Select Page

ঢাকা নয়, বাংলা ছবির ভরসা ছিল মফস্বল

ঢাকা নয়, বাংলা ছবির ভরসা ছিল মফস্বল

লেখার শুরুতেই আমি ঢাকা শহরের সম্মানিত সিনেমা দর্শকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কারণ আমি এখন আমার দেখা ও অভিজ্ঞতা থেকে এমন কিছু কথা বলবো যা হয়তো ঢাকা শহরের সিনেমা দর্শকেরা মনে আঘাত পাবেন। কাউকে মনে আঘাত দেয়ার জন্য আমি কিছু বলছি না, আমি বলছি শুধু আমার নিজস্ব কিছু উপলব্ধির কথা।

আমার সিনেমা দেখার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে একটি বিষয় আমার কাছে বারবার মনে হয়েছে যে ঢাকার আধুনিক মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণি হলো বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে ‘স্টুপিড’ দর্শক। এই শ্রেণি বাংলা চলচ্চিত্রকে কখনই মন থেকে ভালোবাসতে পারেনি এবং আজও এদের আচার আচরণ ও কথাবার্তা সেটাই প্রমাণ করে। আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে কেন আমার এমন ধারণা তৈরি হলো? তার উত্তরে আপনাদের তা বিস্তারিত বলছি।

৮০র দশকের শেষ ভাগ থেকে পুরো ৯০ দশক ছিল আমার বন্ধুদের নিয়ে সিনেমা হলে বাংলা চলচ্চিত্র উপভোগ করার উত্তাল আনন্দের দিন। সেই সময়ে আমরা রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকা সবকিছু খেয়ালে রাখতাম শুধুমাত্র নতুন নতুন বাংলা সিনেমার খোঁজ খবর রাখার জন্য।সেই তখন থেকে দেখেছি অনেক ভালো ভালো চলচ্চিত্র ফ্লপ খেয়েছে আবার অনেক অনেক মানহীন চলচ্চিত্র সফলতা পেয়েছে ঢাকার সিনেমা দর্শকদের কারণে। আবার এটাও দেখেছি যে অনেক নির্মাতা ঢাকায় ছবি মুক্তি না দিয়ে প্রথমে ঢাকার বাইরের মফস্বল শহরগুলোতে আগে ছবিটি মুক্তি দিতেন এবং ১/২ মাস পর সেই ছবিটি ঢাকায় মুক্তি দিতেন। এই প্রসঙ্গে ‘মাস্টার মেকার’ এ জে মিন্টু’র দর্শকনন্দিত ‘সত্য মিথ্যা’ ছবিটির কথা মনে পড়ে।

যত দূর মনে পড়ে এই ছবিটি আমরা ১৯৮৯ সালের শুরুর দিকে দেখেছিলাম ঢাকার দর্শকদের আগে। ‘সত্য মিথ্যা’ যখন ঢাকায় মুক্তি পায় তার আগেই বিভিন্ন মফস্বল শহরে ছবিটি দর্শকদের মন জয় করে ফেলে অর্থাৎ ব্যবসাসফল ছবির তকমা পায় যার ফলে ছবিটি ঢাকার দর্শকদের কাছেও ভালো সাড়া ফেলে। তোজাম্মেল হক বকুলের সাড়া জাগানো ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবিটিও শুরুর দিকে ঢাকায় সফলতা পায়নি,অথচ ঢাকার বাইরে ছবিটি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। মফস্বল শহরের তোলপাড় দেখে ঢাকার তৎকালীন আধুনিক মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত দর্শকদের মাঝেও ছবিটি দেখার আগ্রহ জন্মেছিল।

মালেক আফসারির ‘ক্ষতিপূরণ’, ছটকু আহমেদের ‘চেতনা’র মতো ছবিগুলো মফস্বলে হিট কিন্তু ঢাকায় ফ্লপ। অথচ ছবি দুটো আমাদের তৎকালীন সময়ে মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে গর্ব করার মতো চলচ্চিত্র। চাষি নজরুল ইসলামের ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ছবিটি যা জাতীয় চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার অর্জন করেছিল সেই ছবিটিও ব্যবসায়িকভাবে মার খেয়ে যায় ঢাকায়। অথচ ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ চলচ্চিত্রটি মফস্বলে ভালো দর্শক পেয়েছিল। সেই সময়ে মুক্তির প্রথম দিন থেকে শুরুতে ঢাকার সিনেমা হলের রিপোর্ট পত্রিকায় সব সময় গুরুত্ব দেয়া হতো বলে যে ছবি ঢাকাসহ সারা দেশে একযোগে মুক্তি পেতো সেই ছবি ঢাকার ব্যবসায়িক রিপোর্ট খারাপ হওয়ায় মফস্বলের অন্য হল মালিকেরা ছবি পরের সপ্তাহে চালাতে অনীহা প্রকাশ করতো।যার ফলে অনেক পরিচালক মাঝে মাঝে ঢাকার বাইরে তার ছবিটা প্রথমে মুক্তি দিতো।

