ঢালিউড : আলোচনা-সমালোচনার ২০১৬
২০১৬। বাংলা চলচ্চিত্রের গত কয়েক বছরের সবচেয়ে আলোচিত বছর। বেশ কিছু কারণে বাংলা চলচ্চিত্র আলোচনায় এসেছে। সাথে এসেছে চলচ্চিত্রে কিছু পরিবর্তন। হলমুখী হচ্ছে দর্শক আর অনলাইনে আলোচনা-সমালোচনায় মুখর হচ্ছে।
আলোচিত চলচ্চিত্রঃ
এই বছরের সবচেয়ে আলোচিত চলচ্চিত্র ‘আয়নাবাজি’। দর্শক-সমালোচক সকলের প্রশংসা পেয়েছে ছবিটি। পাশাপাশি কোরিয়ান ‘টাম্বলউইড’ ছবির নকল বলেও অভিযোগ উঠে। তবে এতে শুধু অন্যের হয়ে জেল খাটার থিমটাই গৃহীত হয়েছে পুরো গল্প নয়। আবার বাংলাদেশের অন্যতম একজন পরিচালক কাজী হায়াৎ ছবিটির একটি উদ্ভট সিনেমা বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া প্রশংসিত হয়েছে রুবাইয়াৎ হোসেনের ‘আন্ডার কন্সট্রাকশন’ ও তৌকীর আহমেদের ‘অজ্ঞাতনামা’। ছবি দুটি বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ও পুরস্কৃত হলেও প্রচারণার অভাবে দর্শকদের নজর কাড়তে পারে নি। তবে বছরের শেষে এসে ‘অজ্ঞাতনামা’ ইউটিউবে মুক্তি পেলে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ে। দর্শকেরা তৌকীরের পরিচালনা ও ফজলুর রহমান বাবুর অভিনয়ের প্রশংসা করেন। দর্শকদের এই চলচ্চিত্রের জন্য হলমুখী করতে না পারায় ইমপ্রেস টেলিফিল্মের প্রচারণা পদ্ধতিকে দায়ী করছেন দর্শকেরা। বানিজ্যিক চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছবি ছিল ‘শিকারি’। শাকিব খানের নতুন লুকের জন্য দর্শকেরা আগ্রহী হয়ে উঠে বেশি। অন্যদিকে ছবির মাঝপথে পরিচালক পরিবর্তন করা ‘রক্ত’ ছবি নিয়ে আলোচনা হলেও বক্স অফিসে আশানুরূপ পারফরম্যান্স ছিল না।
নকল চলচ্চিত্রঃ
কাট-টু-কাট নকল হিসেবে বেশ কিছু ছবি মুক্তি পেয়েছে, যা আসলে কাম্য নয়। চিত্রনাট্যকারের চিত্রনাট্য পরিবর্তন করারও প্রয়োজন মনে করেনি কিছু ছবিতে। এবং তা অতি সাম্প্রতিক কিছু ছবির নিয়েই। যেসব অন্য ভার্সনগুলোর রেশ এখন যায় নি। এ বছরে মুক্তি প্রাপ্ত এ ধরনের ছবিগুলো হলঃ ‘অঙ্গার’ – কনড় ছবি ‘আপাইয়া’, ‘পুড়ে যায় মন’ – তেলুগু ছবি ‘গাঙ্গোত্রি’, ‘হিরো ৪২০’ – তেলেগু ছবি ‘মাস্কা’, ‘মন জানেনা মনের ঠিকানা’ – আদালত সিরিজের ৮৮তম পর্ব, ‘বাজে ছেলে দ্য লোফার’ – তামিল ছবি ‘মানমাধান’, ‘শিকারি’ – তামিল ছবি ‘আদাভান’ , ‘বাদশা দ্য ডন’ – তেলেগু ছবি ‘ডন সীনু’, ‘মাস্তানি’ – হিন্দি ছবি ‘চেতনাঃ দ্য এক্সাইটমেন্ট’, ‘প্রেম কি বুঝিনি’ – ‘১০০% লাভ’, ‘চোখের দেখা’ – হিন্দি ছবি ‘পারিন্দে’ ।