
তাণ্ডবের পাইরেসি সব মাত্রা অতিক্রম করেছে: দীপংকর দীপন
সিনেমার পাইরেসি এখন অতিসাধারণ বিষয়। বিশ্বের সব ইন্ডাস্ট্রির নির্মাতারা ধরেই নিয়েছেন পাইরেসির কারণে তাদের ‘মুনাফা’র কিছু অংশ খোয়াতে হবে। কিন্তু ঢালিউডে যেভাবে সিনেমার এইচডি প্রিন্ট ফাঁস হচ্ছে, তা একটি সিনেমার আয়কে পুরোপুরি ধসিয়ে দেয়ার ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। যেমন; রায়হান রাফী পরিচালিত ‘তাণ্ডব‘। এমন ঘটনা ধারাবাহিকতাভাবে চলতে থাকলে ক্ষয়িষ্ণু ঢালিউড একবারেই ধ্বংস হয়ে যাবে। এ ধরনের পাইরেসির গোড়া কোথায় হতে পারে তা বিস্তারিত লিখেছেন নির্মাতা দীপংকর দীপন।

ভিউ বাংলাদেশ নামের একটি সংবাদমাধ্যমে বরবাদ ও তাণ্ডবের পাইরেসির ধরন ও কারা এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে এ বিষয়গুলোও উল্লেখ করেছেন ‘ঢাকা অ্যাটাক’ নির্মাতা। তার লেখার শিরোনাম “‘তাণ্ডব’ পাইরেসি: ক্ষতিও সিনেমা শিল্পের মানুষের, দায়ও তাদের”। সেখান থেকে তার লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো—
এবার ঈদে রিলিজ হয়েছে সুপারস্টার শাকিব খানের সিনেমা ‘তাণ্ডব’। রায়হান রাফি পরিচালিত এই সিনেমায় আছেন আরও চমকপ্রদ স্টার-কাস্ট। রিলিজের পর যখন বক্স অফিসে খুব সাফল্য পাচ্ছিল- তখন দু সপ্তাহের মাথায় এই সিনেমার পাইরেটেড ভার্সন এইচডি কপি- প্রফেশনাল সাউন্ডসহ অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে। কী ভীষণ দুঃখজনক কথা। পাইরেসি সবসময়ই অপরাধ; কিন্তু তাণ্ডবের পাইরেসি সব মাত্রাকেই ছাড়িয়ে গেছে।
বর্তমানে পাইরেসি মূলত দুইভাবে হয়ে থাকে: সিনেমা হল থেকে ক্যামেরায় রেকর্ড করে অথবা ওটিটিতে রিলিজ হলে সেখান থেকে কপি করে। সিনেমা হলে রেকর্ড সাধারণত মোবাইলে করা হয়- যাকে পাইরেসির ভাষায় বলে হল প্রিন্ট বা ক্যাম প্রিন্ট। কখনো কখনো ভালো ক্যামেরায় আয়োজন করেও এই অবৈধ রেকর্ডিং করা হয়- যখন সিনেমা হলের স্টাফরা এর সঙ্গে যুক্ত থাকে। যে কারণে জাজ মাল্টিমিডিয়া সিঙ্গেল স্ত্রিনের প্রজেকশনে হলের নাম লিখে দিত, যেন কোন হল থেকে লিক হয়েছে সেটা জানা যায়। আরেকটা হচ্ছে- ওটিটি থেকে কপি করা। পাইরেসির ভাষায় বলে HD বা Blue-Ray প্রিন্ট- যা সাধারণত টরেন্টে বা FTP সার্ভারে আপলোড হয়। এছাড়া দু-একবার দেখা গেছে সেন্সর প্রিন্ট লেখা বা ফেসটিভাল প্রিন্ট লেখা কপিও লিক হতে- কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে।
