“নবাব” নিয়ে শাকিব খান মিথ্যা বলেন নি, তবে…
শাকিব খান বলেছেন “নবাব” সিনেমায় আমি বাংলাদেশের পুলিশ”। একদল দর্শক বলছেন “শাকিব মিথ্যা বলেছেন, নবাবে সে ভারতের পুলিশ”। আবার আরেকদল দর্শক বলছেন “নবাবে শাকিব বাংলাদেশেরই পুলিশ”। আসলে কার কথা সত্য ???
ব্যক্তিগতভাবে আমি সাংবাদিকতা বা সিনেমার সাথে পেশাগতভাবে জড়িত কেউ নই। শখের বশে সব ধরণের বাংলাদেশী সিনেমা দেখলেও সিনেমা কিন্তু শুধু চোখের দেখা দেখে চলে আসি না। যতটুকু মনোযোগ দেওয়া সম্ভব ততটুকু দিয়েই হাতে খাতা-কলম নিয়ে সিনেমা দেখি। হলে বসে সিনেমা দেখতে দেখতেই সেই সিনেমার অনেক খুঁটিনাটি বিষয় ও ভুলত্রুটি খাতায় লিখে ফেলি।
যথারীতি ঈদের দ্বিতীয় দিন পাবনার রূপকথা সিনেমা হলে যাই “নবাব” সিনেমাটি দেখতে। সিনেমাটি দেখার আগেই মাথায় ঘুরছিল শাকিব খান বলেছিলেন এই সিনেমাতে তিনি “ভারতে বাংলাদেশী পুলিশদের প্রতিনিধিত্ব করে বাংলাদেশী পুলিশদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন”। কিন্তু ছবিতে যখন দেখলাম তিনি ভারতের পুলিশ চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তখন অন্যান্য দর্শকদের মত আমিও হতাশ হয়ে শাকিব খানকে “মিথ্যাবাদী” বলে আখ্যায়িত করি। এরপরের দিনই ফেসবুকে এ ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাই। একদল বলছেন সিনেমাতে তারা দেখেছেন “শাকিব ভারতের পুলিশ”, আরেকদল দাবি করছেন “শাকিব বাংলাদেশের পুলিশ”। এই দুই দলের মাঝখানে বিভ্রান্ত হয়ে দুদিন পর ছবিটি আবার আরো ঠান্ডা মাথায় দেখি। এবার শতভাগ নিশ্চিত হই শাকিব “ভারতের পুলিশ” চরিত্রেই অভিনয় করেছেন এবং সেই অনুযায়ী রিভিউ লিখি। কিন্তু ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কিছু দর্শক আবারো জোরালো দাবি করে এই সিনেমায় শাকিব “বাংলাদেশ থেকে ভারতে নিযুক্ত স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসার”। অবশেষে ঢাকার এক বন্ধুর সাহায্যে বিষয়টি আমার কাছে পরিষ্কার হয়।
মূলত বাংলাদেশ ও ভারতে পুরো সিনেমাটি একই হলেও কয়েকটা সংলাপ ও দৃশ্যের অবস্থান বর্ণনা সিনেমাটির দুটি ভার্সন বা সংস্করণ তৈরি করে ফেলেছে। যেমন, বাংলাদেশে আমরা যে “অগ্নি-২” সিনেমাটি দেখেছি, ভারতে তা কিছুটা অন্যরকম প্লটে মুক্তি পেয়েছিল। কারণ অগ্নি-১ ঐদেশে মুক্তি পেয়েছিল না। আবার, সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত বস-২ সিনেমাতে জিৎ কর্তৃক গণপতি বিসর্জনের একটা দৃশ্য ট্রেলার ও ভারতীয় ভার্সনে থাকলেও বাংলাদেশে সেই দৃশ্য কর্তন করে প্রদর্শিত হয়েছে। যাতে বাংলাদেশের মুসলিম (সংখ্যাগরিষ্ঠ) দর্শকদের হজম করতে সমস্যা না হয়। ঠিক তেমনি “নবাব” এরও বাংলাদেশী ভার্সন রয়েছে, যেখানে
বাংলাদেশী দর্শকদের খুশি রাখতে দেখানো হয়েছে…
১. শাকিব ঢাকা থেকে কলকাতায় আগত একজন স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসার রাজীব চৌধুরী।
২. তার মা ঢাকায় সন্ত্রাসী হামলায় আহত হলে তাকে ভারতে চিকিৎসার জন্য আনা হয়।
