পরাণের পর সুড়ঙ্গে ফের নারী চরিত্রের নেতিবাচক উপস্থাপন
স্পয়লার অ্যালার্ট: এই রিভিউতে ‘সুড়ঙ্গ‘ সিনেমার গল্পের কিছু অংশ উন্মোচিত। সিনেমা দেখার আগে গল্প জানতে না চাইলে এড়িয়ে যেতে পারেন।
‘পরাণ’ সিনেমার বাণিজ্যিক সাফল্যের পর এবার ঈদুল আজহায় হল ভর্তি দর্শকের মন কেড়ে নিল রায়হান রাফীর ‘সুড়ঙ্গ’। প্রিয়তমা স্ত্রীর নানাবিধ বায়না রক্ষার্থে দিশহারা মাসুদ ওরফে আফরান নিশো এটা-ওটা করেও যখন তার চাহিদার কাছে হেরে গেল তখন সেই ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রী একটা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে টাকাওয়ালা হবার রাস্তা তৈরি করলেন। নামকরণ হিসেবে ‘সুড়ঙ্গ’ একেবারেই জুতসই। আর এবারও রায়হান রাফী মূল চরিত্রকে সুপারহিরো বানিয়ে পার্শ্ব চরিত্রগুলোকে ভিলেন বানিয়ে ছেড়েছেন। আর দর্শকের চোখে সবচেয়ে বড় ভিলেন হিসেবে পর্দায় আবির্ভূত হলেন গ্রামের সাধারণ একটা মেয়ে ময়না (তমা মির্জা)।
যারা ইতিমধ্যে ‘ফ্রাইডে’ দেখেছেন তারা তমার অভিনয়ের শক্তিশালী দিকটা খুব ভালো জানেন, তার মেকাপবিহীন সাবলীল উপস্থাপন, চরিত্রের সাথে মিশে যাওয়া ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমায় দারুণভাবে প্রকাশ পেয়েছে। সিনেমা বলতে আমরা অনেকেই বুঝি জাঁকজমকপূর্ণ উপস্থাপন, কিন্তু চরিত্রের প্রয়োজনে নিজেকে কখন কতোটা দেখাতে হবে সেটা তমা রপ্ত করেছেন। বড়পর্দায় তিনি দক্ষ অভিনয়শিল্পী, নায়িকাসুলভ বিষয়টি যে কাজ করেনি এটাই ভালো লেগেছে। পোশাক ও মেকআপে বিভাগে যারা ‘সুড়ঙ্গ’ টিমে কাজ করেছেন তারা সাধুবাদ পাবার যোগ্য।
আফরান নিশো যাকে ঘিরে এতো আয়োজন তিনি নিরাশ করেননি। নাটকের অভিনেতারা সিনেমায় এলে দর্শকের মন কাড়তে সক্ষম হন না বেশিরভাগ সময়, কিন্তু নিশোর এন্ট্রিটা এমন দূর্দান্ত ছিল যে হল ভর্তি দর্শক আনন্দে হইহই করে উঠেছেন। বহু বছর পর বড়পর্দায় একজন আগাগোড়া নায়কের আবির্ভাব ঘটতে দেখলাম, ময়নাকে দেখে মইসহ পড়ে যাবার দৃশ্য অসাধারণ রোমান্টিক লেগেছে।
এই ফাঁকে বলে রাখি— এই সিনেমা কালার গ্রেডিং ও সিনেমাটোগ্রাফির জন্যে সর্বোচ্চ পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে আমার বিশ্বাস। রায়হান রাফীর প্রত্যেকটি কাজে একটা ন্যাচারাল লুক থাকে, সেদিক থেকে দর্শকের চোখের জন্য যথেষ্ট আরামদায়ক ছিল ‘সুড়ঙ্গ’। মাসুদ চরিত্রের নানা উত্থান-পতনের সঙ্গে নিশোর ভেঙেচুরে আবার স্বাভাবিক হয়ে থাকাটা গল্পের শেষ দৃশ্য পর্যন্ত ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন, আমার ভালো লেগেছে।
মোস্তফা মনোয়ার ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’ দিয়ে দর্শকনন্দিত। ময়নার সঙ্গে পরকীয়ায় ব্যস্ত জহির, সুন্দরী মেয়ে দেখলেই পা এগিয়ে দেয়া জহির চরিত্র দারুণ ফুটিয়ে তুলেছেন। কিন্তু এতো এতো বোল্ড দৃশ্য যে থাকবে তা তো সুড়ঙ্গ টিম কোথাও মেনশন করেননি। ময়না ও জহিরের বেশকিছু খোলামেলা অন্তরঙ্গ দৃশ্য আমার কাছে আরোপিত মনে হয়েছে, যেখানে মাসুদ ফ্লাশব্যাকে কল্পনা করেছিলেন।
