দেখার মতো ছবি ‘মিশন এক্সট্রিম’
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশ বড় ক্যানভাসের সিনেমা ‘মিশন এক্সট্রিম’ এটা মানতেই হবে। এত বড় আয়োজনে এত শিল্পীদের নিয়ে এমন কাজ এর আগে হয়নি বললেই চলে। ছোট ছোট চরিত্রেও পরিচিত এবং দক্ষ শিল্পীদের অন্তর্ভুক্ত করাটা প্রশংসনীয়। তবে ভালো লাগার বিষয় হলো গল্পের সমসাময়িকতা। জঙ্গিবাদ ইস্যু এবং এই দলে সাধারণ কিশোর তরুণদের মগজ ধোলাই করে যেভাবে দিকভ্রান্ত করা হয় সেই সেনসেটিভ ব্যাপার ভালোভাবেই তুলে ধরা হয়েছে। আর সিনেমাটির মাধ্যমে পরিচালনায় অভিষেক হলো সানী সানোয়ার এবং ফয়সাল আহমেদের।
দুই কিস্তির এই সিনেমার গল্প স্পয়লার না দিয়ে যদি বর্ণনা করা হয় তাহলে বলতে হয়, দেশজুড়ে জঙ্গিদের ভয়ংকর নানা হামলার পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে তাদের আটক করার অভিযান নিয়েই ‘মিশন এক্সট্রিমের’ এই কিস্তির গল্প। এই অভিযানের দায়িত্বে আছেন আরিফিন শুভ, সাদিয়া নাবিলা ও সুমিত সেনগুপ্ত। অন্যদিকে তাসকিন রহমান, ইরেশ যাকের বা মাজনুন মিজান একটি জঙ্গি হামলাকারী দলের অংশ হলেও সুদীপ বিশ্বাস, মনোজ প্রামানিক, সৈয়দ নাজমুস সাকিব, আর এ রাহুলের মতো তরুণদের দ্বারা নানা হামলার প্ল্যান করেন।
দেশে ‘মুক্তচিন্তার’ দুজন ব্যক্তির নৃশংস খুন এবং কাছাকাছি সময়ে দুবাই থেকে বিশাল অংকের টাকা দেশে কে বা কারা এবং কোন উদ্দেশ্য থেকে আনিয়েছে সেই সুত্র ধরে এগোতে গিয়েই পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সামনে ধরা দেয় সন্ত্রাসী হামলার নীলনকশা। মোদ্দা কথায় ট্রেলার থেকেই গল্পটি আগ্রহ জাগায়। তবে গল্পের এক্সিকিউশন সেলুলয়েডে কেমন হলো সেটাই একটি সিনেমার ক্ষেত্রে আসল কথা। এক্ষেত্রে কিছুটা মিশ্র অনুভূতির মুখোমুখি হয়েছি।
কিছু কিছু দৃশ্য মানে যেগুলোতে থ্রিল বা সাসপেন্স একটু বেশি সময়ের জন্য ধরে রাখা যেতো সেগুলো কেন জানি তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো। আবার কয়েকটা অপারেশনে যে বিশাল পরিমাণ ব্লাস্ট দেখানো হলো সেই তুলনায় ক্ষয়ক্ষতি বা মৃত্যু দেখানো হয়নি। কিছু কিছু জায়গায় আর একটু ইমোশন বা ক্যারেক্টার বিল্ডআপের জন্য প্রয়োজনীয় সময় দেয়া হয়নি বলেই মনে হয়েছে। যেকোনো সিনেমার অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে গান। এই সিনেমায় শুভ-ঐশীকে নিয়ে দুবাইতে চিত্রায়িত গানটি শুনতে ভালো লাগলেও কোরিওগ্রাফি বা দৃশ্যায়ন তেমন ভালো লাগে নাই। আবার ‘পান্থপথের মোডে’ গানটি সিনেমায় রাখা হলে প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের কাছে সেটি আলাদা মাত্রা যোগ করতো নিঃসন্দেহে। কারণ এমন আয়োজনের গান সিনেমা হলের দর্শকদের জন্য স্বাভাবিকভাবেই বিনোদনে সহায়ক।