৩. বাংলাদেশী নাগরিক হওয়ায় তাকে ও আরেক বাংলাদেশী নাগরিক ও সন্ত্রাসী পাশা (কমল পাটেকার)কে আদালত বন্দী বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করার জন্য বিশেষ কারাগারে প্রেরণ করেন।
৪. অমিত হাসানকে তার নিজের কণ্ঠেই সংলাপ বলতে শোনা গেছে।
আর ভারতীয় ভার্সনে ভারতীয় দর্শকদের খুশি রাখতে দেখানো হয়েছে…
১. শাকিব খান দিল্লী থেকে আসা স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসার শ্রী রাজীব চৌধুরী।
২. তার মা শিলিগুড়িতে সন্ত্রাসী হামলায় আহত হলে তাকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় আনা হয়।
৩. শাকিব খান ও পাশা (কমল পাটেকার) উভয়কেই ভারতীয় নাগরিক হিসেবে আদালত আসানসোল কারাগারে প্রেরণ করে।
৪. অমিত হাসানের সংলাপ কোন কলকাতার শিল্পীকে দিয়ে ডাবিং করা হয়েছে।
আসুন এবার দেখি এই দুই ভার্সনে এত পার্থক্য থাকার সম্ভাব্য কারণসমূহ…
১. যে দেশে চুলবুল পান্ডে, রাউডি রাঠোর ও সিংহামের মত পুলিশ আছে (!) সে দেশের দর্শক তথা জনগণ কোনদিন এটা মেনে নেবেন না যে তাদের দেশে সন্ত্রাসী হামলা প্রতিহত করার জন্য বাংলাদেশ থেকে আসা পুলিশের সাহায্য নিতে হবে।
২. ঢাকায় শাকিবের মায়ের উপর হামলা হয়েছে দেখালে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের প্রসঙ্গ চলে আসতো, আর নির্মাতারা চেয়েছেন ভারতীয় ভার্সনের গল্পে বাংলাদেশের কোন চিহ্ন পর্যন্ত না থাকুক।
৩. প্রায় সব ভারতীয় সিনেমাতেই সন্ত্রাসী বা জঙ্গিবাদী বোঝাতে তারা পাকিস্তানি বা মুসলিম চরিত্রদের বোঝায়। এ সিনেমায় দুই মুসলিম সন্ত্রাসী সেলিম (ডাঃ বাবু) ও পাশা (কমল পাটেকার)কে তারা সহজেই পাকিস্তানি বা বাংলাদেশী জঙ্গিবাদী বলে চালিয়ে দিতে পারত, কিন্তু তারা কোন বহিরাগত বা বিচ্ছিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্য ছিল না বরং ভারতীয় আভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদী ছিল। তাই “অযৌক্তিক” ঝামেলা এড়াতে ও বাংলাদেশের চিহ্ন না রাখতে ভারতীয় ভার্সনে পাশা চরিত্রটির ভারতীয় নাগরিক হিসেবেই বিচার হয়।
৪. বাংলাদেশের প্রায় সব দর্শকই অমিত হাসানের কন্ঠ চেনেন। এদিকে তার কালীচরণ চরিত্রটি ছিল পশ্চিমবঙ্গের লোকাল সন্ত্রাসীর, যার সংলাপে স্বাভাবিকভাবেই কলকাতার বাংলা উচ্চারণ ও টান থাকবে। কিন্তু অমিত হাসানের ঢাকাইয়া ভাষার উচ্চারণ ঠিক হলেও কলকাতার বাংলা উচ্চারণ মানানসই নয়। তাই বাংলাদেশী ভার্সনে তার কন্ঠ রাখলেও ভারতীয় ভার্সনে কলকাতার কোন শিল্পীকে দিয়ে ডাবিং করানো হয়েছে।
অতএব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে নবাবে বাংলাদেশের পুলিশের প্রতিনিধিত্ব ও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা নিয়ে শাকিব খানের মন্তব্য অর্ধ সত্য অর্ধ মিথ্যা। কারণ তিনি অবশ্যই জানতেন দুই দেশে মুক্তির জন্য এই সিনেমার দুটি ভার্সন করা হয়েছে এবং বাংলাদেশী ভার্সনের জন্য তার উক্তিগুলো সঠিক। কিন্তু তিনি হয়তো জানতেন না ভারতীয় ভার্সনটিও একই সাথে বাংলাদেশে মুক্তি দেওয়া হবে। যদিও কলকাতায় এখনো নবাব মুক্তি পায়নি, কিন্তু একটু দেরিতে হলেও আমরা এই ছবির দুই ভার্সনের ব্যাপারটা জেনে যেতাম। আর ভারতীয় দর্শকরা যেহেতু ভারতীয় ভার্সনে শাকিব খানকে ভারতীয় পুলিশ চরিত্রেই পাবে, সেহেতু এখানে বাংলাদেশের পুলিশদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল বা অনুজ্জ্বল হওয়ার ব্যাপারটি মূল্যহীন।
