Select Page

ঢাকা অ্যাটাক : যে ছবি আমরাও পারি বানাতে

ঢাকা অ্যাটাক : যে ছবি আমরাও পারি বানাতে

পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি – ঢাকা অ্যাটাক

পরিচালক – দীপঙ্কর দীপন

শ্রেষ্ঠাংশে – আরিফিন শুভ, এবিএম সুমন, মাহিয়া মাহী, নওশাবা, শিপন মিত্র, সৈয়দ হাসান ইমাম, আলমগীর, আফজাল হোসেন, তাসকিন রহমান প্রমুখ।

উল্লেখযোগ্য গান – টুপটাপ, টিকাটুলীর মোড়, পথ যে ডাকে, তেলাপোকা পাখি না।

মুক্তি – ৬ অক্টোবর ২০১৭

রেটিং – ৮.৫/১০

আমাদের ঢালিউড ইন্ডাস্ট্রিতে বর্তমান প্রজন্মের দর্শক অন্য সব প্রজন্মের দর্শক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তারা প্রতিনিয়ত আপডেটেড কিছু চায়। ছোটবেলা থেকে একই গল্পের গতানুগতিক ছবি অনেক দেখে এসেছে তাই এখন তারা সেসব থেকে মুক্তি চায়। মুক্তির উপায়গুলো এক একজনের কাছে এক একরকম হলেও মিল একটা জায়গাতেই যে তাদের প্রত্যাশা অনেক। প্রত্যাশার পারদ সচল রাখতে এবছরের অন্যতম আলোচিত ছবি ‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর আগমন ঘটেছে। দেশের প্রথম পুলিশ থ্রিলারের আয়োজন দর্শক বিপ্লব ঘটিয়ে মন্দার ইন্ডাস্ট্রিতে এক পশলা বৃষ্টি ঝরালো।

একটা ছবির অ্যারেজমেন্ট যখন বিগ বাজেটের সাথে দর্শকের অনেক প্রত্যাশাকে যোগ করে সেটার আলাদা একটা অধ্যায় শুরু হয়। ‘ঢাকা অ্যাটাক’ সে কাজটি করেছে। এ ছবির পেছনে ছবির প্রতিটি সেক্টরে কাজ করা মানুষগুলোর নিজস্ব আইডিওলজি কাজ করেছে। তারা কি করে দেখাতে পারে সেটাই ছিল আল্টিমেট চ্যালেন্জ। যত সুনির্মিত ছবিই হোক ছবি দেখার পর দর্শক-সমালোচকের তীক্ষ্ণ চোখে সীমাবদ্ধতা ধরা পড়বেই পাশাপাশি ট্রল, সার্কাজম বা পরশ্রীকাতর বিষয়ও থাকবে। সেগুলোকে অভিজ্ঞতা হিশাবে নেয়ার অপশন থাকে। ‘ঢাকা অ্যাটাক’ এসব কিছুকে ধারণ করেই এগিয়েছে ও এগিয়ে যাচ্ছে।

ছবিটির ওভারঅল নানা বিষয় বিশ্লেষণের জন্য ক্রম মেইনটেইন করে গেলে অনেককিছু একসাথে দেখা যাবে। তো শুরু করা যাক আমরা কি পারি বা পেরেছি করে দেখাতে-

১. নির্মাতার দর্শন :

‘এই থানা-পুলিশের বাইরেও একটা বড় পুলিশিং আছে। তারা অনেক স্মার্ট। তারা বিষয়গুলো অনেক সায়েন্টিফিকভাবে ডিল করে, সমাধান করে। এটা পুরো মানুষকে জানানো দরকার। সো এই জায়গা থেকে এই ছবিটার ভাবনাটা শুরু।

যখন কোনো বড় অ্যাটাক হয় দেখা যায় মিডিয়া খুব দ্রুত একটা নাম করে দেয় যেমন-প্যারিস অ্যাটাক। সেরকম। টিভি স্ক্রলে যখন এটা যাবে সেখান থেকে নামটা পিক করা ঢাকা অ্যাটাক।’ – দীপঙ্কর দীপন

