Select Page

নদী শাসন এবং অন্য আরেকটি শাসনের সাক্ষী ‘অন্যদিন…’

নদী শাসন এবং অন্য আরেকটি শাসনের সাক্ষী ‘অন্যদিন…’

স্বাধীন ধারার নির্মাতা কামার আহমেদ সাইমন পরিচালিত ওয়াটার ট্রিলজি বা জলত্রয়ীর দ্বিতীয় চলচ্চিত্র, ‘অন্যদিন….‘ দেখার সৌভাগ্য অবশেষে হলো। এখন সৎভাবে ও কোনো স্পয়লার না দিয়ে, কথা বলতে চাই এই বিশেষ চলচ্চিত্রটি নিয়ে, যা বিগত সরকারের আমলে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

নির্মাতা কামার আহমেদ সাইমনের হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্র একটি বিশেষ জনরার সাথে পরিচিত হয়, সেটি হলো হাইব্রিড জনরার চলচ্চিত্র। তার বানানো চলচ্চিত্রগুলোর কিছু অংশ হয় সাজিয়ে গুছিয়ে শ্যুট করা, আর কিছু অংশ হয় লাইভ ফুটেজ বা ডকুমেন্টারি। এই স্ক্রিপ্টেড ফুটেজ ও লাইভ ফুটেজ; এডিটিং প্যানেলে গিয়ে এতো সুন্দর করে ফাইন টিউনিং করা হয়, যে আদতে সিনেমাটা ন্যারেটিভ ঘরানার হলো নাকি ডকুমেন্টারি, সেই রায় দেওয়াটা অসম্ভব হয়ে যায়। এভাবে সিনেমাহলের পর্দা ও দর্শকের চোখের পর্দার মাঝে যে ব্যবধানটা রয়েছে, সেটি কমিয়ে ফেলা হয়। এই ট্রিটমেন্ট নির্মাতা সাইমনের ‘শুনতে কি পাও’ এ ছিল, ‘নীলমুকুট’ এ ছিল, ‘অন্যদিন…’ এও রয়েছে। বাংলা চলচ্চিত্রে তার এই নতুন ধারা তৈরির ব্যাপারটা এপ্রিশিয়েট করবার মতন।

‘অন্যদিন…’ এর গল্প শুরু হয় প্রায় শতবছরের ঐতিহ্য ধরে রাখা নৌযান প্যাডেল স্টিমারকে ঘিরে।  শুধুমাত্র এই পয়েন্ট বিবেচনা করলে প্যাডেল স্টিমার আমাদের চলচ্চিত্র ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। সত্তর দশকের সাড়া জাগানো তুমুল জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘সারেং বউ’ তে নায়ক ফারুক এই প্যাডেল স্টিমারের সারেং থাকেন, বাড়ি ফেরার তাড়নায় তাকে ‘ওরে নীল দরিয়া’ গেয়ে উঠতে শোনা যায়।

এই প্রজন্মের কথা যদি বলি, ২০১৮ সালে নূর ইমরান মিঠু বানিয়েছিলেন ‘কমলা রকেট’, যেখানে দেখানো হয়েছে একটি সাজানো দুর্ঘটনার মাধ্যমে কীভাবে সমাজের উচ্চশ্রেণি ও সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষ এক শ্রেণিতে এসে ঠাই পায়। ‘অন্যদিন’ এও এগুলো দেখানো হয়েছে। এখানে দেখানো হয়েছে সমাজের একজন অন্ধ গাতককে, রয়েছেন একজন মুরুব্বি সারেং, কিছু বিদেশী পর্যটক, কিছু ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট, কিছু ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, একজন তরুণ ভ্লগার, পা ভেঙে যাওয়া অসহায় গরিব, এলাকার চেয়ারম্যান, উচ্চশ্রেণির একটি পরিবার – আরো কত কী! গল্পকার এখানে বিশাল বড় একটি জাল ফেলেছেন, তার গল্পের পরিধি দেখানোর জন্য।