এবার আসি বাংলাদেশে এই ছবিটির ভারতীয় ভার্সন মুক্তি পাওয়া নিয়ে। এই বিষয়ে অনেকের মনে অনেক ধরণের প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে। যেমন…
১. জাজ মাল্টিমিডিয়া কি ভুল করেই ছবিটির ভারতীয় ভার্সন বাংলাদেশে মুক্তি দিয়ে ফেলেছে ? – না, ৩৫ মিঃমিঃ বা রিলের যুগ হলে সেটা মানা যেত। কিন্তু ডিজিটাল ফর্ম্যাটের যুগে এই ধরণের ভুল ভুল করেও জাজ করবে না। এটা পরিষ্কার যে এই সিনেমাটির বাংলাদেশী ভার্সনটি যৌথ প্রযোজনা রিভিউ কমিটি ও সেন্সরবোর্ডে জমা দেওয়া হয়, যাতে কমিটি থেকে অনাপত্তিপত্র ও বোর্ড থেকে ছাড়পত্র পেতে ঝক্কি পোহাতে না হয়।
২. শুধু কি বিশেষ কিছু সিনেমা হলেই বাংলাদেশী ভার্সন মুক্তি পেয়েছে ? – যদি মনে করেন ঢাকা বা আশেপাশের কিছু হলেই সমালোচক শ্রেণির দর্শকরা সিনেমা দেখেন বলে তাদের ঠান্ডা রাখার জন্য সেখানে বাংলাদেশী ভার্সন এবং মফস্বল অঞ্চলের দর্শকরা শাকিবের ক্যারেক্টার নিয়ে মাথা ঘামাবেন না বলে সেখানে ভারতীয় ভার্সন প্রদর্শিত হয়েছে ; তাহলে আপনার ধারণা ভুল। কারণ খোদ ঢাকারই সনি ও শ্যামলী সিনেমা হলে যথাক্রমে এই সিনেমার ভারতীয় ও বাংলাদেশী ভার্সন প্রদর্শিত হয়েছে।
৩. জাজ মাল্টিমিডিয়া কি শাকিব খানকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করতে চাইছে ? – এই ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ জাজ জেনেশুনে নিজের পায়ে কুড়াল মারবে না।
৪. এটা কি জাজের নতুন আয়নাবাজি ? – হ্যা, এটাই সঠিক উত্তর। আমি আগেই বলেছি শাকিবের ক্যারেক্টার নিয়ে ফেসবুকে বিভ্রান্তিকর ও দ্বিমুখী মন্তব্য দেখে সন্দেহ দূর করার জন্য বাধ্য হয়ে আমি নিজেই সিনেমাটি দুইবার দেখেছি । তদ্রুপ সনি হলের অনেক দর্শক পুনরায় শ্যামলী হলে, এবং শ্যামলী হলের দর্শকরা পুনরায় সনি হলে ছবিটি দেখেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। তার মানে জাজের আয়নাবাজির ফাঁদে পড়ে আমার মত অনেক দর্শকেই দুই টিকিটে এক ছবি দেখতে হয়েছে। আর সেই টিকেটের টাকার অংশ গেছে জাজের পকেটে।
আসুন এবার দেখি জাজের এই আয়নাবাজি বৈধ নাকি ? তার আগে আমাদের জানতে হবে যৌথ প্রযোজনার সিনেমায় এই ধরণের ডাবল ভার্সন বৈধ কিনা। হ্যা, যৌথ প্রযোজনার সিনেমায় যেকোন দেশের প্রযোজক চাইলে নিজ দেশের স্বার্থ ও বাজার বিবেচনা করে সিনেমার গল্পের কিছুটা থিম, চিত্রনাট্য বা সংলাপ, ভাষা এমনকি প্রয়োজনে নামও পরিবর্তন করে নিজ দেশে মুক্তি দিতে। উপরে অগ্নি-২ ও বস-২ নিয়ে আমি এই ব্যাপারে কিছুটা ধারণা দিয়েছি। এবার উদাহরণসহ পরিষ্কার করছি।
