Select Page

দেশি ছবির টেস্টে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ ও জাজের ভুল তত্ত্ব

দেশি ছবির টেস্টে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ ও জাজের ভুল তত্ত্ব

ভালো ছবি সবসময় ভালো। দর্শকের আর্তনাদ বলি বা প্রত্যাশা বলি ভালো ছবির জন্যই থাকে। ভালো ছবির আকার পাল্টে গিয়ে সেকাল-একাল পার্থক্য করে দিয়েছে। কেউ নিজেদের মতো করে ভালো ছবির ব্যাখ্যা দিচ্ছে আর কেউ অভিজ্ঞতা থেকে বলছে ভালো ছবি কাকে বলে। যারা জানে তাদেরকে আলাদাভাবে বোঝানোর কিছু নেই।

৩৫ মিলিমিটারের সময়টাতে লাল ক্যামেরাতে স্যুট করা যে ছবিগুলো আশির দশক থেকে নব্বই দশক পুরোটাই অনেক ব্যবসাসফলতা উপহার দিয়েছে সেগুলোর মধ্যে অসংখ্য ভালো ছবি আছে। যে তারকাদের আমরা প্রশংসা করি তাদের যেমন ভালো ছবি আছে কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে নিন্দা কুড়াই তাদেরও ভালো ছবি আছে। ছবির মূল চাহিদা দর্শক গ্রহণ করছে কিনা তার উপর নির্ভর করে।

ডিজিটাল সময়ে এসে দেশি ছবির জগতে ভালো ছবির সংজ্ঞাকে পাল্টে দেয়ার চেষ্টা করে যে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটি তার নাম জাজ মাল্টিমিডিয়া। তাদের প্রথমদিকের ছবিগুলো দেশি ছবির টেস্ট বজায় রেখেই করা হয়েছিল। যেমন- অগ্নি, দেশা দ্য লিডার, দবির সাহেবের সংসার, ভালোবাসা আজকাল, পোড়ামন, নিয়তি। তাদের অবস্থান যখন দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া শুরু করে তখনই তারা তাদের ধরণ পাল্টে ফেলে। তাদের বিশ্বাস চলে যায় তথাকথিত যৌথ প্রযোজনার দিকে। ‘যৌথ প্রযোজনা ছাড়া ছবিই বানাব না’ এ ধরনের ঘোষণা পর্যন্ত দেয়া হয়েছিল। যৌথ ছবি হতে হতে এর মাঝখানের ফাঁকিগুলো যখন চাউর হয় ধীরে ধীরে জনমত তৈরি হতে থাকে। ফিল্মের ভেতরের মানুষ থেকে শুরু করে দর্শক পর্যন্ত গড়িয়ে সেটা একসময় বড় আকার ধারণ করে। ফিফটি ফিফটি সমতায় যৌথ প্রযোজনা না হলে এ ধরনের ছবি এখানকার দর্শক মানবে না এই দাবি শক্ত হয়ে ওঠে। কেউ কেউ জাজকে সমর্থন করে বলে প্রথম প্রথম ফিফটি ফিফটি হবে না পরে হয়তো হবে। এগুলো ছিল জাজকেন্দ্রিক পোষ্য মানসিকতার জনমত। আন্দোলন তীব্র হলে বর্তমান অবস্থা পর্যন্ত আসে। জাজ এখন দেশি প্রোডাকশনে ছবি বানাচ্ছে বিদেশি পরিচালক দিয়ে যেখানে থাকছে বিদেশি শিল্পীদের দিয়ে গান গাওয়ানোর প্রবণতা। এভাবে বিদেশঘেঁষা নীতি তাদের তাদের থাকছেই। বিদেশ ছাড়া দেশি ছবির দর্শক আকর্ষণ সম্ভব না এটা তাদের আইডিওলজি। এ আইডিওলজি যে ঠিক না তারা দেরিতে হলেও বুঝবে এবং বোঝার প্রক্রিয়াটি ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।

জাজ মাল্টিমিডিয়ার নিন্দা করছি কি!
না, এটা সমালোচনা। জাজের প্রশংসা করব না তা কিন্তু নয়। অবশ্যই বলব তাদের মাধ্যমে ডিজিটাল ছবির ধারণা ঢালিউডে দর্শকের কাছে ভালোমতো পৌঁছে গেছে। যৌথ প্রযোজনা নেহায়েৎ খারাপ সিদ্ধান্ত ছিল তাও নয়। নিয়মমতো যৌথ ছবি করলে তাদের নিয়ে কেউ টু শব্দটিও করত না এটা পরিষ্কার।

নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘ঢাকা অ্যাটাক’ দেশি ছবির টেস্টে দর্শক জাগরণ ঘটানো ছবি। সম্পূর্ণ দেশি ছবির টেস্টে জাজ মাল্টিমিডিয়া আজ পর্যন্ত পারেনি এরকম ছবি উপহার দিতে। বিশেষ তারকা বা শুভানুধ্যায়ীদের ভক্তরা খোঁড়া যুক্তি দেখালেও দেখাতে পারে যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত বিভিন্ন ছবির কথা কিন্তু সেগুলো শতভাগ দেশি ফ্লেভার দেয় কিনা ভেবে দেখার অনেক বিষয় আছে। খেয়াল করে দেখলে গানের মধ্যে বাংলা+হিন্দি মিশ্রণ ধরা পড়বে, সংলাপে দুই রকম ভাষারীতির প্রভাব চোখে পড়বে, লোকেশনে ফিফটি ফিফটি পার্সেন্টেজ থাকবে না। তাহলে শতভাগ দেশি হয় কিভাবে? ‘ঢাকা অ্যাটাক‘ এগুলো থেকে মুক্ত শতভাগ দেশি ছবি। মোরাল এটাই, ‘ঢাকা অ্যাটাক’ জাজের যৌথ ছবি ছাড়া ইন্ডাস্ট্রি চলবে না বা তারা বানাবে না এ জাতীয় আইডিওলজি টোটালি ভুল।

ইন্টারন্যাশনাল ম্যানপাওয়ার বিজনেস যে ধরনের আধিপত্যের ধারণা দেয় তার মধ্যে লিটারেচার কনটেক্সট থেকে যদি বলি তবে আন্তোনিও গ্রামসি-র ‘economical hegemony’-কে আমলে আনতে হয়। অর্থনৈতিক আধিপত্যের শক্তিই রাজনৈতিক আধিপত্যের মেরুদণ্ড। জাজ মাল্টিমিডিয়ার কাছে দর্শক যা আশা করে সেসব ঘটে আবার যা আশা করে না সেসবও ঘটে। একটা ভালো ছবির সিনেমাহল বণ্টন ভালো হোক এটা দর্শক চায়। সে বণ্টনটি বর্তমানে করে জাজ। তাদের মাধ্যমে সিনেমাহলে যন্ত্রও বসানো হয়। যে ছবিগুলো তাদের এখতিয়ারে নেই সেগুলোকে দুরবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। যেগুলো তাদেরকে কনভিন্স করে বণ্টন হয় সেগুলো ভালো হল পায়। জাজের ঘরের ছবি একশোর বেশি হল পেয়ে লগ্নিকৃত টাকা উঠিয়ে নেয়। বাকিগুলো বেশিরভাগই মুখ থুবড়ে পড়ে। তার মানে জাজই চাবিকাঠি। ব্যবসা করতে চাও তো জাজের মাধ্যমে করো। ‘আয়নাবাজি’-র হল বণ্টনও জাজের মাধ্যমে হয়েছে। সাফল্যে জাজের অবদান আছে এটা অপ্রিয় সত্য। তাদের আধিপত্যের সাথে তাল মিলিয়েই টিকে থাকতে হচ্ছে। তারা যাদেরকে মিডিয়া কাভারেজ দিয়ে ছবির তারকা বানাচ্ছে তাদেরকে হাইলাইট করা হচ্ছে প্রতিভা থাক বা না থাক। এগুলো জাজের ম্যানপাওয়ার বিজনেস পলিসি। ক্ষমতার চর্চায় যদি ইন্ডাস্ট্রির উন্নতি হয় তবে ভালো। কিন্তু সেটা যথাযথভাবে হচ্ছে না। তার উপরে সাফটা চুক্তির অসম হিশ্ব তো আছেই। সেজন্য লাইভে গিয়ে উপস্থাপিকার কাছে থতমত করতে হয় জাজ কর্ণধারকে। কেন! ফাঁকিটা না রাখলে কি চলত না! জাজ যত উপকারই করুক তাদের ফাঁকিগুলোকে দর্শক মানবে না সেটা তো এতদিনেও প্রমাণিত। দেশি প্রোডাকশন দেশে কম ছিল না যারা রাজত্ব করেছিল নব্বই দশকে। মান্না-ও এমন নায়ক ছিল যার মাধ্যমে অনেক প্রযোজক কোটিপতি হয়েছে। তারা কি যৌথ ছবি বা আধিপত্যের চর্চায় ম্যানপাওয়ার নিয়ে মেতেছিল! তখন তো আরো ব্যস্ত নায়ক ছিল। শাকিল খান পর্যন্ত হিট ছবি উপহার দিয়েছিল। ভালো ছবির জন্য ম্যানপাওয়ার নয় নিজেদের ট্যালেন্টকে কাজে লাগিয়ে খরচ করাই মূলকথা।

‘ঢাকা অ্যাটাক’ ছবিটি জাজ মাল্টিমিডিয়াকে শিখিয়ে দিয়েছে ভালো ছবির জন্য দেশি টেস্ট জরুরি বাইরের মিশ্র সংস্কৃতির ছবি ততটা জরুরি নয়। জাজের কাছে ভালো ছবির প্রত্যাশা দর্শক করে এবং সেটার জন্য ‘নূরজাহান’ জাতীয় প্রজেক্টের প্রয়োজন নেই, ‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর মতো প্রজেক্ট জরুরি। যাতে দর্শক সিনেমাহল ও সোশ্যাল মিডিয়াতে বলতে পারে তারা দেশি ছবি দেখে আনন্দিত হয়েছে।

দেশি ছবি ঘরে ফিরুক…


Leave a reply