তাণ্ডবের পাইরেসি এই প্রচলিত পদ্ধতির কোনোটিতেই ঘটেনি। বরং এটি এমন এক উপায়ে হয়েছে যা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে খুব কমই দেখা যায়। এখানে সরাসরি প্রদর্শনের কপিই লিক হয়েছে। বিষয়টি খুব সহজ কিছু নয়- বরং বেশ অবাক করার মতো, রীতিমতো শকিং। বিষয়টা বোঝার জন্য কিছু টেকনিক্যাল বিষয় জানতে হবে। তাণ্ডবের লিকড ভার্সনের কোয়ালিটি ও ফাইল ফরমেট না বুঝলে ঠিক বোঝা যাবে না- তাণ্ডবের লিকড হওয়া ভিডিও কেন পাইরেসি অপরাধের চূড়ান্ত সীমায় আছে।
কালার কারেকশন বা DI (Digital Intermediate) স্টুডিও সাধারণত DPX (Digital Picture Exchange) ফাইল নিয়ে কাজ করে- যা আসলে image format, video নয়, DPX ফাইলগুলো সাধারণত একেকটি ফ্রেমকে আলাদা ইমেজ হিসেবে সংরক্ষণ করে। সাধারণ কোনো পিসি বা সফটওয়্যারে এই ফাইল চলে না। এরপর DPX থেকে তৈরি হয় DCP (Digital Cinema Package) যা সিনেমা হলে প্রদর্শনের জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ফরম্যাট। এই ফরম্যাটও শুধুমাত্র প্রজেকশন সার্ভারেই চলে- সাধারণ কোনো কম্পিউটার বা প্লেয়ার সফটওয়্যারে নয়। সাধারণত মাল্টিপ্লেক্সের সার্ভার দিয়ে ডিসিপি ফরমেটের মুভি চালানো হয়। একই সঙ্গে, single screen হলের সার্ভারে চালানোর জন্য আলাদা ফরম্যাটে কপি তৈরি করা হয়- যেমন Jaaz Multimedia নিজস্ব সার্ভারের জন্য আলাদা ফাইল ফরম্যাট ব্যবহার করতো, যার ফলে তাদের ছবি সাধারণত কপি হতো না। এগুলো নিজস্ব সার্ভার ছাড়াও চালানো যায় না।
তাহলে আমরা ল্যাপটপ বা পিসিতে সিনেমার কোন কপি দেখি? সাধারণত আমরা দেখি .mkv বা .mp4 ফাইল- যা তৈরি হয় মূলত .mov ফাইল থেকে। এই ফাইল ফরমেট কিন্তু ডিস্ট্রিবিউশন চেইনের আউটপুটের মধ্যে আসারই কথা না। সাধারণত খুব দুর্বল সিনেমা হলে যারা সাধারণ কম্পিউটার বা ল্যাপটপ দিয়ে সিনেমা চালায়- তারা সিনেমার সবচেয়ে দুর্বল ও লো রেজুলেশনের কপি – .mp4 ভার্সন চায়- পেন ড্রাইভে- এদের প্রদর্শকের দেশি ভাষায় পেন-ড্রাইভ হল বলে। পেন-ড্রাইভ হলে সচেতন ডিস্ট্রিবিউটররা কখনোই প্রথম দিকে .mp4 ভার্সনে মুভি দিতে চায় না। সাধারণত টিভি ও ওটিটিতে আসার পর দেয়া হয়। ঢাকা অ্যাটাক- অপারেশন সুন্দরবন বা অন্তর্জাল – এসব সিনেমার পোস্ট প্রডাকশন আমি দেখেছি- ডিপিএক্স আমার কাছে ছিল- .mp4 বা .mov ফাইল তৈরিই করতে দেইনি কোনোদিন। এমনকি নিজেরা দেখার জন্যও না। তাতে কিছু হল কম পেয়েছি- তাও পেনড্রাইভে সিনেমা দেইনি। বিদেশি সিনেমা আমাদের দেশে যেটা আসে- তাদেরও এই শর্তই থাকে। DCP এর বাইরে তারা কিছুই দেয় না। কেউ কেউ তো DCPও দিতে চায় না- তারা চায় ক্লাউড সার্ভারের মাধ্যমে সিনেমা চলবে। অথচ তাণ্ডবের .mp4 লিক হলো। তাও ঠিকঠাক সাউন্ড ফাইলসহ। শাকিব খানের বরবাদ সিনেমাও একইভাবে পাইরেসি হয়েছিল- তবে তা এত দ্রুত নয় এবং এত ঠিকঠাক কপিও সেটা ছিল না। তাণ্ডবের পাইরেসি সব মাত্রা অতিক্রম করেছে।
