিকায় ছিলেন কাজী নওশাবা আহমেদ। তার পর্দায় উপস্থিতি অল্প সময়ের হলেও তার চরিত্রটি নিয়ে কিছুটা উত্তেজনা ছিল, যেমন মিসক্যারিজ বা মৃত্যু। তার সৌন্দর্য ও আশফাক তাকে ছেড়ে যাওয়ার সময় তার নির্বাক চাহনি মুগ্ধকর ছিল। গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা সাজেদুল করিম চরিত্রে শতাব্দী ওয়াদুদ ধুর্ততা, চৌকস অভিব্যক্তি ও বিচক্ষণতাকে দারুণ রূপ দিয়েছেন।
পুলিশ বিভাগের অন্যান্য উপরিমহলের কর্মকর্তার ভূমিকায় আফজাল হোসেন, আলমগীর এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চরিত্রে সৈয়দ হাসান ইমামের চরিত্রগুলোতে অভিনয় দক্ষতার কোন কমতি ছিল না। তবে এক মিনিটের মত পর্দায় উপস্থিতিতে আইজি চরিত্রে আলমগীর যেরকম আঙুল তোলে শাসিয়ে কথা বলছিল, গত কয়েক বছরে পুলিশের আইজি নূর মোহাম্মদ বা শহীদুল হককে এরকম করতে দেখিনি, যা দৃষ্টিকটু লেগেছে।
খল অভিনেতা সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে পুরো ক্লাইম্যাক্স বলা হয়ে যাবে। গতানুগতিক ধারার বাইরে গত বছর ‘মুসাফির’ ছবিতে খল চরিত্রে পেয়েছিলাম সোহেল মণ্ডলকে। কিন্তু নৃশংসতা ও পরিপক্কতায় তাসকিন রহমান তার চেয়ে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে। তার অভিনয়ের ব্যাপারে শুধু এইটুকু বলব আরও কোন মনোনয়নের প্রয়োজন নেই, এই বছরের সেরা খল অভিনেতার পুরস্কার তাসকিন রহমানের।
চলচ্চিত্রটির দৃশ্যায়ন চমৎকার। দৃশ্যায়নের জন্যও নির্বাচন করা হয়েছে গল্প উপযোগী লোকেশন, বিশেষ করে বান্দরবনের লোকেশন। তবে হ্যান্ডিক্যামে যেসব চিত্র ধারণ করা হয়েছে তার প্রায় বেশির ভাগ দৃশ্যই কাঁপাকাঁপা এসেছে। ডিজিটাল যুগে এসেও আমরা এখনো ভিএফএক্সের কোন ভাল কাজ পাচ্ছি না। বোমা বিস্ফোরণের দৃশ্যে ব্যবহৃত ভিএফএক্সের কাজগুলো আরও যত্নের সাথে করা যেত। এতে কিছুটা আনাড়িপনা চলে এসেছে। প্রতিবার বাজেট স্বল্পতার কথা বলে এই বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়া ঠিক এখন আর কাজে দিচ্ছে না।
ছবির আরেকটি ভালো দিক ছিল আবহ সঙ্গীত, যা প্রতিক্ষণে টান টান উত্তেজনা ধরে রেখেছে। গানের ক্ষেত্রে অরিজিৎ সিং ও সোমলতার গাওয়া ‘টুপ টাপ’ গানের প্লেসমেন্ট ঠিক ছিল এবং দৃশ্যায়নও সুন্দর ছিল। কিন্তু কথাগুলো অগোছালো লেগেছে। সেক্ষেত্রে তৃপ্তি দিয়েছে অদিতের গাওয়া ‘পথ যে ডাকে’। মতিন চৌধুরীর কাওয়ালি ধাঁচের ‘টিকাটুলির মোড়ে’ গানটিকে নতুনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে ছবিতে। গানটি পূর্বে থেকেই জনপ্রিয় ছবির দৃশ্যায়নের সাথে এর আবেদন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
সাম্প্রতিক কালে কিছু বাণিজ্যিক অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্রকে আমরা মন্দের ভালো বলেছি। সেই অর্থে এটি নিঃসন্দেহে ভালো নির্মাণ। খুব ভালো বলছি না, তার কারণও উপরে লিখেছি। এই ত্রুটিগুলো এড়িয়ে যেতে পারলে ছবিটি ওভারঅল খুব ভালো একটি ছবি হতো। যাই হোক, দেশীয় চলচ্চিত্রে এটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করতে সক্ষম হয়েছে। এটি অবশ্যই আপনার ওয়াচলিস্টে রাখতে পারেন।