নোবেল: নাম্বার ওয়ান মডেল স্টোরি
‘lonely day lonely night, you are far away’
আইয়ুব বাচ্চু-র গাওয়া জিঙ্গেলে ‘আজাদ বলপেন’-এর এই বিজ্ঞাপন নব্বই দশকে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তুমুল সাড়া ফেলেছিল। দুজন প্রেমিক-প্রেমিকার দূরত্বে চিঠি হয়ে ওঠে যোগাযোগের মাধ্যম আর চিঠি লিখতে তো কলম লাগেই। বিজ্ঞাপন হয়ে গেল বলপেনের, আজাদ বলপেন। আদিল হোসেন নোবেল নামে নতুন হার্টথ্রব এক মডেলকে পেল বাংলাদেশ।
নায়কোচিত, ব্যক্তিত্ববান, স্মার্ট নোবেল। তাঁকে দেখে নব্বই দশকে অনেক মেয়েই রাতের ঘুম হারাম করেছে। জন্ম ২০ ডিসেম্বর, ১৯৬৮ সালে, চট্টগ্রামের চকরিয়াতে।
চট্টগ্রাম কলেজে ১৯৮৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যখন পা রাখে আত্মীয়ের পরামর্শে র্যাম্প মডেলে যোগ দেয় ১৯৯১ সালে। সেখানে চোখে পড়ে আফজাল হোসেনের। আফজাল হোসেন তখন বিজ্ঞাপন জগতে নাম্বার ওয়ান নির্মাতা। নোবেলকে চিনতে তাঁর ভুল হয়নি। তাঁর হাত ধরেই মডেলিং-এ যাত্রা শুরু। তারপর মডেলিং-এ হয়ে ওঠে নাম্বার ওয়ান। তার অন্য পরিচয়ও আছে কিন্তু দেশের মানুষ তাঁকে মডেল হিসেবেই আইডল ভাবে তাই এই পরিচয়টাই তাঁর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। এমবিএ শেষ করে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে।
‘রূপসীর রেশমী চুলে, দোলে গো কেয়া দোলে। চুলের ঐ মেঘ কাজলে, দোলে গো কেয়া দোলে’
জিঙ্গেল শুনে এতক্ষণে বোঝার বাকি নেই এটা কোন বিজ্ঞাপন। কেয়া কসমেটিক্স’-এর রেগুলার মডেল ছিল নোবেল। তাঁর সহশিল্পী মৌ ছিল তাঁর সাথে। সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপনে। নোবেল-মৌ জুটিও আদর্শ এবং হার্টথ্রব তো বটেই। তাদেরকে পর্দায় দেখে ছেলেমেয়েতে আজকের ভাষায় ক্রাশ খেত। সেই নব্বই দশকে বিটিভির পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি, অ্যাডভেঞ্চার শো, নাটক কিংবা ম্যাগাজিন শো-র ফাঁকে নোবেল-মৌ জুটি হাজির হত। নোবেল-মৌ জুটির বিজ্ঞাপনগুলো – কেয়া সুপার লেমন সোপ, কেয়া লিপজেল, কেয়া পেট্রোলিয়াম জেলি, কেয়া ট্যালকম পাউডার, কেয়া কোকোনাট অয়েল, পাকিজা প্রিন্ট শাড়ি, কেয়া লন্ড্রী সোপ, রবি।
নোবেলের অন্যান্য বিজ্ঞাপনের মধ্যে আছে – স্প্রাইট, আরসি কোলা, কুল শেভিং ক্রিম, কেয়া লেমন সোপ, অলিম্পিক গোল্ড ব্যাটারি, ড্যানিশ, এইচ আর সি চা, ইনফিনিটি মেগা মল। নোবেলের প্রথমদিকের বিজ্ঞাপন ‘আজাদ বলপেন’-এ তার সহশিল্পী ছিল তানিয়া আহমেদ। নোবেলের সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন মৌ-এর বিপরীতে। এরপর আছে তিশা, মোনালিসা, পিয়া বিপাশা ও অন্যান্যদের সাথে।
অনেকে হয়তো জানলে অবাক হবে ১৯৯৩ সালে নির্মিত ব্লবাবাস্টার বাংলা ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’-এর প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল নোকেল-কে। সালমান শাহ-কে কাস্ট করার আগে তাকে প্রস্তাব করা হয়েছিল। নোবেল রাজি হয়নি। এছাড়াও আরো অনেক ছবির প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল তাকে।
নোবেল মিউজিক ভিডিওতে কাজ করত নব্বই দশক থেকেই। ‘সাডেন’ ব্যান্ডের ‘বাংলাদেশ’ শিরোনামের অন্যতম একটি গানে প্রায় পনেরো জন মডেলের মধ্যে নোবেলও ছিল। ‘আজাদ বলপেন’-এর পর নোবেল-তানিয়া ‘দুই জীবন’ ছবির ‘তুমি আজ কথা দিয়েছ’ এই জনপ্রিয় গানটির মডেল হয়েছিল। এ গানটি হানিফ সংকেতের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’-তে প্রচারিত হয়েছিল। এছাড়া মৌসুমীর সাথে ‘ইতিহাসের রাজা রাণী/পারব না হতে জানি’ গানে মডেল ছিল। এ গানটিও ‘ইত্যাদি’-র এবং জনপ্রিয় হয়েছিল। ‘শোনো সুন্দরী গো তোমায় প্রেম করা শেখাবো’ নামের একটি গানেও তাকে দেখা গেছে। এছাড়া আরো কিছু মিউজিক ভিডিও করেছিল।
– কাঁদে না আবির
– কই, আমি কাঁদছি না তো!
