নিষিদ্ধ করার এখতিয়ার সেন্সর বোর্ডের নেই, ‘মেকআপ’র ক্ষেত্রে কী হয়েছে?
চলচ্চিত্রের মানুষকে বাজেভাবে উপস্থাপন করার অভিযোগে অনন্য মামুন পরিচালিত ‘মেকআপ’ ছবিটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানান সেন্সর বোর্ডের সদস্য খোরশেদ আলম খসরু। কিন্তু এও প্রশ্ন উঠেছে কোনো সিনেমাকে নিষিদ্ধ করার এখতিয়ার নেই বোর্ডের। তাহলে কী ঘটেছে? এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন কালের কণ্ঠের মাহতাব হোসেন।
সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন বলেন, ‘চলচ্চিত্রের মানুষ মানেই খারাপ এটা ভাবা অন্যায়। আমরা চাই না সারা দেশের মানুষ ছবিটি দেখে ভুল কোনো ধারণা তৈরি করুক। তাই ছবিটি ব্যান করা হয়েছে।’ আবার এও বলেন, ‘নিষিদ্ধ করা হয়নি, ছবিটির কিছু বিষয় শুধু অবজার্ভেশন হয়েছে।’
যদিও বুধবার দুপুরেও খসরু বলেন, ‘ছবিটি আসলে সাধারণ দর্শকদের জন্য মুক্তি দেওয়ার মতো নয়। বাজেভাবে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য এই ছবি বানানো হয়েছে।’
তবে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিষিদ্ধ করার এখতিয়ার সেন্সর বোর্ডের নেই। যদি নিষিদ্ধ করতে হয় তাহলে নতুন করে আইন তৈরি করে গেজেট আকারে প্রকাশ করতে হবে। সেন্সর বোর্ডের কাজ সার্টিফাই ও আনসার্টিফাই করা।
চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক জসিম আহমেদ বলছেন, ‘চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ আইন সেন্সরবোর্ডকে কোনো চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা দেয়নি। তাদের ক্ষমতা সার্টিফিকেট দেওয়া অথবা আনসার্টিফায়েড করা পর্যন্ত। সেন্সর বোর্ড আনসার্টিফায়েড করলে প্রযোজক আপিল করতে পারেন, তাতেও সার্টিফিকেট না পাওয়া গেলে আদালত আছে। সরকার কোনো চলচ্চিত্রকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশের আগে কি নিষিদ্ধ বলা যায়? আইনজ্ঞরা কী বলেন?’
চলচ্চিত্র সেন্সর আইন (১৯৬৩) ঘেঁটে দেখা গেছে, ‘চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ আইন, ১৯৬৩’-এর কোথাও ‘নিষিদ্ধ’ বা ‘ব্যান’ শব্দটি নেই। সেন্সর বোর্ডের আইন অনুযায়ী একটি চলচ্চিত্রকে প্রদর্শন উপযুক্ত ও প্রদর্শন অনুপযুক্ত হিসেবে গণ্য করা হয়, এ ক্ষেত্রে সার্টিফিকেট দেওয়া বা না দেওয়ার প্রসঙ্গ আসে।
এ বিষয়ে চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত মেকআপ চলচ্চিত্রের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। আমাদের কিছু অবজার্ভেশন রয়েছে ছবিটি সম্পর্কে। আমরা মোটেও নিষিদ্ধ করিনি। আমরা যেটা করতে পারি, সেটা হলে প্রদর্শন উপযোগী বা অনুপযোগী হিসেবে জানিয়ে দেওয়া। এরপর আপিল করার সুযোগ রয়েছে। আপিল বোর্ড যদি বলে প্রদর্শন করা যাবে। সে ক্ষেত্রে সিনেমাটি ছাড়পত্র পাবে।
আগেও সিনেমা নিষিদ্ধ হয়েছে জানিয়ে সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ‘যদি ধাপে ধাপে ছবিটি মুক্তির একেবারে অনুপযোগী হয়, আপিল বিভাগেও সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত বহাল থাকে। সে ক্ষেত্রে ওই ছবি আর মুক্তি পায় না। এর আগেও এমন হয়েছে। সেই অর্থে হয়তো নিষিদ্ধ বলা হয়। তবে ‘মেকআপ’ ছবিটির ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কিছু পয়েন্ট নোট করা ছাড়া কোনো সিদ্ধান্তই হয়নি। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে অবশ্যই আমরা নির্মাতাকে জানিয়ে দেব।
কী আছে এই মেকআপ সিনেমায়?