যমুনা টিভি-কে দেয়া ‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর সাক্ষাৎকারে থিমেটিক বিষয়টি বলেছেন নির্মাতা। পুলিশ থ্রিলারের বিষয়টি অনেকের কাছে হয়তো হালকা মনে হতে পারে তাই নির্মাতা তার দায়িত্বটা পালন করেছেন। পুলিশ আসামী গ্রেফতার করবে, এজাহার লিখবে, আসামীকে টর্চার করবে, কোর্টে চালান দেবে, ঘুষ খাবে এসবই চিরাচরিত ছিল। কিন্তু এসবের বাইরেও যে আলাদা বিষয় আছে পুলিশের যার মধ্যে গর্ব করার অপশন আছে সেগুলো ছবিতে দেখানো হয়েছে। পুলিশের স্মার্ট তদন্ত, সরেজমিনে ঘোরা, নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে বুদ্ধি ও মেধা খাটিয়ে এগিয়ে যাওয়া এসব ছিল ছবির মূল দিক। নির্মাতা তার জায়গায় স্ট্রং।

২. প্রযোজকের দর্শন :

‘এটা সিনেমা হচ্ছে এটা পুলিশের কোনো ডকুমেন্টারি না। লাস্ট নাইন ইয়ারস আই অ্যাম ওয়ার্কিং ইন দ্য ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চ। সো এখানে ল ইনফোর্সমেন্ট অ্যাজেন্সির ইনভেস্টিগেশনের যে পার্টটা তাদের অস্ত্র ধরার স্টাইল, তাদের টকিং স্টাইল এগুলো রিয়েলিস্টিক করার জন্য কিন্তু আমি এখানে শুধু লেখক হিশাবেই না এখানে আমি একজন কনসালটেন্ট হিশাবেও কাজ করতেছি।’ – সানী সানোয়ার

ছবির কাহিনীকার ও প্রযোজক সানী সানোয়ার ছবিটির ক্লাসিফিকেশন ক্লিয়ার করেছেন। একে যদি কেউ ভুল করে ডকুমেন্টারির পর্যায়ে নিয়ে যায় তবে ভুল করবে। ভবিষ্যতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য কোনো থ্রিলার হলে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ যাতে একটা উদাহরণ হতে পারে পরবর্তী নির্মাতাদের কাছে প্রযোজক সূক্ষ্মভাবে তা নির্দেশ করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে ছবিটিতে ইনভেন্ট করেছেন এবং তদারকি করেছেন।

৩. পুলিশ থ্রিলার প্রথম যেভাবে :

বলা হয়েছে এ ছবি দেশের প্রথম পুলিশ থ্রিলার। তবে কি এর আগে কোনো থ্রিলারই দেশের ছবিতে আসেনি। এসেছে তবে এ ছবির মতো করে আসেনি। দেখা গেল অন্য ছবিগুলোতে ঘরোয়াভাবে একইরকম পুলিশিং ছিল কিন্তু এ ছবিতে বড় পরিসরে সেক্টর-টু-সেক্টর এসেছে। বোম ডিসপোজাল ইউনিট, সোয়াট বাহিনীর তৎপরতা, গোয়েন্দা বিভাগের কার্যকর্ম, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ, সরেজমিন তদন্ত, ছোট ছোট আলামত নিয়ে এগিয়ে যাওয়া, টার্গেট ফিক্সড করা, টার্গেট ফুলফিল করা এভাবে একটা ক্রোনোলজি মেইনটেইন করে ছবিটি এগিয়েছে। এভাবে নিয়ম মেনে একের পর এক পুলিশি স্মার্ট থ্রিলিং আসেনি। অতঃপর এটা প্রথম পুলিশ থ্রিলার।

৪. মাল্টিস্টারার কাস্টিং :

একটা ছবির আকর্ষণ বৃদ্ধির জন্য তার বিভিন্ন ধরনের অপশন থাকে পরিচালকের হাতে। অন্যতম একটা অপশন ছিল মাল্টিস্টারার কাস্টিং। নায়ক-নায়িকার পাশাপাশি সমসাময়িক জাদরেল আর্টিস্টের সাথে সিনিয়র লিজেন্ডারি আর্টিস্টকে এক করার কাজটি করেছে এ ছবি। আরিফিন শুভ, মাহিয়া মাহী, এবিএম সুমন, নওশাবা, শিপন মিত্র তারা ছিল ছবির কমার্শিয়াল ইলিমেন্টে নায়ক-নায়িকা। সমসাময়িক জাদরেল অভিনেতা শতাব্দী ওয়াদুদ ছিল অন্যতম শক্তি। লিজেন্ডারি আর্টিস্টদের মধ্যে ছিল সৈয়দ হাসান ইমাম, আলমগীর, আফজাল হোসেন-রা। তাদের ভূমিকা কারো একটু বেশি কারো বা ক্যামিও। খলনায়ক তাসকিন রহমান ছিল সম্পূর্ণ নতুন আবিষ্কার। এই মাল্টিস্টারার কাস্টিং ছবিটির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।