এমন আরও অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে যেখানে ঢাকাসহ  একযোগে মুক্তিপ্রাপ্ত অনেক গর্ব করার মতো মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র শুরুতেই ঢাকায় হোঁচট খেয়েছিল যার প্রভাবে প্রযোজক ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। অনেকে মফস্বলের বিভিন্ন হলে দিনের পর দিন প্রদর্শন করিয়ে বিনিয়োগ তুলে এনেছিলেন। ঢাকার দর্শকদের এমন আচরণের হাত থেকে মূলধারা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের সাহিত্য নির্ভর চলচ্চিত্র ‘রামের সুমতি’, ‘বিরাজ বৌ’, ‘চাঁপা ডাঙ্গার বউ’ , ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’, ‘শুভদা’ এর মতো গর্ব করা চলচ্চিত্রগুলোও। অথচ এসব ছবিতে সপরিবারের দর্শকদের ঢল দেখেছিলাম আমি সিলেটে। কিন্তু দিন শেষে ছবিগুলো ব্যর্থ হয়েছিল।

বাংলা চলচ্চিত্রের স্বনামধন্য প্রয়াত এক পরিচালকের খুব ঘনিষ্ঠজনের কাছ থেকে জেনেছিলাম যে ওই পরিচালকের একটি ছবি মুক্তির পর তিনি ‘বলাকা’ সিনেমা হলে ‘হাউসফুল’ লেখা দেখে ছবির শো শেষ হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিলেন কিন্তু হলের ভেতর থেকে কোন দর্শকদের বের হতে দেখেননি। পরে পরিচালকের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন যে ঢাকা শহরের বড় বড় সিনেমা হলগুলোর প্রথম সপ্তাহের টিকিট প্রযোজক কিনে ফেলেছিলেন যা ছিল প্রচারণার কৌশল। সত্যি সত্যি ওই ছবিটাই সারা দেশে বাজিমাত করেছিল শুধু মুক্তির প্রথম দিন থেকেই ঢাকা শহরের বিভিন্ন হলের এমন মিথ্যা ‘হাউসফুল’ খবরের শিরোনাম দেখে। অর্থাৎ ছবিকে ব্যবসায়িক সফলতা এনে দিতে ওই প্রযোজকের কেনা সব টিকিটের ‘হাউসফুল’ লেখাটি ছিল প্রযোজকের বিনিয়োগ। এমন প্রযোজক সেই সময় আরও পাওয়া যাবে সন্দেহ নেই। কারণ ৩০/৪০ লাখ টাকার একটি প্রোডাক্ট বাজারে সাড়া ফেলার জন্য আরও ১/২ লাখ টাকা খরচ করলে ক্ষতি তো নেই।

 মজার ব্যাপার হচ্ছে ভালো ভালো ছবিগুলো ঢাকায় মার খাওয়ার রেকর্ড যেমন আছে তেমনি অশ্লীল যুগের শুরুর দিকে অশ্লীল ছবির সফলতার রেকর্ডও ঢাকা শহরের আছে।

৯০  দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ‘মাস্টার মেকার’ খ্যাত  এ জে মিন্টু তৎকালীন বাজারের কোটি টাকা খরচ করে ‘বাপের টাকা’ নামে একটি দারুণ সুস্থ পরিচ্ছন্ন ছবি নির্মাণ করে অশ্লীল ছবির কাছে ঢাকায় শুরুতেই ধরা খেয়ে ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হয়ে রাগে, ক্ষোভে , অভিমানে চলচ্চিত্র নির্মাণ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। যত দূর মনে পড়ে মিন্টুর ‘বাপের টাকা’ ছবিটির সঙ্গে এনায়েত করিম ও ডিপজল গ্যাং এর ‘কদম আলী মাস্তান’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। বলাকা, মধুমিতা, জোনাকি সিনেমা হলে মিন্টুর ‘বাপের টাকা’ যখন গুটিকয়েক দর্শক দেখছিল তখন পুরান ঢাকা, মিরপুর, ফার্মগেটের সিনেমা হলগুলোতে ‘কদম আলী মাস্তান’ নামের খিস্তি খেঁউড় দেখতে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়।

