‘ন ডরাই’ থেকে প্রাপ্তি কম নয়
‘ন ডরাই’ চমৎকার একটি সিনেমা হয়েছে। আমি যতখানি প্রত্যাশা করেছিলাম প্রাপ্তি তার চেয়ে মোটেও কম হয়নি।
হ্যাঁ, এও সত্য যে, একেকজন একেক ধরনের বা একেক লেভেলের প্রত্যাশা করে। তাই অন্যদের প্রত্যাশার দায়ভার আমি নিচ্ছি না। তবে আমার নিজের প্রত্যাশার কথা বলতে, বাংলা সিনেমার কাছে আমার প্রত্যাশা কেবল একটি সেন্সিবল কনসেপ্ট, সুন্দর লোকেশন ও উন্নত টেকনোলজির মাধ্যমে সুন্দর একটি ছবি, চরিত্রানুযায়ী ভালো অভিনয় শিল্পী, ভালো কিছু গান। এসবই ‘ন ডরাই’-এ দারুণভাবে আছে। বিশেষ করে লোকেশন, লাইটিং, সিনেমাটোগ্রাফি অসাধারণ। প্রত্যাশার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি সুন্দর!
গল্পটাও বেশ ভালো। তবে চিত্রনাট্য ঠিক সেভাবে জমেনি। এই একটা বিষয় নিয়ে আক্ষেপ অবশ্যই থেকে যাবে। বিশেষ করে দ্বিতীয়ার্ধে ছবি অপ্রয়োজনীয় রকম লম্বা এবং কিছুটা হলেও স্লো বা বোরিং। চিত্রনাট্যে আরেকটা বিষয় সমস্যা তৈরি করেছে তা হচ্ছে গল্পের প্রধান চরিত্রকে সঠিক ভিত্তি দেওয়ার চেয়ে সার্ফিং রিলেটেড বিষয়গুলোকে নিয়ে অহেতুক সময় ক্ষেপণ করার একটা চেষ্টা চোখে পড়েছে। বিশেষ করে প্রধান চরিত্র আয়েশার সংগ্রাম কিংবা আয়েশা, সোহেলের প্রেম ভালোবাসার দিকটা যতটা শক্তিশালী বা স্পষ্ট ভাবে আসার কথা ছিল ততটা আসেনি, বরং সার্ফিং এবং সার্ফিংকে কেন্দ্র করে অন্য চরিত্রগুলোকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে স্পেস দেওয়া হয়েছে।
ফলে সাধারণ দর্শকের অনেকেই ছবির সঙ্গে রিলেট করতে পারবে না কিংবা আয়েশার সংগ্রাম, সোহেলের সাথে তার প্রেম ঠিক দর্শকদের সেভাবে স্পর্শ করতে পারবে না।
তারপরও ছোট ছোট কিছু দৃশ্যে আয়েশা এবং সোহেলকে যেভাবে দেখানো হয়েছে আমি তাতেই কনভিন্সড্। আমার কাছে চরিত্র দুটো দারুণ লেগেছে। আমি তাদের মধ্যকার সম্পর্কটাকে আরেকটু স্পষ্টভাবে আশা করেছিলাম। যদিও শেষ দৃশ্যটা আমাকে ভীষণই তৃপ্ত করেছে।
ছবিতে আয়েশা চরিত্রে নবীন অভিনয় শিল্পী সুনেরাহ বিনতে কামাল ভালো করেছে। যদিও সব সময় তার পরিপাটি সাজ চরিত্রের সঙ্গে সেভাবে যায়নি। একটু অগোছালো, বা মেকআপহীন থাকলে তাকে আরো দুর্দান্ত লাগতো। শরিফুল রাজ আরো একবার দুর্দান্ত অভিনয় উপহার দিয়েছে। প্রত্যেকটা দৃশ্যে তাকে ন্যাচারাল লেগেছে। বাকি সবাই মোটামুটি ঠিকঠাক অভিনয় করেছে। সামান্য কিছু দুর্বলতা কিছু কিছু দৃশ্যে চোখে পড়লেও ওভারাল অভিনয়ের দিক থেকে ছবিটি ভালোই হয়েছে।
ছবির তিনটা গানই শেষার্ধে পড়েছে। প্রথমার্ধে কোন গান নেই। একটা গান প্রথমার্ধে রাখলে খারাপ হতো না। তিনটা গানই মোটামুটি ভালো। ইউটিউবেও যেমন, সিনেমা হলেও তেমনই লেগেছে। সিনেমা হলে অনেক সময় অনেক গান কেমন অন্য রকম আবেদন তৈরি করে যা এ ছবির গান করতে পারেনি। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক অবশ্য ভালোই ছিল। কিছু কিছু জায়গায় একটু আরোপিত মনে হয়েছে তবে ওভারাল ভালো লেগেছে।
সব মিলিয়ে, ‘ন ডরাই’ চিত্রনাট্যে ধরাটা খেয়েছে সত্য, কিন্তু তারপরও ছবির গল্পে বাংলাদেশের মেয়েদের সামাজিক অবস্থার চিত্র যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে তা একেবারে বাস্তবসম্মত বলা যায়। পাশাপাশি আয়েশা আর সোহেলের ভালোবাসার গল্প খুব স্পষ্টভাবে না আসলেও তাদের গল্পটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখলে ভালো লাগার মতই বটে। তাদের মধ্যকার ছোট ছোট কিছু দৃশ্য বেশ ভালো এবং তাদের দুজনের গল্পের শেষটা এক হয়ে যায় সমুদ্রের পারে বসে। যে সমুদ্রের সঙ্গে মিশে আছে তাদের আত্মা। হয়তো তাদের গল্পটা শেষ হয়নি বরং সেখান থেকে শুরু হয়েছে। ক্লোজিং ক্রেডিটে তাই আমরা তাদের দুজনকেই স্বাধীনভাবে সমুদ্রে ভাসতে দেখি। জেফারের হারবো না গানের তালে তালে তারাও হয়তো তাদের পরবর্তী জীবনের জিতে যাওয়ার গল্প বলে যায়।
এমন লোকেশন এবং সিনেমাটোগ্রাফি বারবার বাংলা সিনেমায় দেখতে চাই। এমন ভিন্ন কনসেপ্টে আরো সিনেমা দেখতে চাই। শরিফুল রাজের মতো অভিনেতাকে বারবার পর্দায় দেখতে চাই।
‘ন ডরাই’ আমি বেশ উপভোগ করেছি। যারা ভিন্ন স্বাদের বাংলা চলচ্চিত্র দেখতে ভালোবাসেন তারা অবশ্যই এটা মিস করবেন না। আর যারা বাংলা সিনেমা দেখতে চান কিন্তু সিনেমার মান নিয়ে সন্দেহ্ থাকায় হলমুখী হচ্ছেন না তারাও ট্রাই করতে পারেন। কে জানে, হয়তো বাংলা সিনেমা নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি এ ছবি বদলেও দিতে পারে।
আমি ছবিটিকে অনেক বেশি মার্কস্ দিতাম, ইনফ্যাক্ট আমার এ যাবতের অন্যতম সেরা রেটিং পাওয়া ছবি হতো এটা, কিন্তু যখনই চিত্রনাট্যের দিকটা ভাবি তখনই মনে হয় খুব বেশি মার্কস্ দিলে অবিচার করা হবে। কারণ চিত্রনাট্যটি সত্যিই জমেনি তেমন। তাই চিত্রনাট্যের প্রতি আক্ষেপ রেখে আমি ছবিটিকে দিচ্ছি ৩.৫* বা ৭০% মার্কস্ (গ্রেড এ)।