৫. টুইস্ট :

ছবির চমক বা টুইস্ট যদি বলি একটা জায়াগাতেই হিট ক্লিক করেছে আর তা হচ্ছে ছবিটির খলনায়ক তাসকিন রহমান। টিভি, ইউটিউব হয়ে চলচ্চিত্রের অভিষেক ঘটিয়ে প্রথমেই চমক দেখিয়ে দর্শকের বড় মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এ ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে অত্যন্ত বিরল।

৬. মানবিক থিমে নির্মাণের উত্তাপ :

ছবির থিম ছিল মানবিক। একটা বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে যে ঘটনার সূত্রপাত ঘটে তার পেছনে অনেকগুলো মানবিক বিষয় এমনিতেই জড়িয়ে যায়। যেমন-

– তদন্তে নৃশংসতার চিহ্ন পাওয়া

– স্বজনদের আহাজারি

– তদন্তের কূলকিনারা করতে পারবে কিনা

– হামলাকারীর পরিকল্পনা ও নৃশংসতার মাত্রা

– হামলাকারীকে ট্রেস করা ও ইমোশনাল পার্ট মেইনটেইন

সরেজমিন তদন্তে আরিফিন শুভ, এবিএম সুমন, সহশিল্পীরা অভিনয় করেছে। পুলিশিং ও সাংবাদিকতা ভিন্নভাবে প্যারালালি সরেজসিনে তদন্ত করেছে বান্দরবান থেকে ঢাকা পর্যন্ত। মাঝখানে আন্তর্জাতিকভাবে তার সূত্রটি শিপন মিত্রের মাধ্যমে এসেছে। স্বজনদের আহাজারি, জনতার ভিড় বা উৎসুক অবস্থা এগুলো ছিল। তদন্তের সিসটেমেটিক সমাধান ছিল। মানবিক বিষয়ের মধ্যে অন্যতম আকর্ষণ ছিল এবিএম সুমন-নওশাবা পার্ট। দম্পতির ভূমিকায় অনাগত সন্তানের স্বপ্ন ছিল। দর্শকের কাছে এটা আলোচিত হয়েছে। মেয়ে সন্তান জন্মের পরে সেটা যখন জানানো হয়েছে সুমনকে ঐ সিকোয়েন্সটি ছিল নতুন প্রজন্মের জাগরণ।

৭. অভিনয়, সংলাপ, গান :

অভিনয়ে মেথড অ্যাকটিংকে নির্মাতা প্রাধান্য দিয়েছেন। আরিফিন শুভ ও এবিএম সুমন তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের অভিনয়ে অসাধারণ। এবিএম সুমনের পারিবারিক অংশ থাকাতে দর্শক সিমপ্যাথি সবচেয়ে বেশি ছিল তার দিকে। এছাড়া তার নিজস্ব স্মার্টনেসও ছিল। ‘সোয়াট’-এর চৌকস সদস্য হিশাবে তার তৎপরতা প্রশংসনীয়। স্পেশালি ক্লোজশটে অপারেশন মুহূর্তে বডি ল্যাংগুয়েজ চমৎকার। শুভ-র থেকে তুলনামূলকভাবে সুমনের লুক বেটার ছিল। শুভ-র বোম ডিসপোজালের কাজের সময় প্রফেশনালিজম প্রশংসনীয়। মাহির অভিনয় সমালোচিত হয়েছে। তার পূর্বের সাংবাদিক ভূমিকার অভিনয়ের ধারাবাহিকতায় ধরলে স্বাভাবিক অভিনয়টাই করেছে। কিন্তু ছবির স্ক্রিপ্টে তার কো-আর্টিস্ট শুভ-র সিরিয়াস সময়ে মাহীর উপস্থিতির কারণে সমালোচনা বেড়েছে। নওশাবা ছিল অল্প সময়ে মনে দাগ কাটা চরিত্র। শিপন মিত্র তুলনামূলকভাবে কোনোরকমে উতরে গেছে। সৈয়দ হাসান ইমাম, আলমগীর, আফজাল হোসেন, শতাব্দী ওয়াদুদ তারা ছিল বর্তমান আর্টিস্টদের জন্য সহায়ক কারণ তাদের উপস্থিতি ছবিকে স্ট্রং করেছে। তাসকিন রহমান টুইস্টের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসে দর্শকমন জয় করা অভিনয় করেছে। তার লুক, অ্যাটিচিউড, এক্সপ্রেশন সব অনবদ্য। নতুন সম্ভাবনা দেখছে দর্শক তাকে ঘিরে।

