দোস্ত দুশমন, শোলে আর সত্যজিৎ
এক সাবেক পুলিশ অফিসার দুই পেশাদার অপরাধীকে নিজ গ্রামে ভাড়া করে এনেছে। কারণ গফফার ডাকাতের যন্ত্রণায় তারা সবাই অতিষ্ঠ। এই গল্প নিয়ে ১৯৭৭ সালে মুক্তি পায় বাংলাদেশী সিনেমা দোস্ত দুশমন। এটি মূলত হিন্দি শোলে মুভির আদলে তৈরী করা। পরিচালক শুরুতে সেটা স্বীকারও করেছেন। শোলে মুভিতে সেভেন সামুরাই ও ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন দ্য ওয়েস্ট (সহ আরো অনেক) মুভির প্রভাব রয়েছে। তবে এসব হিসেবে না যাওয়াই ভালো। কারণ ওয়ান্স আপনের পরিচালক সের্জিও লিওনি তার ফিস্টফুল অফ ডলারস বানিয়েছিলেন কুরাসাওয়ার Yojimbo দেখে। কুরাসাওয়া আবার Yojimbo-এর ইন্সপাইরেশন নিয়েছিলেন ড্যাশেল হ্যামেটের উপন্যাস থেকে। আর ড্যাশেল হ্যামেট অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন…কোথাও থেকে না। হ্যামেট ওয়াজ অ্যান এফিং জিনিয়াস!
দোস্ত দুশমন ছবিটির পরিচালক দেওয়ান নজরুল আর সিনেমার গানে সুর দিয়েছেন আলম খান। বাংলাদেশের ফিল্মে অনেক সম্মানিত সঙ্গীত পরিচালক আছেন। কিন্তু আলম খানকে আমার সবচে পছন্দ। তার সুরে একটা টাইমলেস ফ্রেশনেস পাওয়া যায়। যেমন, এই সিনেমায় খুব বিখ্যাত একটা গান আছে: “চুমকি চলেছে একা পথে”। আজ ৪২ বছর পরেও এই গানটি আগের লয়ে গাইতে পারবেন, অথচ রিদমটাকে পুরনো লাগবে না।
এই মুভিতে অভিনয় করেছেন সোহেল রানা (অমিতাভের চরিত্রটাতে), ওয়াসিম (ধর্মেন্দ্রর চরিত্রটাতে), আজিম (সঞ্জীবের চরিত্রতে), শাবানা (হেমা মালিনীর চরিত্রটাতে), সুচরিতা (জয়া বচ্চনের চরিত্রতে) আর জসিম করেছেন আমজাদ খানের আইকনিক গাব্বার সিং-এর ক্যারেক্টার। এই সিনেমার বেশিরভাগ সংলাপ শোলে মুভির বঙ্গানুবাদ। সেগুলো ভালো মানিয়ে গেছে। শুধু ক্লাইম্যাক্সে ওয়াসিম যখন বলে ওঠেন, “প্রত্যেককে বেছে বেছে মারবো”, তখন বেশ হাসি পায়। এই মুভির শেষে একটা মজার ব্যাপার আছে। শোলের সাথে এই ছবিটার সমাপ্তি মিলে না। এখন শোলের যে সমাপ্তিটা আমরা দেখি, এটা অরিজিনাল এন্ডিং। যা নব্বই দশকে ভিডিও ক্যাসেটে প্রথম মুক্তি পায়। কিন্তু ‘৭৫ সালে ছবিটায় অন্য গল্প দেখা যায়। সেন্সর বোর্ডের আপত্তিতে পরিচালক রমেশ সিপ্পি রিশ্যুট করতে বাধ্য হন। যেখানে ঠাকুর গাব্বার সিংকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। যেহেতু দোস্ত দুশমন শোলের দুই বছর পরে মুক্তি পেয়েছে, এখানে আমরা শোলের থিয়েট্রিক্যাল এন্ডিংটার প্রতিবিম্ব দেখতে পাই।
হিন্দি শোলে মুভিটা আমার কাছে এন্টারটেইনিং লেগেছিলো। এটা ভারতীয় মুভির অনেক কনভেনশন আর ট্রোপস ভেঙেছে। কিন্তু কেন এটাকে ভারতের (অন্যতম) শ্রেষ্ঠ সিনেমা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তা আমি কখনোই ধরতে পারিনি। সত্তরের দশকের মুভির কথা বলে বলে বলিউডের হর্তা-কর্তারা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। যেন এর আগে মাদার ইন্ডিয়া, মুঘল-এ-আজম বাদে ভালো সিনেমাই হয়নি (রাজ কাপুরের মুভির নামগুলো শুনতে পান, কারণ তার বংশধরেরা এখনো কাজ করছে)। একটা দো বিঘা জামিন, পিয়াসা কিংবা কাগাজ কে ফুলের নাম কখনোই তাদের মুখে আসে না। শিল্পীত অতীত ইতিহাস, তা সে যত ভালোই হোক না কেন, সকলে ভুলে বসে আছে। এর একটা কারণ হতে পারে, বলিউডের আজকের সুপার সাকসেসফুল কমার্শিয়াল সিনেমার যে ফর্মুলা, সেটা ৭০-এর দশকে সেলিম-জাভেদ প্রবর্তন করেছিলেন। এখনো তারা সেই ফর্মুলা নিয়েই আছে। বহির্বিশ্বে বলিউডি নাচ-গানের মুভিই “ইন্ডিয়ান ফিল্ম” হিসেবে পরিচিত। বলিউড এলিটরা তাদের মাসালা ফিল্মকে ইন্ডিয়ান ফিল্মের সমার্থক বানিয়ে ফেলতে তৎপর। এজন্য যখনি কোথাও সেরা ভারতীয় সিনেমা হিসেবে পথের পাঁচালী’র নাম আসে, তারা “শোলে, শোলে” বলে শোরগোল তোলে। কারণ বলিউড তার এত বড় ইন্ডাস্ট্রী, বিপুল অর্থ-বিত্ত আর নামজাদা সব সুপারস্টার নিয়েও এক বাঙালী পরিচালকের বানানো রিজিওনাল ফিল্মের কাছে হেরে যাবে, এটা মেনেই নিতে পারে না।