প্রথম সপ্তাহেই ‘বাপের টাকা’র মতো আধুনিক, পরিচ্ছন্ন বিনোদনধর্মী ছবিটি লোকসানের মুখে পড়ে আর প্রযোজক পরিচালক এ জে মিন্টু ছবি নির্মাণ থেকে সরে গিয়ে নিজের পুরোনো গার্মেন্টস ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। অথচ ‘বাপের টাকা’ ছবিটিতে আমি নন্দিতা সিনেমা হলে দর্শকপূর্ণ পেয়েছিলাম। … এমন আরও অসংখ্য উদাহরণ দেখানো যাবে ঢাকার দর্শকদের বিমাতাসুলভ আচরণের যা লিখতে গেলে অনেক বড় পোস্ট হয়ে যাবে বলে সংক্ষেপে এতটুকু বললাম। এই ফেসবুকেই আমার সমবয়সী যারা বাংলা চলচ্চিত্রের পাগল দর্শক ছিলেন তাঁদের ৯৮% হলেন যারা সেদিন ছিলেন ঢাকা শহরের বাইরের সিনেমা দর্শক।       

আজ এত বছর পরেও ঢাকার সেই দর্শকদের আচরণ বদলায়নি। যারা মুখে ‘ভালো ছবি’ ‘ভালো ছবি’ বলে ফেনা তুলে ফেলেন অথচ সিনেপ্লেক্সে গিয়ে নিজের দেশের ছবি রেখে সব সময় হলিউডের ছবি দেখতে ভিড় করেন। ফেসবুকে আছে আরেক গোষ্ঠী যারা সিনেমা হলের বুকিং এর তালিকা দিয়ে কোন নায়ক/ নায়িকার ছবিকে বিরাট সুপারহিট বানিয়ে ফেলে অথচ দিন শেষে দেখা যায় সেই ছবি ব্যর্থ যায়। সর্বশেষ গত ৪ বছর আগে ঈদুল আযহায় ফেসবুকে দেখলাম ‘রাজাবাবু’ নামের  একটি চলচ্চিত্রের ১৬০টি সিনেমা হল বুকিং পাওয়া নিয়ে বিরাট মাতামাতি দেখেছিলাম।  যা দেখে আমি একটি লেখা লিখেছিলাম সিনেমা হলের বুকিং পেলেই ছবি সফল হয় না তা বোঝাতে। সত্যি সত্যি দেখা গেলো যে এক সপ্তাহ পর দেশসেরা একটি পত্রিকা সারা দেশের বিভিন্ন সিনেমা হল ঘুরে ঈদের ছবির যে রিপোর্ট দিয়েছিল সেখানের অধিকাংশ হলেই রাজাবাবু ছবিটির দর্শক শূন্যতার কথা প্রকাশ পায়। বছর শেষে রিপোর্টে জানলাম যে রেকর্ড সংখ্যক ১৬০টি সিনেমা হলে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রাজাবাবু’ ছবিটির শ খানেক হল মালিকই বিনিয়োগের টাকা তুলতে পারেনি । অর্থাৎ বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের অভাবে যেখানে সারা দেশের সিনেমা হলগুলো মারা যাচ্ছে সেখানে ঢাকার দর্শকদের জন্য চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি আত্মহত্যা করছে।

 আজও ঢাকার এক শ্রেণির দর্শক যারা ‘ভালো ছবি’ নামের কিছু টেলিফিল্মের প্রচারণা চালায় আবার আরেকটি পক্ষ মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র বলতে কোন এক নায়ক/ নায়িকার সিনেমাগুলোরই প্রচারণা করে ও বাংলা সিনেমার মহানায়ক/ নায়িকা বানিয়ে নির্লজ্জ তোষামোদি করে যা বাংলা ‘চলচ্চিত্রপ্রেমী’ হিসেবে এক ধরনের ব্যবসা ছাড়া কিছুই নয়।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

কবি ও কাব্য

আমি ফজলে এলাহী পাপ্পু, কবি ও কাব্য নামে লিখি। স্বর্ণযুগের বাংলাদেশী চলচ্চিত্র এবং বাংলা গানকে এ যুগের সকলের কাছে পৌছে দেয়ার আগ্রহে লিখি।

মন্তব্য করুন