আবার এই মিশ্র অনুভূতির মধ্যে পজিটিভ অনেক দিকও আছে। যেমন; আরিফিন শুভকে পর্দায় দেখতে ভালো লেগেছে। ঐশী প্রথম সিনেমা হিসেবে ভালো কাজ করেছেন। সম্ভাবনাময় এই অভিনেত্রী সামনে আরো ভালো করবেন এটাই প্রত্যাশা। সাদিয়া নাবিলা তার চরিত্রে সাবলীল। তার চাহনি, ফিটনেস ও এক্সপ্রেশন দিয়ে ইরা চরিত্রে মানিয়ে গেছেন পুরোপুরি। তবে এই সিনেমার অন্যতম প্রাপ্তি সুমিত সেনগুপ্ত। পরিমিত অভিনয়, চরিত্রের সাথে জাস্টিস, ফিটনেস এবং ভয়েস সব মিলিয়ে তিনি ভালো কাজ করেছেন এই সিনেমায়। শতাব্দী ওয়াদুদ ছিলেন বরাবরের মতোই মানানসই। অন্যদের মাঝে সুদীপ বিশ্বাস দীপ একটি জঙ্গি দলে যোগ দেয়া নিয়ে কিছুটা দোটানায় থাকা তরুণ বা পরবর্তীতে তার ক্যারেকটারের একেবারেই অন্য রূপ দেখতে পাওয়া সব মিলিয়ে তিনিও নজর কেড়েছেন। স্বল্প সময়ে সৈয়দ নাজমুস সাকিবও নজর কেড়েছেন। রাশেদ মামুন অপু অল্প সময়ের চরিত্রে আলো ছড়িয়েছেন।
তাসকিন রহমানকে নিয়ে যে প্রত্যাশা ছিলো তা তিনি পূরণ করেছেন কিন্তু একজন ঠান্ডা মাথার প্ল্যানার হিসেবে আরো কিছু সংলাপ বা দৃশ্য হয়তো তা চরিত্রকে পরিপূর্ণ লতা এনে দিতে পারতো।
তবে হাসান ইমাম, রাইসুল ইসলাম আসাদ, শহীদুজ্জামান সেলিম, মনোজ প্রামানিক, মাজনুন মিজান বা ফজলুর রহমান বাবুকে কাজে লাগানো হলো না সেভাবে এটা একটা আক্ষেপ। কারণ এদের মধ্যে কয়েকটা চরিত্র সিনেমায় সেভাবে না রাখলেও ক্ষতি হতো না। এমন স্টারকাস্ট ভবিষ্যতে আর পাওয়া যাবে কিনা সেটা একটা প্রশ্ন!
‘মিশন এক্সট্রিম’-এর সিনেমাটোগ্রাফি ভালো, কিছু কিছু দৃশ্য চোখে লেগে থাকার মতো। তবে ভিএফএক্স আরো ভালো আশা করেছিলাম। গল্প আর একটু শক্ত করে বুনলে হয়তো কাজটা পরিপূর্ণতা পেতো। কিছু কিছু সংলাপ তো দারুণ।
সবমিলিয়ে এই সময়ের নিরিখে ‘মিশন এক্সট্রিম’ অবশ্যই দেখার মতোই একটি সিনেমা। নিজেদের দেশের বিগ বাজেটের এই সিনেমা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহী আমরা সবাই। কারণ ইন্ডাস্ট্রি ঘুরে দাঁড়ানো বা দর্শকদের হলে ফেরানোর সুযোগ যে কয়টি সিনেমার মাধ্যমে ঘটবে বলে আশা করা যায় তার মধ্যে একটি হলো ‘মিশন এক্সট্রিম’। তাই যারা বাংলাদেশের সিনেমার সুদিনের অপেক্ষায় তারা হলে যেয়েই সিনেমা দেখুন। ভালো লাগলে সেটাও বলুন, মন্দ লাগলে সেটাও বলুন তবে সেটা অবশ্যই সিনেমা দেখার পর।