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী নার্গিস আক্তার নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘রস’ গল্প অবলম্বনে নির্মাণ করেন ‘পৌষ মাসের পীরিত’। এই গল্পে ‘সউদাগর’ নামে একটি হিন্দি চলচ্চিত্র হলেও এখানে নার্গিস আক্তার ভিন্ন চিত্রনাট্যে ছবিটি নির্মাণ করেছেন। তাই একে নকল না বলে এটিকে গল্প থেকে অনুপ্রাণিত বলা ভালো। ‘আয়নাবাজি’র থিম কোরিয়ান ‘টাম্বলউইড’ মিল থাকলেও গল্প ছিল ভিন্ন। ‘অনেক দামে কেনা’ চার্লি চ্যাপলিনের ‘সিটি লাইট’ ছবি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত হয়েছে। ‘নিয়তি’ ছবির গল্প ‘দ্য নোটবুক’ উপন্যাস থেকে নেওয়া এবং একই নামে একটি মার্কিন চলচ্চিত্রও রয়েছে। ফলে একে পুরোপুরি নকল হিসেবে উল্লেখ করা যায় না। ‘মুখোশ মানুষ’ ছবির গল্প হিন্দি ‘আকসার’ ছবির সাথে মিল রয়েছে, তবে এতেও চিত্রনাট্যে ভিন্নতা রয়েছে।
২০১৬ সালের নকল সিনেমা নিয়ে পড়ুন হিমু সিনেমাখোরের পোস্ট: নকলের ধকল ২০১৬
বক্স অফিসঃ
প্রথমে বলে রাখা ভাল বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট কোন বক্স অফিস নেই। তাই কোন ছবির বাজেট কত এবং কত আয় করেছে তা সঠিকভাবে বলা যায় না। এক্ষেত্রে প্রায় সব প্রযোজকেরা বলেন তাদের লগ্নিতে লোকসান হচ্ছে (হয়ত এটা কর ফাঁকি দেওয়ার কোন ধান্দা)। যাই হোক, এই বছর কোন ছবির বেশি আয় করেছে এই বিতর্কে দর্শকদের রায়ে ‘আয়নাবাজি’ এগিয়ে থাকলেও জাজ মাল্টিমিডিয়া তাদের আয়ের তালিকায় উপরে রেখেছে ‘বাদশা দ্য ডন’ ছবিটিকে। তার পরে আছে শিকারি, আয়নাবাজি, বসগিরি, নিয়তি, রক্ত। যদিও ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাওয়া ‘শিকারি’ ও ‘বাদশা দ্য ডন’ ছবি দুইটির মধ্যে তখন ‘শিকারি’কে এগিয়ে রাখা হয়েছেল। কিন্তু বছর শেষে জাজ আদের আয়ের তালিকা প্রকাশ করলে দেখা যায় ‘বাদশা দ্য ডন’ সবার উপরে।
পোস্টারঃ
চলচ্চিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ পোস্টার। এ বছর এসেছে কিছু অসাধারণ পোস্টার। পাশাপাশি কিছু নকলকৃত পোস্টার। ভালো পোস্টারগুলোর মধ্যে আয়নাবাজির পোস্টার উল্লেখযোগ্য। ছবির গল্প ও চরিত্রের সাথে মিল রেখে একটি আয়নায় কেন্দ্রীয় চরিত্রের ছয়টি ভিন্ন চরিত্রকে তুলে ধরা হয়েছে এই পোস্টারে। দর্শকও পছন্দ করেছে এই বিষয়টা এবং তাদের ফেসবুকের প্রোফাইল ছবিও পরিবর্তন করেছে এই অ্যাপের মাধ্যমে। নকলের অভিযোগ গুরুতর ছিল ‘আইসক্রিম’ ও ‘মাস্তানি’ ছবির। উদয়-তুশি-রাজ অভিনীত ‘আইসক্রিম’ ছবির পোস্টারের সাথে ক্যারি গ্রান্ট-ক্যাথরিন হেপবার্ন-জেমস স্টুয়ার্ট অভিনীত ‘দ্য ফিলাডেলফিয়া স্টোরি’ ও সালমান খান-রানী মুখার্জি-আরবাজ খান অভিনীত ‘হ্যালো ব্রাদার’ ছবির পোস্টারের মিল পাওয়া যায়। এছাড়া ‘মাস্তানি’ ছবির পোস্টারে সানি লিয়নির মাথা কেটে মৌসুমী হামিদের মাথা বসিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠে।
