নকলের ধকল ২০১৭
অনেকেই সিনেমার ক্ষেত্রে ‘নকল’ শব্দটার পরিবর্তে ‘রিমেক’ শব্দটা ব্যবহার করতে বলেন। কারণ নকল বললে নাকি ‘চুরি’র মতো শোনায়। যাই হোক অন্যের কাজ অনুকরণ করার নামই নকল, আর সেটা বৈধভাবে করলে হয় রিমেক, অনুমতি ছাড়া করলে চুরি।
২০১৬ সালে বাংলাদেশে মুক্তিপ্রাপ্ত মোট সিনেমার তিন ভাগের এক ভাগই ছিল নকল। সে হিসেবে ২০১৭ সালে নকলের ধকল কিছুটা কম ছিল। ২০১৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার পাঁচ ভাগের এক ভাগ মাত্র নকল ছিল! কথা না বাড়িয়ে আসুন জেনে নিই সেই সিনেমাগুলো সম্পর্কে…
১. মাস্তান ও পুলিশ : ৬ জানুয়ারি বছরের প্রথম সিনেমা হিসেবে মুক্তি পায় রকিবুল আলম রকিব পরিচালিত ক্রাইম অ্যাকশন মুভি ‘মাস্তান ও পুলিশ’। দুই বন্ধুর আদর্শগত দ্বন্দ্বের গল্প নিয়ে নির্মিত এই সিনেমাটি কাজী হায়াৎ পরিচালিত ১৯৯১ সালের মাস্টারপিস সিনেমা ‘সিপাহী’র রিমেক। যেখানে কাজী মারুফ ইলিয়াস কাঞ্চনের, বিন্দিয়া চম্পার ও রকিবুল আলম রকিব নিজে প্রয়াত মান্না’র করা চরিত্রে অভিনয় করেন।
সিনেমাটি মুখ থুবড়ে পড়ে। মূল সিনেমাটির প্রথমাংশ মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে হওয়ায় রিমেক সিনেমাটির প্রথমাংশ যুগের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে নির্লজ্জভাবে এ জে রানার ‘ডন’ (১৯৯৪) এর প্রথমাংশের হুবহু নকল করা হয়। আহারে মেধা, আহারে নকল।
২. মায়াবিনী : ৩ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায় আকাশ আচার্য্য পরিচালিত কমেডি-হরর মুভি ‘মায়াবিনী’। এক ভীতু যুবকের মাধ্যমে এক অতৃপ্ত আত্মার প্রতিশোধ গ্রহণের গল্প নিয়ে নির্মিত সিনেমাটি রাঘব লরেন্স রচিত, প্রযোজিত, পরিচালিত ও অভিনীত ২০১১ সালের ব্লকবাস্টার তামিল সিনেমা Muni 2: Kanchana এর নকল। যেখানে সাইমন সাদিক রাঘব লরেন্সের, আইরিন সুলতানা লক্ষ্মী রাইয়ের ও অমিত হাসান রামানাথান শরতকুমারের করা চরিত্রে অভিনয় করেন।
ছবিটি মোটামুটি আলোচিত-সমালোচিত হলেও ব্যবসাসফল হতে অসফল হয়।
৩. প্রেমী ও প্রেমী : ১০ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায় জাকির হোসেন রাজু পরিচালিত রোড রোমান্টিক-কমেডি মুভি ‘প্রেমী ও প্রেমী’। নিজের মনের মানুষকে বাগদত্তর কাছে পৌঁছে দিতে যাওয়া এক যুবকের গল্প নিয়ে নির্মিত সিনেমাটি আনন্দ টাকার পরিচালিত ২০১০ এর আমেরিকান মুভি Leap Year-এর বাংলা সংস্করণ। যেখানে আরিফিন শুভ ম্যাথু গুডি ও নুসরাত ফারিয়া এমি এডামসের করা চরিত্রে অভিনয় করেন।
সিনেমাটি আশানুরূপ সফলতা অর্জনে ব্যর্থ হয়।