সংলাপ বলতে গেলে অনেকগুলোই স্মরণীয় সব বলাটা মুশকিল। মানবিক বিষয় বিবেচনায় দু’একটা সংলাপ টাচি ও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন-

* ‘অ্যাকশন ফ্রন্ট আর ফ্যামিলি ফ্রন্ট এক জিনিস নয়’- এটা ছিল মেজোর সংলাপ এবিএম সুমনের। আরিফিন শুভকে কর্মজীবনের সাথে ব্যক্তিজীবনের তফাতটা বুঝিয়ে দেয়।

* ‘নিচের দিকে দেখ এটা তোর নিজের দেশের মাটি। এখানে তোর মা-বাবা শুয়ে আছে’ – শুভর মেজোর সংলাপ। খলনায়ক তাসকিনকে তার শেকড়কে মনে করিয়ে দেয়।

* ‘আমার কাছে আমার স্বপ্ন জীবনের চেয়ে বড়’- মাহীর সংলাপ। স্বপ্নের সাথে জীবন বা পেশাগত ঝুঁকির সম্পর্ক দেখানো হয়েছে।

* ‘পুরো দুনিয়াটাকে দেখাতে চাই যে আমি একা একটা মানুষ কি পারি’- তাসকিনের মেজোর সংলাপ। হামলা করে জনগণকে নিজের ক্ষমতা জানানোর জন্য সহজ ভাষায় এর থেকে শক্তিশালী সংলাপ আর কি হতে পারে!

গানগুলো ভিন্ন ভিন্ন। ‘টুপটাপ’ রোমান্টিক গান। শুভ-মাহীর রোমান্স অনেক আগে থেকে আলোচিত ছিল। ‘টিকাটুলীর মোড়’ ভিন্ন মেজাজের বৈঠকী গান। কালচারাল দিক থেকে ছবির গুরুত্বপূর্ণ গান। ‘পথ যে ডাকে’ স্যাড ভার্সনের। ‘তেলাপোকা পাখি নাকি’ ছোটদের মধ্যে ভিন্ন টেস্টের গান।

৮. ঢাকা অ্যাটাক এক্সট্রিম :

‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর সিক্যুয়েল হবে নির্মাতা জানিয়েছেন। নতুন করে উত্তেজনা তৈরির জন্য এটা অপশন। কি হবে কাহিনী বা কাকে ঘিরে হতে পারে নতুন কাহিনী এরকম একটা ব্যাপার তৈরি করেছেন। এটা কাঙ্ক্ষিত।

৯. অন্য কোনো থ্রিলারের আশা :

এ ছবি থ্রিলারের অন্য দরজাগুলো খুলে দিল। এরপর হতে পারে সেনাবাহিনী বা বিমানবাহিনী কিংবা আরো নতুন কোনো থ্রিলার প্রজেক্ট।

১০. দর্শক বিপ্লব :

‘আয়নাবাজি’-র পরে দর্শক বিপ্লব তৈরি করার আরেকটি ছবি এটা। দর্শক তৈরি করার বা এবিএম সুমনের ভাষায় ‘ডিফারেন্ট দর্শক সিনেমাহলে আনা’-র (থিয়েটার থ্রেড ইন্টারভিউমতে) ক্ষেত্রে ছবিটির অবদান থাকল।

এসবের বাইরেও ভালো ছবি নিয়ে সমসাময়িক নির্মাতাদের পরশ্রীকাতর মনোভাব বা অপপ্রচারের মানসিকতাও দেখা গেছে। এটাও ছবির সময়কার ঘটনা বা অভিজ্ঞতা হয়ে থাকল।

‘ঢাকা অ্যাটাক’ সেই ছবির শুরুটা করল যা ছিল চ্যালেঞ্জ নিতে পারা এবং অন্য নির্মাতাদের-দর্শকদের বলে দিল আমরাও পারি চ্যালেঞ্জিং কিছু করতে। এই ‘কিছু’-টাকে অনেককিছু করার দায় এখন অন্যদের।


Leave a reply