তাণ্ডবের যে কপি লিক হয়েছে তা DCP থেকে .mov হয়ে সেখান থেকে .mp4 ফরম্যাটে তৈরি এবং তা প্রফেশনাল সফ্টওয়ার ব্যবহার করে করা হয়েছে। কমপ্রেশন কোয়ালিটি তাই বলে। Adobe Premiere Pro-তে যদি ১০ মিনিটের .mp4 ভিডিও হাইরেজুলুশনে এক্সপোর্ট করা হয় তাহলে ফাইল সাইজ প্রায় ৭-৮ জিবি হতে পারে। অথচ তাণ্ডবের ১২০ মিনিটের HD প্রিন্ট মাত্র ২.৬ জিবি; কিন্তু কোয়ালিটি একেবারে ঝকঝকে। এটি তখনই সম্ভব, যখন .mov ফাইল থেকে প্রফেশনাল কমপ্রেশন টুল দিয়ে দক্ষভাবে এক্সপোর্ট করা হয়। এর মানে এই লিকের সঙ্গে সরাসরি ইন্ডাস্ট্রির অভ্যন্তরের কেউ যুক্ত বা তাদের অবহেলার কারণেই এই কপি লিক হয়েছে। নয়তো এই ফাইল ফরমেটের কপি বাইরে আসার কথা না। এটা ভুলে গেলে চলবে না- শুধু শিল্পী-প্রযোজক আর পরিচালকরাই সিনেমা শিল্পের মানুষ নন- পরিবেশক ও প্রদর্শনের মানুষরাও সিনেমা শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সিনেমা হলে যে মানুষটি লাইট দিয়ে সিট দেখিয়ে দেয় বা কাউন্টারে টিকিট বিক্রি করে – সেও সিনেমা শিল্পের মানুষ। কারও না কারও মাধ্যমে বা ভুলে তো এই কপি লিক হয়েছে এবং যৌক্তিক অনুমান বলে তারা পরিবেশক বা প্রদর্শক চেইনের মানুষ।
যে তিনজনকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে- তাদের সঠিক ফোকাসে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই পুরো বিষয়টা বেরিয়ে আসবে। সঠিক ফোকাস কেন বলছি- কারণ, তাণ্ডবের লিক বিষয়ে আমাদের কমন ফোকাস হচ্ছে- কেন লিক করল? এভাবে লিক করলে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি কীভাবে এগুবে? কিন্তু ফোকাস করা দরকার – তারা এই কপি পেল কোথায়?- এই ফাইল কমপ্রেস (এক্সপোর্ট) করা হলো কেন? কে করল? তাণ্ডব পাইরেসির শেকড়ে যেতে হবে। কারণ এ এক জটিল বিষবৃক্ষ- কীটনাশক ছিটিয়ে এই বিষবৃক্ষ নিধন করা যাবে না। এই বিষবৃক্ষ মারতে হলে শেকড় তুলে ফেলতে হবে।