ইন্টারভ্যালের পর সিনেমার আসল টুইস্ট শুরু হয়। যেখানে ব্যাংক ম্যানেজার ও তার ড্রাইভারের অনেকগুলো শট ফ্লাশব্যাকে খুব তাড়াহুড়ো করে দেখানো হয়েছে। এতোগুলো বোল্ড সিন কমিয়ে ব্যাংকের টাকাটা কীভাবে সরালো সেটা বিস্তারিত দেখালে সা্ধারণ দর্শক হিসেবে আমি আরো আনন্দ পেতাম। এমন বিছানার দৃশ্য ইচ্ছে করলেই ইউটিউবে ক্লিক করলে পাওয়া যায় কিন্তু অ্যাডভেঞ্চার বা রহস্যজনক দৃশ্যের জন্যে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। জহির চরিত্রে মোস্তফা তার সেরাটাই দিয়েছেন। জনতার হাতে মার খাওয়া পর তার প্রতি দর্শকের মায়া জন্মায়নি বরং তার করুণ পরিণতি সবাইকে হাসিয়েছে।
মাসুদের ব্যাংক সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না, তাকে ব্যাংক সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে ব্যাংকের ম্যানেজারের ড্রাইভার। এখানে ম্যানেজার হিসেবে অশোক ব্যাপারি ও তার ড্রাইভার চরিত্রে মনির আহমেদ শাকিলের যথেষ্ট কাজ ছিল যদিও পর্দায় সবটা ফ্লাশব্যাকে দেখানো হয়েছে। গল্পে যাদের অনেক বড় ভূমিকা কিন্তু তাদের অবস্থান কেন পর্দায় এত কম তা নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন থেকে গেল। এখানে একটা কারণ হতে পারে, সিনেমার প্রথম অর্ধেক চলে গেছে ময়না ও মাসুদের বিয়ে-সংসার আর পরকীয়া দেখাতে দেখাতে যেটা খুবই সাধারণ একটা ঘটনা, যাদের স্বামী প্রবাসে কাজ করতে যান তাদের হরহামেশাই এমন ঘটতে পারে। কিন্তু দ্বিতীয় অর্ধেকে যখন রায়হান রাফী সমস্ত চরিত্র এক করতে গিয়েছেন তখন এডিট করবার সময় নিশোকে রাখতে গিয়ে অনেক বড় বড় চরিত্র ফেলে দিতে হয়েছে, এটা আমার অনুমান; ভুল হতেই পারে।
সিনেমার একেবারেই শেষের দিকে দূর্দান্ত নাটকীয় এন্ট্রি হয়েছে সুঅভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিমের। চট্টগ্রামের ভাষায় মজার মজার সংলাপ দর্শককে বেশ বিনোদন দিতে সক্ষম হয়েছে, পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে দারুণ মানিয়েছে সেলিমকে। বিশেষ করে ময়নাকে যখন তিনি ইন্টারোগেট করেন তখন তার চোখে মুখে দারুণ উত্তেজনা কাজ করছিল। আর সুড়ঙ্গের ভেতরে নামা ও ওঠার ব্যাপারটাও চমকপ্রদ লেগেছে।
নুসরাত ফারিয়া এসেছেন, নেচেছেন, দেখিয়েছেন এবং জয় করেছেন। আইটেম সং-এ শতভাগ সফল ফারিয়া।
মোদ্দা কথা, ‘সুড়ঙ্গ’ সবকিছু মিলিয়ে একটি ব্যবসায়িক সফল সিনেমা; সেটা যারা প্রথম হলে গিয়ে টিকিট না পেয়ে আমার মতো ফিরে এসেছেন তারা জানেন। আমার শুধু রায়হান রাফীকে বলার ছিল— ‘পরাণ’ ও ‘সুড়ঙ্গ’-এ মেয়েদের যতোটা নেগেটিভ দেখানো যায় দেখিয়ে ফেলেছেন, এবার নতুন কোনো সিনেমায় মেয়েদের অসাধারণ সৌন্দর্যমণ্ডিত মানবীয় রূপটি উন্মোচন করবেন— সেই প্রত্যাশা রেখে গেলাম।