১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ+ভারত+কানাডার যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত একটি ছবি বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় “দূরদেশ” নামে মুক্তি পেলেও, ভারত ও কানাডায় Gehri Chot নামে হিন্দি ভাষায় মুক্তি পায়। আবার রিয়াজ-শাবনূর জুটির একটি ফোঁক ফ্যান্টাসি মুভি মুসলিম প্রেক্ষাপটে “নসিমন” নামে বাংলাদেশে মুক্তি পেলেও ভারতে হিন্দুয়ানি প্রেক্ষাপটে “বৌমার বনবাস” নামে মুক্তি পায়। যৌথ প্রযোজনার সিনেমায় “ডাবল ভার্সন” অস্বাভাবিক বা অবৈধ কিছু না হলেও একই দেশে একই সময়ে একাধিক প্রেক্ষাগৃহে (নবাবের মত) কোন সিনেমার ডাবল ভার্সনই প্রদর্শিত হওয়ার নজির নেই। এবং এটা নিঃসন্দেহে আইনবহির্ভূত । কারণ একটি সিনেমা সেন্সর ছাড়পত্র পেয়ে সিনেমা হলে মুক্তি পাওয়ার পর নির্মাতারা যদি মনে করেন সিনেমাটির এক বা একাধিক দৃশ্য বা সংলাপ পরিবর্তন/পরিবর্ধন/পরিবর্জন করা দরকার, তাহলে তাদের প্রথমে সেন্সরবোর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে সিনেমার সেই পরিবর্তিত সংস্করণ (রিভাইজড ভার্সন) এর পুনরায় সেন্সরবোর্ড কর্তৃক ছাড়পত্র নিয়ে সিনেমা হলগুলোতে প্রদর্শন করাতে হয়। যেমন “তুমি স্বপ্ন তুমি সাধনা” সিনেমার শেষ অংশে শাকিব খানের মৃত্যুর দৃশ্য দেখে অনেক দর্শক ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাই নির্মাতারা ছবির শেষ অংশটুকু পরিবর্তন করে শাকিবকে জীবিত রাখেন। এই পরিবর্তন করার জন্যও কিন্তু নির্মাতাদের উপরে উল্লেখিত নিয়মাবলী মানতে হয়েছিল। আবার “রানা পাগলা-দ্যা মেন্টাল” সিনেমার কাহিনী দুর্বোধ্য হওয়ার অভিযোগ উঠলে নির্মাতা উপরোক্ত নিয়মের মাধ্যমেই চিত্রনাট্য পরিবর্তন করে সহজ গল্পে ছবিটি মুক্তি দেন। কিন্তু এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে জাজ মাল্টিমিডিয়া কোন নিয়ম না মেনেই দুটি ভিন্ন ধাঁচের “নবাব” সিনেমা একই সময়ে মুক্তি দিয়েছে। বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের এই কর্মকান্ড “ইউনিক” মনে হলেও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র নীতিমালার সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক এবং একে সাধারণ দর্শকদের সাথে “অসাধারণ প্রতারণা” বললেও বেশি বলা হবে না।
সবশেষে এতটুকুই বলতে চাই, সিনেমায় চমক বা নতুনত্ব আনয়ন করা দোষের কিছু না। এবং সিনেমার পাবলিসিটি বা ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন পলিসি বা স্টান্টবাজি করাও অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু তাই বলে দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন চিত্রনায়কের স্টারডমকে ব্যবহার করে, চলচ্চিত্রের নীতিমালা না মেনে এবং সাধারণ দর্শকদের বিভ্রান্তিকে পুঁজি করে কোন বিজনেস পলিসি গ্রহণযোগ্য নয়। আশা করব জাজ মাল্টিমিডিয়া ভবিষ্যতে এই ধরণের কর্মকান্ড থেকে বিরত এবং কর্তৃপক্ষ ও সাধারণ দর্শক সোচ্চার থাকবে। আপনার, আমার, আমাদের সকলের ভালোবাসা নিয়েই এগিয়ে যাক প্রাণের বাংলাদেশী সিনেমা।