প্যাডেল স্টিমারের যাত্রার মাধ্যমে আমাদের দেশের নদীপথ ও নদীপথের সমস্যাগুলোর সম্মুখীন আমরা হই। এখানে দেখানো হয়েছে নাব্যতা সংকট, বালু উত্তোলনের ফলে নদীপথ সরু হয়ে যাওয়া, নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে আটকে পড়া সহ অনেক কিছু। সমালোচনা করা হয়েছে ক্ষতি হচ্ছে বোঝা সত্ত্বেও তৎকালীন সরকার নদীপথ সুরক্ষায় কোনো চাক্ষুস ব্যবস্থা না নেয়ায়। নদীকে ঘিরে এলাকার মানুষের সমস্যাগুলোর গুরুত্ব না দেওয়ায়। নদী শাসন সমস্যার পাশাপাশি চলচ্চিত্রটি একসময়ে ঘটে যাওয়া বোর্ড পরিক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ঘটনা নিয়েও সমালোচনা করে।

নদী সমস্যার পাশাপাশি চলচ্চিত্রটি ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি গুরুত্বারোপ করে। বেশিরভাগ মানুষের বাইরের এক, অন্তরে আরেক – এই নীতি নিয়ে কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে।  কিছু মেটাফোর ব্যবহার করা হয়েছে চলচ্চিত্রে, যেগুলো স্পয়লারের খাতিরে এড়িয়ে যাওয়া ভালো। ওগুলো সিনেমাহলের দর্শকের জন্য তোলা থাক।

তবে শুধু যে সব সমস্যার জন্য একপাক্ষিকভাবে তৎকালীন সরকার, অর্থাৎ আওয়ামী লীগকেই দোষারোপ করা হয়েছে, বিষয়টি এমন নয়। সিনেমার শেষভাগে একজন রাজনৈতিক নেতা ও কিছু ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকের মধ্যে বেশ লম্বা সময়ব্যাপী একটি বিতর্ক আমরা দেখতে পাই। উক্ত বিতর্কের মাধ্যমে সরকারকে আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ দেয়া হয়েছে।

চলচ্চিত্রটির গল্প, চিত্রনাট্য, পরিচালনার পাশাপাশি চিত্রগ্রহণও করেছেন কামার আহমেদ সাইমন। প্যাডেল স্টিমারের প্রতিটি কোণায় তিনি ক্যামেরা নিয়ে চলে গিয়েছেন। স্টিমারের সামনে, পেছনে, আন্ডারগ্রাউন্ডে, ওয়াশরুমে, কেবিনে, ডেকে, ডাইনিং স্পেসে, ইঞ্জিন রুমে… কোনো জায়গা ক্যামেরাবন্দী করা তিনি বাদ রাখেননি। স্টিমার দেখানো ছাড়াও তিনি শীতকালের ঘন কুয়াশার অপরূপ দৃশ্য দেখিয়েছেন, লঞ্চঘাট পাড়ের অদেখা দৃশ্য দেখিয়েছেন। তবে প্রকৃতি সংক্রান্ত আরো কিছু অপরূপ দৃশ্য দেখতে পেলে আরেকটু ভালোলাগতো।

কিছু নেতিবাচক ব্যাপার বলি। প্যাডেল স্টিমারের কর্মচারীদের জীবনবৈশিষ্ট্য এখানে একটু কম উঠে এসেছে। স্টিমারের যাত্রীদের যেমন নানারকম জীবনের গল্প রয়েছে, আমি মনে করি যারা প্যাডেল স্টিমারকেই নিজেদের ঘরবাড়ি বানিয়ে নিয়েছেন, তাদেরও এই গল্পে কিছু বলার আছে। সিনেমার কিছু অংশ একটা সময়ের পর রিপিট হতে থাকে, যার ফলে কিছুটা মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে। র্দৈর্ঘ্যের দিক থেকে ‘অন্যদিন…’ আরেকটু ছোট হলে বিষয়টা মন্দ হতো না।

সবমিলিয়ে ‘অন্যদিন…’ হলো একটি সময়কে ধরে রাখা চলচ্চিত্র, যার একটি আর্কাইভ ভ্যালু রয়েছে। সময়ের সাথে সাথে আমরা হয়তো আমাদের অতীত ভুলে যাবো, ‘অন্যদিন…’ হলো সেই অতীত স্মৃতি ধরে রাখার একটি সফল প্রয়াস।


About The Author

প্রতিষ্ঠাতা বাংলা মুভি রিভিউ (বিএমআর)

Leave a reply