অন্যদিকে সিনেমার কোনো ভার্সন অবৈধভাবে লিক করা যেমন পাইরেসি করা- তেমনি পাইরেটেড কপি ছড়ানোও পাইরেসির মধ্যে পড়ে। তাই পাইরেটেড কপি তৈরি করা যেমন অপরাধ, সেটি ডাউনলোড করে আপলোড বা শেয়ার করাও সমান অপরাধ। যেসব YouTube চ্যানেলগুলোতে এই কপি আপলোড হয়েছিল – নামানো হয়েছে বা ইউটিউব কপিরাইট স্ট্রাইকের কারণে নেমে গেছে – তাদের সবারই তালিকা পাওয়া সম্ভব। সেই তালিকা থেকে IP Address ধরে সহজেই তাদের খুঁজে বের করা যায়- একইভাবে টেলিগ্রাম চ্যানেলের অ্যাডমিনদের খুঁজে বের করা- তারপর এদের শাস্তির আওতায় আনা দরকার। তাতে এই প্রবণতা কমবে যে – একটা পাইরেটেড কপি পেলাম, একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলে আপ করে দিলাম, আর Telegram-এ লিঙ্ক শেয়ার করে দিলাম। এই প্রক্রিয়া যত সহজ, প্রযোজকের ক্ষতি ঠিক ততটাই ভয়াবহ। একটা পাইরেটেড কপির ভিউ হয়তো হাজার বা লাখ হয়; কিন্তু একটি সিনেমার অর্থনৈতিক ক্ষতি, ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতি, নির্মাতার মনোবলের ক্ষতি- এসবের ক্ষতিপূরণ হয় না। তাণ্ডব একটি হলভিত্তিক সিনেমা যারা সত্যিকার অর্থে সিনেমা ভালোবাসেন, তারা অবশ্যই হলে গিয়েই দেখবেন; কিন্তু এই পাইরেসি তাণ্ডবের ব্যবসাকে থামিয়ে দিল অনেকখানি। যা যতটা হতাশার, ঠিক ততটাই ক্ষোভের।
তাণ্ডবের পাইরেসি আমাদের বিষাদগ্রস্ত করে। রিলিজের দুই সপ্তাহের মাথায় প্রপার অডিওসহ এইচডি লিক- এটি ভীষণ দুঃখজনক, হতাশাজনক ও ক্ষোভের। তাই এই কপি কীভাবে লিক হলো- কেন এই ফাইল ফরম্যাটে কমপ্রোমাইজ করা হলো, এই ফাইল ফরমেট কীভাবে এক্সপোর্ট হলো- এটা বের করে শেকড়ে হাত দিতে হবে। পাইরেসি ঠেকানো সহজ নয়- বড় বড় ওটিটি তা পারেনি; কিন্তু তাণ্ডব যেভাবে পাইরেসি হলো- তা ভীষণ ভীষণ শঙ্কার – তবে সঠিক ফোকাসে তদন্ত করলে শেকড়ে পৌঁছানো সম্ভব, এটা রোধ করা সম্ভব।
এসব করার দায় শুধু প্রযোজক শাহরিয়ার শাকিল বা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর না। সবচেয়ে বড় কথা তারা এই কাজটা একা করতেও পারবে না, যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের সহায়তা না করে- আইন বিভাগ এই বিষয়ে গুরুত্ব না দেয়। তাণ্ডবের পাইরেসির ক্ষতিপূরণ তো আর হবে না, তবে এই ক্ষতি থেকে শিক্ষাটা কাজে লাগিয়ে আরেকটা তাণ্ডব বা অন্য যে কোনো সিনেমাকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানোটা জরুরি। রাষ্ট্র এই বিষয়ে সচেতন না হলে বা গুরুত্ব না দিলে সেটা কোনোদিন হবে না। পাইরেসি নির্মূল সিনেমা শিল্প রক্ষার জন্য ভীষণ জরুরি। রাষ্ট্রের দায়িত্ব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয়তা, আইনের প্রয়োগ, সিনেমা শিল্পের মানুষদের সচেতনতা ও সততা এবং দর্শকদের সহমর্মিতা- এসব মিলেই তা সম্ভব।