– কাঁদছ
যারা দেখেছে নাটকটি এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছে ‘শেষের কবিতার পরের কবিতা’ নাটকের সংলাপ এগুলো। নোবেল, মীম, আরিফিন শুভ অভিনীত জনপ্রিয় নাটক। নোবেল মীমকে ফেলে বিদেশে চলে যায় তার ভালোবাসাকে গ্রহণ না করে। কারণ ছিল মীম ইমম্যাচিউর। পরে ঠিকই সে ফিরে আসে কিন্তু ততদিনে মীম শুভর হয়ে গেছে। নোবেল নাটকে অভিনয় করেছে বেছে বেছে। মানসম্মত কাজে তাঁর আগ্রহ বরাবরই বেশি ছিল। ১৯৯৫ সালে প্যাকেজ নাটক ‘প্রাচীর পেরিয়ে’-তে প্রথম অভিনয় করে। নাটকে তাঁর অভিনয় হয়তো সেভাবে দর্শককে ততটা আকর্ষণ করে না কিন্ত তাঁর চেষ্টাটা প্রশংসনীয়। উল্লেখযোগ্য নাটক/টেলিফিল্ম – শেষের কবিতার পরের কবিতা, কুসুম কাঁটা, যদি ভালো না লাগে তো দিও না মন, হাউজ হাজবেন্ড, হাইওয়ে, অচেনা অতিথি, দ্য হিরো, লাভ ফাইনালি, তুমি আমাকে বলোনি, ব্ল্যাক নভেম্বর, নীল কুয়াশায়, ছায়া, নিঃসঙ্গ, বাজি, শূন্যতার বৃত্তে, শুকতারা, অবনীল ভালোবাসা, সবুজ আলপথে একদিন, ছোট ছোট ঢেউ।
এর মধ্যে ‘ছোট ছোট ঢেউ’ ছিল ১৯৯৫ সালের জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক। ‘লাভ ফাইনালি, সবুজ আলপথে একদিন, অবনীল ভালোবাসা’ নাটকগুলো মৌ-এর বিপরীতে। এছাড়া ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের নাটকে ১৯৯৭ সালে অভিনয় করেছিল নোবেল।
লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার-এর কয়েকটি আসরে বিচারকমণ্ডলীর মধ্যে অন্যতম হয়ে দায়িত্ব পালন করেছে নোবেল। উঠতি মডেল, অভিনেতাদের জন্য সেটা ছিল অনুপ্রেরণার।
মেরিল প্রথম আলো পুরস্কারে সেরা মডেল হয়ে ছয়বার পুরস্কার জেতে নোবেল। তাঁর সময়ে মডেলিং-এ সে-ই ছিল আধিপত্যে। তাছাড়া এই আসরের বিভিন্ন পর্বে পারফরম্যান্স করতে দেখা গেছে তাকে।
শোবিজে কাজের ফাঁকেই নোবেল ক্যারিয়ারে চাকরিকেও প্রাধান্য দিয়েছিল। ১৯৯৩ সালেই যোগ দেয় ‘এমজিএইচ’ গ্রুপে। ‘কোটস বাংলাদেশ’ নামে আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে ছিল। এছাড়া ‘এয়ারটেল’-এও কাজ করছে। ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর সুখী সংসার।
একজন নোবেল যেমন নব্বই দশকে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের কাছে স্বপ্নের মতো পাশাপাশি বর্তমান সময়েও অনেকের জন্য রোল মডেল যারা শোবিজে কাজ করতে আগ্রহী। নোবেল এভাবেই অনেকের আইডল বা আইকন হয়ে থাকুক।