মেকআপ ছবিটি নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছে নিষিদ্ধ প্রসঙ্গ চলে আসার পর। স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহল তৈরি হয়ে যায়- কী রয়েছে এই সিনেমায়, কী দেখানো হবে? এখন পর্যন্ত জানা গেছে, শোবিজ জগতের বেশ কিছু লুকোছাপা গল্প এই ছবির মুখ্য কাহিনি। সাম্প্রতিক সময়ে গোটা বিশ্বে মি টু হ্যাশট্যাগ ও কাস্টিং কাউচ নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু হয়। তবে এ দেশের প্রেক্ষাপটে সেসব হালে পানি পায়নি। বিষয়টি থিতিয়েই গিয়েছিল, কিন্তু মেকআপ মৃত বিষয়টিকে জীবিত করে তুলেছে। কাস্টিং কাউচ বিষয়টি মেকআপ চলচ্চিত্রের একটি বিতর্কিত বিষয়। এখানে বলা হয়েছে, ‘নায়িকা হতে হলে শুতে হবে।’
এই সংলাপের তীব্রভাবে বিরোধিতা করা হয়েছে। সব নায়িকাই কি নায়িকা হতে গিয়ে শয্যাসঙ্গী হয়? এমন প্রশ্ন সামনে চলে আসে। অনন্য মামুন তাঁর এই ছবি সম্পর্কে বলেন, ‘আমি আসলে বুঝতেছি কী হয়েছে। আমার কাছে কোনো লিখিত চিঠি আসেনি। আমি শুনেছি কিছু কিছু দৃশ্যে আপত্তি রয়েছে। যদি আপত্তি থাকে, তাহলে সেটাকে সংশোধন করতে হবে। তবে ছবিটি মুক্তি পাবে। আমি বুঝতে পারছি, মৌলিক গল্পের ছবি বানালেই সমস্যা। লুতুপুতু প্রেমের গল্প বানালে সমস্যা হবে না নিশ্চয়ই।’
ছবির গল্প ও আপত্তিকর বিষয়গুলো নিয়ে সেন্সর বোর্ডের সদস্য অরুণা বিশ্বাস বলেন, কিছু ব্যাপার আমরা এড়িয়ে চলতে চাই। সামাজিক কারণে কোনো কোনো ব্যাপার অন্তরালে থাকে। কিছু নোংরা বিষয় এই সিনেমায় নিয়ে আসা হয়েছে, যা কোনোভাবেই প্রগতিশীলতার চিত্র প্রকাশ করে না। আমাদের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংসের মুখে, এখন ভালো কিছু চলচ্চিত্র নির্মাণ করা দরকার। বেডরুম হলেও কথা ছিল, ওয়াশরুমের ভেতরের গল্প বলার চেষ্টা করা হয়েছে। এসব নিশ্চয়ই ভালো কোনো উদ্দেশ্যে বানানো নয়। আমরা এমন ছবি মুক্তি দেওয়ার পক্ষে নই। আমাদের কাছে মতামত চাওয়া হয়েছে, আমরা মতামত দিয়েছি। বাকিটা সিদ্ধান্ত হলে জানা যাবে।
ছবিটি প্রযোজনা করেছে সেলেব্রিটি প্রোডাকশন। একই প্রতিষ্ঠানের ‘নবাব এলএলবি’ সিনেমাতে পুলিশকে অশ্লীলভাবে উপস্থাপনের অভিযোগে অনন্য মামুনকে কারাগারে যেতে হয়েছিল। সম্প্রতি ছবিটি সেন্সরে জমা পড়লে ১১টি দৃশ্য বাদ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।