৪. ধ্যাততেরিকি : পহেলা বৈশাখে (১৪ এপ্রিল) মুক্তি পায় শামীম আহমেদ রনি পরিচালিত কমেডি অব এরর মুভি ‘ধ্যাততেরিকি’। স্বামী-স্ত্রীর পরিচয় নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি ও পারিবারিক গুপ্তধন উদ্ধারের গল্প নিয়ে নির্মিত এই সিনেমাটি স্মিপ ক্যাং পরিচালিত ২০১২ সালের পাঞ্জাবী মুভি Carry On Jatta এর অনুকরণে নির্মিত। যেখানে আরিফিন শুভ গিপ্পি গ্রেওয়ালের ও নুসরাত ফারিয়া মাহি গিলের করা চরিত্রে অভিনয় করেন।
ছবিটি মোটামুটি সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়।
৫. নবাব : পবিত্র ঈদুল ফিতরে (২৬ জুন) মুক্তি পায় জয়দীপ মুখার্জী ও আব্দুল আজিজ পরিচালিত যৌথ প্রযোজনার অ্যাকশন থ্রিলার ‘নবাব’। সন্ত্রাস দমনে একজন ইন্টেলিজেন্স এজেন্টের অভিযানের গল্প নিয়ে নির্মিত এই সিনেমাটির দুই-তৃতীয়াংশ আশুতোষ গোওয়ারিকার পরিচালিত Baazi (1995) ও অবশিষ্টাংশ আব্বাস-মাস্তান পরিচালিত Baadshah (1999) এর অনুকরণে নির্মিত। যেখানে শাকিব খান যথাক্রমে আমির খান ও শাহরুখ খানের এবং শুভশ্রী যথাক্রমে মমতা কুলকার্নি ও টুইংকেল খান্নার করা চরিত্রে অভিনয় করেন।
সিনেমাটি ২০১৭ সালের সেরা ব্যবসাসফল সিনেমার খেতাব অর্জন করে।
৬. মধু হই হই বিষ খাওয়াইলা : ২৮ জুলাই মুক্তি পায় জসিম উদ্দিন জাকির পরিচালিত রোমান্টিক-অ্যাকশন মুভি ‘মধু হই হই বিষ খাওয়াইলা’। এক তরুণ পুলিশ অফিসারের প্রেম ও প্রতিশোধের গল্পে নির্মিত এই সিনেমায় একাধিক সুপারহিট দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার গল্প খুঁচিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি নেওয়া হয়েছে গুণাশেখর পরিচালিত ব্লকবাস্টার তেলুগু সিনেমা Okkadu (2003) থেকে। যেখানে জেফ মহেশ বাবু’র, রোদেলা তিথী ভূমিকা চাওলা’র ও সাইফ খান প্রকাশ রাজের করা চরিত্রে অভিনয় করেন।
উল্লেখ্য, এই Okkadu সিনেমাটি এর আগে ভারতে ৪ বার এবং বাংলাদেশে ৩ বার {দাপট (২০০৬), বলো না কবুল (২০০৯), ভালোবাসতে মন লাগে (২০১৫)} রিমেক হয়েছে। মধু হই হই সিনেমার ফলাফল বিষ খাওয়ানোর মত হয়েছিল।
৭. রংবাজ : পবিত্র ঈদুল আযহার দিন (২ সেপ্টেম্বর) মুক্তি পায় শামীম আহমেদ রনি/আব্দুল মান্নান পরিচালিত কমেডি-অ্যাকশন মুভি ‘রংবাজ’। বাবার খুনের প্রতিশোধ নিতে এক যুবকের রংবাজ হয়ে উঠার গল্প নিয়ে নির্মিত এই সিনেমাটির দুই-তৃতীয়াংশ ডেভিড ধাওয়ান পরিচালিত ২০০২ এর হিন্দি সিনেমা Hum Kisise Kum Nahin এর আদলে নির্মিত। যেখানে শাকিব খান সঞ্জয় দত্তের, বুবলি ঐশ্বরিয়া রায় বচ্চনের ও কাজী হায়াৎ অমিতাভ বচ্চনের করা চরিত্রে অভিনয় করেন।
‘রংবাজ’ দর্শক ও সমালোচকদের দ্বারা কঠিন সমালোচনার শিকার হয়।
৮. অহংকার : পবিত্র ঈদুল আযহার দিনই (২ সেপ্টেম্বর) মুক্তি পায় শাহাদাৎ হোসেন লিটন পরিচালিত সোশ্যাল ড্রামা মুভি ‘অহংকার’। এক অটোচালক কর্তৃক এক ধনীর দুলালীর মিথ্যে অহংকার ভাঙার গল্প নিয়ে নির্মিত এই সিনেমাটি হুবহু প্রয়াত রাজেন্দ্র বাবু পরিচালিত ২০০৫ এর কানাড়া মুভি Auto Shankar এর নকল। যেখানে শাকিব খান উপেন্দ্রর ও বুবলি শিল্পা শেটির করা চরিত্রে অভিনয় করেন।
ছবিটি আশানুরূপ সফলতা লাভে ব্যর্থ হয়।
৯. চল পালাই : ৭ ডিসেম্বর মুক্তি পায় দেবাশীষ বিশ্বাস পরিচালিত রোড থ্রিলার মুভি ‘চল পালাই’। এক প্রেমীযুগলের যাত্রাপথে এক পাগলাটে আগন্তুকের বাধা হয়ে দাঁড়ানোর গল্প নিয়ে নির্মিত এই সিনেমাটি রজত মুখার্জী পরিচালিত ২০০২ এর হিন্দি সিনেমা Road এর হুবহু নকল। যেখানে শিপন মিত্র বিবেক ওবেরয়ের, তমা মির্জা অন্তরা মালির ও শাহরিয়াজ মনোজ বাজপেয়ীর করা চরিত্রে অভিনয় করেন।
ছবিটি এতটাই বাজেভাবে ফ্লপ হয় যে এটা ‘সবচেয়ে বাজে নকল সিনেমা’ ক্যাটাগরিতে গোল্ডেন বাঁশ এ্যাওয়ার্ডস-২০১৭ অর্জন করে এবং প্রযোজক সাহেব পরিচালককে উত্তম মধ্যম প্রদান করেন।
১০. অন্তর জ্বালা : ১৫ ডিসেম্বর মুক্তি পায় মালেক আফসারী পরিচালিত সোশ্যাল-ট্র্যাজেডি মুভি ‘অন্তর জ্বালা’। এক যুবকের পরিবার ও ভালোবাসার মানুষ হারানোর করুণ কাহিনী নিয়ে নির্মিত এই সিনেমাটি বসন্তবালান পরিচালিত ২০০৬ এর তামিল মুভি Veyil এর হুবহু নকল। যেখানে জায়েদ খান পশুপতির, পরী মনি প্রিয়াংকা নায়েরের ও জয় চৌধুরী ভরতের করা চরিত্রে অভিনয় করেন।
সিনেমাটি ব্যাপক আলোচিত হলেও আশানুরূপ সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি।
১১. ইনোসেন্ট লাভ : ২২ ডিসেম্বর মুক্তি পায় অপূর্ব রানা পরিচালিত রোমান্টিক ড্রামা ‘ইনোসেন্ট লাভ’। দুই বিরোধপূর্ণ পরিবারের প্রেমীযুগলের প্রেমের টানাপড়েনের গল্প নিয়ে নির্মিত এই সিনেমাটি নির্দিষ্ট কোন সিনেমার নকল না হলেও একাধিক ভারতীয় সিনেমা থেকে খুবলে নেওয়া। যার সবচেয়ে বেশি মিল আছে সম্পৎ নন্দি পরিচালিত ২০১২ এর তেলুগু সিনেমা Racha এর সাথে। যেখানে জেফ রাম চরণের ও পরী মনি তামান্না ভাটিয়ার করা চরিত্রে অভিনয় করেন।
ছবিটি তেমন একটা সাড়া ফেলতে পারেনি।
সবশেষে বলা যায় ২০১৭ সালেও নকল বা রিমেক সিনেমার ফলাফল তেমন একটা ভালো ছিল না। যদিও ‘নবাব’ সিনেমাটি ব্যাপক সফলতা পেয়েছে, তবুও দর্শকরা যে দিন দিন রিমেক বা নকল সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সেটা স্পষ্ট। এই বিশ্বায়নের যুগে সিনেমা রিমেক করা দোষের কিছু না। তবে নির্মাতা ও কলাকুশলীদের এক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখতে হবে তারা যেন অন্ধ অনুকরণ না করে নিজেদের সংস্কৃতির করে কাজটা উপহার দিতে পারে। শুভ কামনা রইলো বাংলাদেশি সিনেমা ও সিনেমাপ্রেমীদের জন্য।