যৌথ প্রযোজনাঃ
যৌথ প্রযোজনায় এবার এগিয়ে জাজ মাল্টিমিডিয়া। তাদের প্রযোজনায় এ বছর মুক্তি পেয়েছে ‘অঙ্গার’, ‘হিরো ৪২০’, ‘শিকারি’, ‘বাদশা দ্য ডন’, ‘নিয়তি’, ‘রক্ত’, ‘প্রেম কি বুঝিনি’ চলচ্চিত্রগুলো। ‘অঙ্গার’ ও ‘রক্ত’ পরিচালনা করেছেন ওয়াজেদ আলী সুমন, ‘হিরো ৪২০’ সৈকত নাসির ও সুজিত মন্ডল, শিকারি’ জয়দেব মুখার্জি ও জাকির হোসেন সীমান্ত, ‘বাদশা দ্য ডন’ বাবা যাদব, ‘নিয়তি’ জাকির হোসেন রাজু এবং ‘প্রেম কি বুঝিনি’ সুদীপ্ত সরকার। বাংলাদেশী পরিচালকেরা পরিচালনা করলেও বেশিরভাগ ক্রু ছিল ভারতীয়। এই প্রসঙ্গে তরুণ পরিচালক আশিকুর রহমান বলেন তিনি এই বিষয়ে আগ্রহী নন। কারণ দুই দেশের পরিচালক একসাথে কাজ করলে এতে স্বকীয়তা থাকে না। পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশের ও বাংলাদেশের ক্রুদের পূর্ণ অধিকার ও সম্মান নিশ্চিত করার কথা বলেন। আবার যৌথ প্রযোজনার ছবি দুই বাংলাতেই চলছে না বলে প্রতিবেদন করা হলেও বছর শেষে দেখা যায় সেরা পাঁচ আয় করা ছবির চারটিই যৌথ প্রযোজনার।
ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানিঃ
নীতিমালা অনুসরণ না করে আমদানি করা ‘কেলোর কীর্তি’ ছবিটি বাংলাদেশে প্রদর্শন নিয়ে বিতর্ক উঠে এবং তা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। হাই কোর্টে এক রিট আবেদনে জানানো হয়, “বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নীতিমালা অনুযায়ী, ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানি করতে হলে সমান সংখ্যক বাংলাদেশি সিনেমা রপ্তানি হতে হবে। বাংলাদেশ থেকে প্রথমে ছবি রপ্তানি করে তারপর আমদানি করতে হবে। বাংলাদেশের সিনেমা সেখানে প্রদর্শিত হয়েছে এমন সনদ পাওয়ার পরই ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানি ও প্রদর্শন করা যাবে। কিন্তু কেলোর কীর্তির ক্ষেত্রে ওই নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি।” এরপর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান আরাধনা এন্টারপ্রাইজ আবেদন করলে এবং নীতিমালা বিষয়ে একমত হলে ছবিটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেওয়া হয়।
যাই হোক, এই বছর প্রায় ৬০টি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে। সবগুলো সমানভাবে আলোচিত হয় নি। কিছু ছবি দর্শকদের হলমুখী করেছে এবং আলোচনায় এসেছে। কিছু ছবি আলোচনা ও দর্শকদের নজর কাড়ার আগেই প্রেক্ষাগৃহ ত্যাগ করেছে। আবার কিছু ইউটিউবে ঝড় তুলেছে। সব মিলিয়ে ২০১৬ ঢালিউডের জন্য পট পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর।