নিশো মানেই ভালো গল্প-সেরা অভিনয়
তিনি এ সময়ের টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির একমাত্র অভিনেতা যাকে দর্শকেরা কোন চরিত্রে দেখেনি তা বলা মুশকিল! গ্রামের সহজ-সরল যুবক, পরিশ্রমী মাঝি, লিফটম্যান, পাগল, হকার বা ফেরিওয়ালা, মোবাইল মেকানিক, গ্যাং লিডার, প্রেমিক, বেকার যুবক বা রোমান্টিক স্বামী বা বাচ্চা চুরির দলের সদস্য, খুনি— সব ধরনের চরিত্রে নিজেকে উজাড় করে দেন এই অভিনেতা। সাবলীল অভিনয় মন জয় করেছে সবারই। বুঝতেই পারছেন, আফরান নিশোর কথা বলা হচ্ছে।
আফরান নিশো সব শ্রেণির দর্শকের কাছে প্রাণবন্ত ও বৈচিত্র্যময় অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অভিনয় দক্ষতা ও কঠোর পরিশ্রম দিয়ে। একজন ভার্সেটাইল অভিনেতা তার সফলতাও আকাশছোঁয়া। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করছেন তিনি। তার নাটকে দর্শক পায় ভালো গল্প ও অভিনয়ের সংমিশ্রণ।
হুমায়ূন ফরিদী, জাহিদ হাসান, মাহফুজ আহমেদ, মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরীর প্রজন্মের পরে আফরান নিশোর মতো ক্যারেক্টারের ভ্যারিয়েশন তার সমসাময়িকদের মধ্যে অন্য কেউ সেভাবে দেখাতে পারেনি। মোশাররফ বা চঞ্চল এখনো সমান দাপটে কাজ করলেও স্বভাবতই বয়সের কারণে সব চরিত্র তারা পান না।
নিশোর পারিবারিক নাম আহমেদ ফাজলে রাব্বি। ১৯৮০ সালের ৮ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর উপজেলায় তার জন্ম। রাজধানীর ধানমন্ডি সরকারি বয়েস স্কুল থেকে এসএসসি, ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি এবং গ্র্যাজুয়েশন করেন ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে।
কখনো মডেল বা অভিনেতা হওয়া বা মিডিয়াতে কাজ করার স্বপ্ন না দেখলেও হঠাৎ করেই আফরান নিশোর মডেলিংয়ে আসা। ২০০৩ সালে অমিতাভ রেজার বিজ্ঞাপনচিত্রে তার অভিষেক হয়। আরও কিছু নির্মাতার সঙ্গে কাজের একই বছর আফজাল হোসেনের প্রতিষ্ঠান টকিজে স্ক্রিন টেস্ট দেন। সে সূত্রে থাইল্যান্ডে ডাবল কোলা ব্র্যান্ডের জিনি জিনজার ফ্লেভারের ড্রিংকসের বিজ্ঞাপনচিত্রে অংশ নেন তিনি, এতে ভালোই জনপ্রিয়তা পান নিশো। তারপর একে একে গাজী শুভ্র, গোলাম হায়দার কিসলু, কিরণ মেহেদীসহ খ্যাতনামা অনেক পরিচালকের বিজ্ঞাপনে কাজ করেন। এভাবে স্বতন্ত্র জায়গা করে নেন বিজ্ঞাপন ইন্ডাস্ট্রিতে।
২০০৬ সালে বাংলাভিশনে প্রচারিত গাজী রাকায়েত পরিচালিত ‘ঘরছাড়া’ নাটকের মধ্য দিয়ে প্রথম টেলিভিশন নাটকে মুখ দেখান নিশো। বলা যায়, প্রথম নাটকেই নজর কাড়েন এবং পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। অবশ্য স্ট্রাগলিং সময়ে যেসব নাটকে অভিনয় করেছিলেন সেগুলো তাকে চট করেই অভিনেতা হিসেবে তারকাখ্যাতি না এনে দেয়নি, বরং আস্তে আস্তে অভিনেতা হিসেবে তাকে তৈরি করতে সাহায্য করেছে। এভাবেই গুণী নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করে নিজেকে শানিত করার সুযোগ পান। কিছুটা সময় এভাবেই পার করলেও ২০১৬ থেকে ২০২১ এই পাঁচ বছরের বিশেষ দিন যেমন; দুই ঈদ বা বৈশাখ অথবা ভালোবাসা দিবসে প্রায় একচেটিয়া অভিনয় করতে দেখা গেছে নিশোকে। এই ব্যস্ততা ও পরিশ্রম তাকে এনে দিয়েছে অর্থ ও যশ। খ্যাতি পেয়েই দিশেহারা না হয়ে পরিণত অভিনেতা হিসেবে নিজেকে ঝালিয়ে নেওয়ার যুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিলেন নিশো। এরই ধারাবাহিকতায় বিগত কয়েক বছরে অগণিত জনপ্রিয় নাটকে অভিনয় করে নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অন্য উচ্চতায়।
অভিনয়কে প্যাশন হিসেবে মেনে চলা এই মানুষটা তার সকল ধ্যান-জ্ঞান এখনো অভিনয়ের মাঝেই রেখেছেন। ব্যক্তিজীবনের সময়টা বাদে দর্শকদের রুচি, চাহিদা ও সময়োপযোগী গল্প মাথায় রেখে কাজ করে চলেছেন অবিরাম। অভিনয় নিয়ে নিশোর স্বপ্ন হলো একদম বাস্তবিক ও ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে কাজ করা। বিভিন্ন সময় দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, প্রয়াত অভিনেতা হুমায়ূন ফরিদীকে আইডল মানেন তিনি। তাই হয়তো ফরিদীর পরে তাকেই টেলিভিশনে সব ধরনের চরিত্রে অভিনয় করার মতো শক্তিশালী অভিনেতা হিসেবে গণ্য করা হয়।
নিশো অভিনীত উল্লেখযোগ্য কিছু নাটক— অচেনা মানুষ, স্বপ্নগুলো ইচ্ছে মতো, ইডিয়টস, টার্নওভার, ফুলমতি, শুধু তোর জন্য, তুমি না থাকলে, লোটাকম্বল, রেড রোজ, বিয়ে পাগল, শেষ চিঠি, আকাশের ঠিকানায়, ইঞ্জিন, ধূমকেতু, কংকাবতির চিঠি, প্রেম না দ্বিধা, আবারও দেবদাস, আকাশের ঠিকানায়, এক্স স্কয়ার, হার্টবিট, নিখোঁজ ভালোবাসা, সংসার, কমলা সুন্দরী, বাঁক, ডাইভোর্স, হাওয়াই শহরের গল্প,গুলবাহার, একটি অসমাপ্ত ভালোবাসা, ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প, প্রতীক্ষা, হেল্পফুল সাইফুল, হোম টিউটর, অগোচরে ভালোবাসা, জীবন সঙ্গী, কমলার বনবাস, অনুভবে, সহজ সরল ছেলেটা, বুকের বাঁ পাশে, বা সাম্প্রতিক সময়ে ফেরার পথ নেই, ছেলেরাও কাঁদে, লালাই, লায়লা তুমি কি আমাকে মিস করো, উচ্চতর হিসাববিজ্ঞান, দা প্রেস, এই শহরে, ভিকটিম, ইতি মা, নির্বাসন, উপহার, আগন্তুক, মিস শিউলি, জন্মদাগ ইত্যাদি।
সাম্প্রতিক সময়ে ইরিনা, চিরকাল আজ, জি-ফাইভের মাইনকার চিপায়, চরকির মরীচিকা বা স্বল্পদৈর্ঘ্য পুনর্জন্ম-২ তাকে অভিনেতা হিসেবে এগিয়ে নিয়ে গেছে আরও অনেকটা পথ। শিল্পী নাটকের ‘বুক চিন চিন’ গানে তার পারফরম্যান্স এতটাই প্রাণবন্ত ছিল যে মুহূর্তেই গানটি ভাইরাল হয়ে যায়।
জুটি হিসেবে তিশা, মেহজাবীন ও তানজিন তিশার সঙ্গে বেশির ভাগ কাজ করলেও সিনিয়র অভিনেত্রী অপি করিম বা জুনিয়র তাসনিয়া ফারিন সবার সঙ্গেই তাকে মানিয়ে যায় সুন্দরভাবে। উল্লেখযোগ্য আরেকটি বিষয়, ক্যারিয়ারে সুসময়েও তিনি ভালো চিত্রনাট্য পেলে সমসাময়িক অপূর্ব বা তাহসান বা সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত সিয়াম আহমেদ হোক বা একেবারেই নতুন খায়রুল বাসারের সঙ্গেও স্ক্রিন শেয়ার করেছেন এবং নিজের স্বতন্ত্রতা দেখিয়েছেন সফলতার সঙ্গেই।
সব মিলিয়ে একজন অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রমাণের খেলায় আফরান নিশো যে অনন্য এক উচ্চতায় জায়গা করে নিয়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই সময়ের ভার্সেটাইল অভিনেতা বললে সবার আগে তার নামটাই মাথায় আসে। তার ভয়েস, ডায়ালগ ডেলিভারি, যেকোনো চরিত্রে নিজেকে পুরোপুরি মানিয়ে নেবার ক্ষমতা তাকে এ খেতাব এনে দিয়েছে। তবে বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম চলচ্চিত্রের পর্দায় তার অভিনয় দক্ষতা দেখার আশায় আছেন তার অগণিত ভক্তরা। আশা করি ব্যাটে-বলে মিলে যাবে সব, আমরাও নিশোকে বড়পর্দায় পাবো।